Sourced by the ABP
সে দিন সূর্যাপ্লুত স্যেন নদীর ধারে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম প্যারিস শহরকে। এই নদী প্যারিসের ব্যাকরণ সংজ্ঞায়িত করেছে। নগর পরিকল্পনার দায়িত্বে থাকা প্যারিসের ডেপুটি মেয়র ইমানুয়েল গ্রেগোয়ার বলেন, ‘লা স্যেন’ প্যারিসের জন্মের কারণ। কিন্তু স্বাস্থ্য সুরক্ষার কারণে গত শতক থেকেই স্যেন নদীতে সাঁতার
কাটা নিষিদ্ধ।
এই গ্রীষ্মে অলিম্পিক্স এবং প্যারালিম্পিক্স ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হবে প্যারিসে। যার জন্য প্যারিসের প্রশাসন স্যেনকে সাঁতারের উপযোগী করার জন্য তৎপর হয়েছে। কাজ শুরু হয়েছে, যাতে এ বছর স্যেনকে প্রথমে ক্রীড়াবিদদের জন্য এবং অবশেষে ২০২৫ সালে জনসাধারণের জন্য ‘নিষ্কলুষ’ করা যায়। স্যেনের পুনরুদ্ধারে দেড়শো কোটি ইউরোরও বেশি (১৩ হাজার কোটি টাকা) বিনিয়োগ করা হয়েছে।
স্যেনের পাশেই অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। অলিম্পিক্সের ইতিহাসে এই প্রথম একটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠান স্টেডিয়ামের বাইরে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে এবং আয়োজকেরা মনে করছেন, ৬ লক্ষ দর্শক সেই অনুষ্ঠানে থাকবেন। স্যেন নদীকে ম্যারাথন সাঁতার, ট্রায়াথলন এবং প্যারা-ট্রায়াথলনের মতো ক্রীড়া প্রতিযোগিতার জন্য ব্যবহার করা হবে।
এ সব কিছু সফল ভাবে করার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন নদীটিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার প্রচেষ্টায় সাফল্য লাভ করা। এই কাজে যারা যুক্ত, তাদের অন্যতম ‘ফ্লুইডিয়ন’ নামের একটি সংস্থা। এটি একটি ‘ওয়াটার ইন্টেলিজেন্স’ বা জলবিষয়ক তথ্যসরবরাহকারী সংস্থা। জলের গুণমান পরিমাপ করার প্রযুক্তি তৈরি করেছে সংস্থাটি। সাত বছর ধরে, ফ্লুইডিয়ন সাধারণ ব্যাকটিরিয়ার অস্তিত্বে জলের গুণমানতা পরিমাপ করতে ই. কোলাই এবং এন্টারোকক্কাস— এই দু’টি ব্যাকটিরিয়ার ঘনত্ব ট্র্যাক করছে। এই তথ্য থেকে জলে দূষণের পরিমাণ বোঝা যাবে।
প্যারিসের একটি পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা রয়েছে যা বৃষ্টির জল নিয়ে গঠিত। তবে ভারী বর্ষণে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নদীতে উপচে পড়ে এবং প্রচুর পরিমাণে ব্যাকটিরিয়া নদীর জলে ছড়িয়ে পড়ে যা ক্ষতিকারক এবং মৃত্যুর কারণও হতে পারে।
এই প্রসঙ্গেই উল্লেখ করা দরকার ‘ব্ল্যাক সিলিকন’ নামক একটি পদার্থের। এটিকে সাধারণত পদার্থবিদেরা ‘মেটামেটিরিয়াল’ বা সুপরিবর্তিত পদার্থ বলে থাকেন। অর্থাৎ এটির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলি প্রকৃতিতে সহজলব্ধ পদার্থের থেকে উৎকৃষ্ট। এটির একটি বৈশিষ্ট্য হল এটি ‘সুপার হাইড্রোফোবিক’, অর্থাৎ পদ্মপাতার মতো জলের বিন্দুকে ধারণ নিষ্কাশন ও আবর্জনা নিষ্কাশনে এই ‘ব্ল্যাক সিলিকন’কে ব্যাবহার করা হয়। প্যারিসের ‘দ্য ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চ’-এ গবেষণাকালে ব্ল্যাক সিলিকনের সঙ্গে টাইটেনিয়াম ডাইঅক্সাইডের মেটাফোম বানিয়ে এটিকে আরও কার্যকর একটি পদার্থ-মিশ্রণে পরিণত করা হয়েছিল, যাতে ‘ব্ল্যাক সিলিকন’-এর জল-শুদ্ধিকরণের ক্ষমতা বাড়ে। আমাদের গবেষণায় নির্মিত এই পদার্থটিই বেশ কয়েকটি জল-গবেষণা সংস্থা স্যেনের জল শুদ্ধিকরণের কাজে ব্যবহার করেছে।
ডেপুটি মেয়র গ্রেগোয়ার মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, জলদূষণ সার্বিক বিশ্বের একটি সমস্যা। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে জ়ুরিখ, মিউনিখ এবং কোপেনহাগেনের মতো ছোট ইউরোপীয় শহরগুলি শহুরে সাঁতারের সূচনা করেছে। বার্লিনের স্প্রি নদী এবং আমস্টারডামের খালে সাঁতার কাটার জন্যও চেষ্টা চলছে। গ্রেগোয়ারের মতে, স্যেন নদীকে যদি সাঁতারের উপযোগী করে তোলা যায় তা হলে প্যারিস ইউরোপের প্রথম বড় শহর হবে, যেখানে শহরের ভিতরে কোনও নদীতে সাঁতার কাটা যায়। গ্রেগোয়ারের কথায়, ‘‘এটি একটি স্বপ্ন। স্যেনকে সাঁতারের উপযোগী করে তোলার কাজটিকে দূষণ মোকাবিলার অন্যতম সেরা উদাহরণ করে তুলতে হবে।’’
এই পরিকল্পনার একটি অর্থনৈতিক প্রেরণাও আছে। ২০২৪-এর অলিম্পিক্সের দাবিদার হিসেবে প্যারিসের জয়ের মূল ভিত্তিই ছিল স্যেন পরিষ্কার করা। অলিম্পিক্স এমন একটি ক্রীড়াঅনুষ্ঠান যেখানে বিপুল পরিমাণে অর্থ লগ্নি ও খরচ করা হয়। ২০২০-র টোকিয়ো অলিম্পিক্সে খরচ হয়েছিল ১০৪০ কোটি ডলার (৮৬ হাজার কোটি টাকা)। অনুমান, প্যারিস অলিম্পিক্সে এর থেকেও বেশি খরচ হবে। ফ্রান্সের লিমোজেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর ল অ্যান্ড ইকোনমিক্স অব স্পোর্ট’-এর সমীক্ষা অনুসারে ইতিমধ্যেই ফ্রান্সে আড়াই লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে অলিম্পিক্স।
যদি এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়, সাঁতারের উপযোগী স্যেন প্যারিসবাসীদের গ্রীষ্মের উত্তাপ থেকেও কিছুটা মুক্তি দিতে পারে। প্যারিসে ২০১৯ সালে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে রেকর্ড গড়েছিল। বিশ্ব উষ্ণায়নের এই যুগে সেই রেকর্ডও তো যে কোনও দিন ভেঙে যেতে পারে!
লেখক ফলিত পদার্থবিদ্যায় পিএইচডি, বর্তমানে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যাপলায়েড সায়েন্সেস, লিয়নের পোস্ট ডক্টরাল গবেষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy