—প্রতীকী চিত্র।
এ দেশের প্রেসিডেন্ট ইচ্ছে করলে ক্যাবিনেট মন্ত্রীর দায়িত্বও নিতে পারেন। এ দেশে ১৯৭৮ পর্যন্ত সরকারের রাশ ছিল প্রধানমন্ত্রীর হাতে। এখন প্রেসিডেন্ট-কেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর পদটাই কার্যত আলঙ্কারিক।
এ দেশের পার্লামেন্টের ভোটে যে কোনও নির্বাচনী কেন্দ্রে কোনও দলেরই নির্দিষ্ট প্রার্থী নেই। ব্যালট পেপারে ভোটারদের দাগিয়ে আসতে হয়, প্রার্থীদের মধ্যে কে তাঁর প্রথম পছন্দ, কে দ্বিতীয়, কে তৃতীয়।
শ্রীলঙ্কার ভোট নিয়ে এমন অনেক চমকপ্রদ তথ্য দেওয়া যায়। দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কাই প্রথম দেশ, যারা প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটদানের অধিকার দিয়েছিল। সেটা ১৯৩১ সাল, ব্রিটিশ আমল। শ্রীলঙ্কার পড়শি দেশগুলো, অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপালে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার চালু হয় অনেক পরে। তবে এ দেশে ভোটে লড়তে গেলে পকেটের জোর থাকা দরকার। তাই পুরভোট বাদে শ্রীলঙ্কায় সচরাচর বিত্তশালীদেরই ভোটে দাঁড়াতে দেখা যায়।
১৯৪৮ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ভারতের মতো সংসদীয় কাঠামো ছিল শ্রীলঙ্কায়। পার্লামেন্টের নির্বাচনে সর্বাধিক আসন পাওয়া দল প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করত। তিনি মন্ত্রিসভা গড়তেন। তিনিই ছিলেন সরকারের প্রধান। প্রেসিডেন্ট (তখন বলা হত গভর্নর জেনারেল) ছিলেন দেশের আলঙ্কারিক প্রধান।
১৯৭৮ সাল থেকে ক্ষমতার কেন্দ্র হয়ে ওঠেন প্রেসিডেন্টই। তিনি আমজনতার ভোটে সরাসরি নির্বাচিত হয়ে আসেন পাঁচ বছর অন্তর। বহুদলীয় গণতন্ত্রের এই দেশে পার্লামেন্টেরও আলাদা নির্বাচন হয় পাঁচ বছর অন্তর। বৃহত্তম দল থেকে প্রধানমন্ত্রী-সহ মন্ত্রিসভার সদস্যদের বেছে নেন প্রেসিডেন্ট। শ্রীলঙ্কার মন্ত্রিসভার প্রধান কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নন, প্রেসিডেন্ট। এমনকি প্রেসিডেন্ট চাইলে ক্যাবিনেট মন্ত্রীর পদও নিতে পারেন। সচরাচর প্রেসিডেন্ট নিজের কাছে রাখেন অর্থ ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। নিজে পার্লামেন্টের বিতর্কে অংশগ্রহণও করেন। অর্থ বিল পাশ করাতে প্রেসিডেন্টকে পার্লামেন্টের ভরসাতেই থাকতে হয়। প্রেসিডেন্টের অনুপস্থিতিতে মন্ত্রিসভার বৈঠকের নেতৃত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সমর্থন যাতে প্রেসিডেন্ট পান, তাঁর বিলগুলি যাতে পার্লামেন্টে পাশ হয়, তা দেখা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব। এক অর্থে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী হলেন প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্টের মধ্যে যোগসূত্র।
শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টের সদস্য সংখ্যা ২২৫। তাঁদের মধ্যে ১৯৬ জন সারা দেশের ২৫টি প্রশাসনিক জেলা থেকে সরাসরি ভোটে জিতে আসেন। বাকি ২৯ জন এমপি মনোনীত হয়ে আসেন— কোন দল কত ভোট পাচ্ছে, সেই অনুপাতের ভিত্তিতে। ভোটের প্রক্রিয়া বেশ জটিল। ভারতে একটি নির্বাচনী কেন্দ্রে কোনও দল এক জনকেই প্রার্থী করে। কিন্তু শ্রীলঙ্কায় এক-একটি জেলাই এক-একটি নির্বাচনী কেন্দ্র। এ বার সেই জেলার লোকসংখ্যার ভিত্তিতে ঠিক হয়, সেখানে পার্লামেন্টের কতগুলি আসন থাকবে। ধরা যাক, কলম্বো জেলায় ২০টি আসন আছে। সে ক্ষেত্রে প্রত্যেক রাজনৈতিক দল ওই কেন্দ্র তথা জেলার জন্য ২০ জন প্রার্থীর তালিকা দেবে। সঙ্গে থাকবে বাড়তি তিন জন বিকল্প প্রার্থীর নাম।
বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্রে নয়, ব্যালট পেপারে ভোট হয় শ্রীলঙ্কায়। ব্যালটে থাকে সব দলের নাম ও প্রতীক। আর থাকে গোটা জেলায় প্রতিটি দলের সমস্ত প্রার্থীর নাম। ব্যালটে ভোটারকে প্রথমত নিজের পছন্দের রাজনৈতিক দলটিকে ভোট দিতে হয়। দ্বিতীয়ত, তাঁর পছন্দের দলের প্রার্থী-তালিকা থেকে বেছে নিতে হয়, সম্ভাব্য এমপি হিসেবে কে কে তাঁর প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পছন্দ। অবশ্য নির্দল হয়েও দাঁড়াতে পারেন কেউ।
কোনও দল মোট ভোটের পাঁচ শতাংশের কম পেলে গণনার প্রথমেই তারা ছিটকে যায়। সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া দলের ঝুলিতেই আসন যায় ঠিকই, কিন্তু এমপি কে হবেন, তা বাছতে গোনা হয় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পছন্দের ভোট। এই প্রথম পছন্দ হওয়ার জন্য শ্রীলঙ্কায় নেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা প্রবল। সেই জন্যই এখানে ভোটে লড়ার খরচও বেশি। প্রার্থীদের সারা জেলায় ঘুরে প্রচার করতে হয়। আগেকার দিনে নির্বাচনী কেন্দ্র ছিল ছোট। ভোটার এবং এমপি-র মধ্যে একটা যোগাযোগের পথ খোলা ছিল। এখন বিস্তর ব্যবধান। অনেকেই তাই চান, পুরনো নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ফিরে যেতে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়েও কিন্তু একই ভাবে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় পছন্দ বেছে নেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু সচরাচর সেটা না করে ভোটারেরা এক জনকেই বেছে নেন। নির্বাচিত হতে গেলে ৫০ শতাংশ ভোট পেতে হয়। দুইয়ের বেশি প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী থাকলে ও তাঁদের কেউই ৫০ শতাংশ ভোট না পেলে তখন প্রথম আর দ্বিতীয় হওয়া প্রার্থীকে নিয়ে ফের ভোট করতে হয়। তবে আজ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার কোনও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দ্বিতীয়
রাউন্ডে যায়নি।
এ বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরেই ফের এ দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। পার্লামেন্টের নির্বাচন ২০২৫ সালে। প্রাদেশিক ও পুর নির্বাচন অবশ্য আটকে রয়েছে বহুদিন ধরে। আসন পুনর্বিন্যাস, নির্বাচনী প্রক্রিয়া ঢেলে সাজানোর মতো নানা পরিকল্পনা ছিল। পদ্ধতিগত সমস্যা ছাড়াও তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কোভিড অতিমারি আর আর্থিক সঙ্কট। শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যায় মহিলারা প্রায় ৫২ শতাংশ হলেও নির্বাচিত মহিলা জনপ্রতিনিধি ৫ শতাংশও নেই। প্রার্থী হওয়ার চড়া খরচ এর একটা কারণ। এ দেশের ভোটে হিংসার ঘটনা নব্বইয়ের দশকের শেষে আর ২০০০-এর গোড়ার দিকে বেশ নিয়মিতই হয়ে উঠেছিল। হিংসার ভয়েও মহিলারা অনেকে পিছিয়ে যান। মূলত রাজনৈতিক পরিবারের মহিলারাই ভোটে লড়েন শ্রীলঙ্কায়।
ভোটের দায়িত্বে রয়েছে শ্রীলঙ্কার নির্বাচন কমিশন। ভোট যে ছুটির দিনেই হবে, এমন কোনও কথা নেই। ভোটের সময়ে পতাকা-পোস্টার-কাটআউটে ছেয়ে যায় রাস্তাঘাট। রাজনীতি নিয়ে জমে ওঠে আড্ডা-তর্ক। শ্রীলঙ্কার ভোটে রিগিং, বুথ দখল এ সব এখন অনেক কম। দেশের সঙ্কট যতই থাক, ভোটে উৎসাহ হারাননি শ্রীলঙ্কাবাসী। ভোটদানের হার ৮০ শতাংশ পেরিয়েই যায়। (লেখক কলম্বোর সাংবাদিক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy