প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। -ফাইল ছবি।
একটি দেশ নিষেধাজ্ঞা তুলে ‘বন্ধু’র দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। এক বছর আগে। অন্য দেশটি ‘বন্ধু’-র অনুরোধ পাওয়ার পর নিষেধাজ্ঞা জারি করল। এক বছর পরে।
ভারত এবং আমেরিকা।
দু’টি ঘটনাই ঘটল গত দেড় বছরের কোভিড সংক্রমণের পর্বে। ফলে আমজনতার মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে— এই ভাবেই কি ‘জাত চেনাচ্ছে’ আমেরিকা?
দু’টি ঘটনার কেন্দ্রে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হাত থেকে দেশের মানুষকে যত তাড়াতাড়ি বার করে নিয়ে আসা যায়, সেই উদ্দেশ্য। একটি ক্ষেত্রে ছিল কোভিডের সম্ভাব্য ‘ওষুধ’ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন। অন্য ক্ষেত্রের বিষয় কোভিড টিকা তৈরির কাঁচামাল।
তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঢাউস ঢাউস বাক্সে আমেরিকায় ‘হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন’ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তখন ট্রাম্পের বিশ্বাস ছিল, কোভিড সংক্রমণ রুখতে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের জুড়ি মেলা ভার! বিশেষজ্ঞদের বেশির ভাগই বলছিলেন, ম্যালেরিয়ার ওষুধ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কার্যকরী হবে না কোভিড সংক্রমণ রুখতে। বরং পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তবু ট্রাম্পের তখন অগাধ বিশ্বাস হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের উপর। অথচ ছিঁটেফোঁটাও হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নেই ট্রাম্পের দেশে। আর বিশ্বে সবচেয়ে বেশি হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন তৈরি করে ভারতই। তাই বন্ধু মোদীর কাছে সাহায্য চাইতে দেরি করেননি মোদী। আমেরিকায় ভোটের বছরে বন্ধু ট্রাম্প যাতে বিপদে না পড়েন সে জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে দেরি করেননি মোদীও। গত এপ্রিলে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের ৫ কোটি ট্যাবলেট বিমানে চাপিয়ে আমেরিকায় পাঠিয়েছিল ভারত। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন রফতানির নিষেধাজ্ঞা তড়িঘড়ি তুলে নিয়ে।
এ বার ভারতের দরকার দেশে কোভিড টিকা তৈরির কাঁচামাল। সেটা আমেরিকাই দিতে পারে। তাই আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছিল ভারত। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের গোড়া থেকে ‘ভারতবন্ধু’ হিসাবে পরিচিত বাইডেন কোনও স্পষ্ট আশ্বাস এখনও পর্যন্ত দেননি। বরং তাঁর প্রশাসন টিকা তৈরির কাঁচামাল রফতানির উপর জারি করেছে নিষেধাজ্ঞা।
আমেরিকার বিদেশসচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে কথা বলেছেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। আমেরিকায় থাকা ভারতের রাষ্ট্রদূত তরণজিৎ সিংহ সান্ধুও এই বিষয়ে আলোচনা করেছেন। জানা গিয়েছে, নয়াদিল্লিকে বাইডেন প্রশাসন জানিয়েছে, ভারতে টিকা তৈরির ক্ষেত্রে যাতে সমস্যা না হয় সে দিকে নজর দেবে তারা। তবে প্রথমে দেশের মানুষের চাহিদা মেটানো হবে। তার পরেই কাঁচামাল রফতানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
কেন? প্রশ্নটা উঠছে এই কারণেই যেহেতু আমেরিকায় নির্বাচনী প্রচারের গোড়া থেকেই বার বার নিজেকে ‘ভারতবন্ধু’ হিসাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন বাইডেন ও কমলা হ্যারিস, পরে যিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। তাঁরা ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে একের পর এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঠাঁই পেয়েছেন বাইডেন-হ্যারিসের মন্ত্রিসভায়। এর পরেও তা হলে কেন এমন আচরণ আমেরিকার?
এক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞের বক্তব্য, এর কারণ জানতে হলে কিছুটা পিছিয়ে যেতে হবে। ২০১৬-য় আমেরিকায় নির্বাচনী প্রচারের ছবিটা ছিল একেবারে বিপরীত। রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প তখন ‘ভারত-বিদ্বেষী’ বলেই ছিলেন সর্বজনবিদিত। ২০১৮ থেকে অবশ্য তিনি একটু একটু করে ভারতের দিকে ঝুঁকতে থাকেন। চিনকে ‘সমঝে রাখা’ যাবে ভেবে। একই সঙ্গে ফের হোয়াইট হাউসে ফেরার ‘পথের কড়ি’ জোগাড় করে দিতে পারেন ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা, এই উপলব্ধি থেকে পুনর্নিবাচিত হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ট্রাম্প আরও বেশি করে মোদীর বন্ধু হয়ে উঠতে চেষ্টা করেন। মোদীকে নিয়ে ‘হাউডি মোদী’-র মতো জমকালো অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করেন ট্রাম্প, তাঁর নিজের মুলুকে। নিজের দেশে ভোটের বছরে অতলান্তিক মহাসাগর পেরিয়ে আসেন ভারতে, মোদীর রাজ্য গুজরাতে ‘নমস্তে ট্রাম্প’ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। সুতরাং বর্তমানে টিকা তৈরির কাঁচামালের উপর ‘ভারতবন্ধু’ বাইডেন প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা জারির বিষয়টা দেখতে হবে এই প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে।
এক কূটনীতিবিদের কথায়, ‘‘আজ না হলে কাল ভারতকে টিকা তৈরির কাঁচামাল দেবে আমেরিকা। কিন্তু চাইলেই দেবে না। একটু ঝুলিয়ে রাখবে। বাইডেন, হ্যারিস চাইছেন মোদী সমস্যাটা নিয়ে একটু ভাবুন। উদ্বিগ্ন থাকুন। হিউস্টনে ট্রাম্পের হাত তুলে ধরে তো মোদীই বছর তিনেক আগে বলেছিলেন, ‘আব কি বার ট্রাম্প সরকার’। দু’এক জন বাদে কোনও ডেমোক্র্যাটই সেই সময় হাজির থাকেননি ট্রাম্পের ‘হাউডি মোদী’ অনুষ্ঠানে। থাকেননি হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিও। কমলা হ্যারিসই বা কী ভাবে ভুলতে পারেন, নিজেকে কৃষ্ণাঙ্গ ও দক্ষিণ এশীয় বলায় কী ভাবে মোদীর অনুগামীদের শ্লেষবিদ্ধ হতে হয়েছিল তাঁকে।’’
ওই কূটনীতিকের বক্তব্য, ‘‘আমেরিকা চাইছে টিকা তৈরির কাঁচামাল পাওয়ার জন্য আমেরিকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত তরণজিৎ সিংহ সান্ধু ক্যাপিটল হিলকে সাধাসাধি করুন। সাধাসাধি করুন পেলোসিকেও। তা হলে শেষ পর্যন্ত দেওয়া হবে। আর দিলেই ঢাকঢোল পিটিয়ে তা ঘোষণাও করবে বাইডেন প্রশাসন।’’
আমেরিকার বিদেশ সচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান শনিবার মন্তব্য করেন, ভারতের অবস্থা খুবই খারাপ। সত্বর অতিরিক্ত সাহায্য করা হবে। এঁদের বক্তব্য থেকেও বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসনের মনোভাব কিছুটা হলেও আঁচ পাওয়া গিয়েছে বলেই মনে করছেন ওই কূটনীতিবিদ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy