আক্রান্ত: ভেঙে পড়েছে পেন্টাগনের একটি অংশ। ফাইল চিত্র
রোদ ঝলমলে সাধারণ একটা মঙ্গলবার, সকাল পৌনে ন’টা পর্যন্ত অফিসে বসে তাই-ই মনে হচ্ছিল। তাই, আমার সহকর্মী সর্দার শাহিন কফি রুম থেকে বেরিয়ে যখন জানালেন, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের নর্থ টাওয়ারে এসে ধাক্কা মেরেছে একটা বিমান... তখন নিছক দুর্ঘটনাই ভেবেছিলাম। তখনও জানি না, ঠিক তার কয়েক মিনিট পরেই এমন অভিজ্ঞতা হবে যা সারাজীবনের মতো ছাপ ফেলে যাবে মাথার মধ্যে, অসহায়তা ও আতঙ্কের ছাপ।
নিউ ইয়র্কে এই বিমান ধাক্কা মারার খবর পেয়েও তাই বিশেষ বিচলিত না হয়ে নিবিষ্ট মনে কাজ করছিলাম। হঠাৎ শুনি অফিসের লবি থেকে শোরগোলের শব্দ। ছুটে গিয়ে দেখি, সবাই টিভির সামনে দাঁড়িয়ে, সকলের মুখেই ত্রস্ত ভাব। তখন সকাল ৯.০৩, সাউথ টাওয়ারে তত ক্ষণে ধাক্কা মেরেছে দ্বিতীয় বিমানটি। দাউদাউ করে জ্বলছে দু’টি টাওয়ার।
বাকিদের আতঙ্ক তখন ছড়িয়ে পড়েছে আমার মধ্যেও। নড়েচড়ে বসেছেন ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষও, তাই দ্বিতীয় বিমানটি ধাক্কা মারার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আমাদের অফিসে জরুরি নির্দেশ জারি হল— এখনই বাড়ি ফিরে যান। গাড়ি নিয়ে নেমে পড়লাম ইন্টারস্টেট ২৭০-এ, চারদিক তখন থমথম করছে। যে রাস্তা দিয়ে পরপর গাড়ি যায়, সে রাস্তা একেবারে ফাঁকা। হঠাৎ মাথার উপর দিয়ে দু’টো এফ-১৬ বিমান উড়ে গেল। আমার বাড়ির পাশেই অ্যান্ড্রুজ় বায়ুসেনা ঘাঁটি, যুদ্ধবিমান আমার কাছে নতুন নয়। এয়ার শো-ও দেখেছি বেশ কয়েকটি। কিন্তু এটা তো ঠিক এয়ার শো হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না! বুক দুরুদুরু করতে শুরু করল আমার, তত ক্ষণে অবশ্য এ দেশের সমস্ত মানুষের কাছেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে আমেরিকা আসলে আক্রান্ত! আমার কাছেও।
অ্যাক্সিলেটরে চাপ বাড়ালাম। ২০০-২২৫ কিলোমিটার গতিবেগ। কয়েক মিনিটেই বাড়ি পৌঁছে গেলাম। আমার স্ত্রী ঈপ্সিতা তখন সন্তানসম্ভবা, স্বভাবতই প্রচণ্ড উৎকণ্ঠিত ছিলেন তিনিও। বাড়ি পৌঁছেই আগে টিভি চালালাম। দেশের সমস্ত সংবাদমাধ্যমে তখন জোড়া-বিমান হানার সংবাদ। বারবার দেখানো হচ্ছে ঠিক কী ভাবে ভেঙে দু’টি টাওয়ারে ঢুকে গেল বিমান দু’টি— তারই ফুটেজ।
হঠাৎ টিভির পর্দায় পেন্টাগন। জ্বলছে একটা দিক। ধোঁয়া বার হচ্ছে। টিভি সঞ্চালক জানালেন, টুইন টাওয়ারের মতো একই কায়দায় বিমান দিয়ে ধাক্কা মারা হয়েছে পেন্টাগনেও। পরে জেনেছিলাম, ডিসি থেকে লস অ্যাঞ্জেলেস-গামী আমেরিকান এয়ারলাইনসের ৭৭ নম্বর বিমানটিকে টেক অফ করার ৩৫ মিনিট পরেই জঙ্গিরা অপহরণ করে। ৬৪ জন যাত্রী-সহ সকাল ৯.৩৭ মিনিটে পেন্টাগনের পশ্চিম দিকে ধাক্কা মারে বিমানটি।
আমার বাড়ি থেকে আমেরিকান প্রতিরক্ষা দফতরের সদর অফিসটি মাত্র ৫০ কিলোমিটার। পেন্টাগন ভার্জিনিয়া প্রদেশে হলেও ওয়াশিংটন ডিসির থেকে খুব কাছেই। পোটোম্যাক নদীর এক পাড়ে ডিসি, আর এক পাশে আর্লিংটন কাউন্টি। এই কাউন্টিতেই পেন্টাগন। বাড়িতে নিজের ঘরে বসে থাকলেও টিভির পর্দায় সেই দৃশ্য দেখে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল আমাদের। এক একবার মনে হচ্ছিল, স্ত্রীকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাই। মনে হচ্ছিল, এ দেশে আমরা একেবারেই নিরাপদ নই।
পরে আরও একটি বিমান অপহরণের কথা জানলাম। ইউনাইটেড এয়ারলাইনস ৯৩ বিমানটির যাত্রীরা সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে যদি বেলা ১০.০৩-এ পেনসিলভ্যানিয়ায় ক্র্যাশ না করিয়ে দিতেন, ফাইটার প্লেন দিয়ে সেটিকে গুলি করে নামানোর নির্দেশ ছিল।
সেই কুখ্যাত দিনের ঠিক পরের শনিবার পেন্টাগন গিয়েছিলাম। ধ্বংসস্তূপের দিকে তাকিয়ে অনুভব করেছিলাম... কিছু কিছু দৃশ্য আজীবন মাথার মধ্যে গেঁথে যায়। ৯/১১-র আক্রান্ত পেন্টাগনও তাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy