নমুনা সংগ্রহ করে ফিরল সিট। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।
পুলিশের চাপে ঘটনার রাতেই ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা রক্তের দাগ তাঁরা মুছে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলেন। সাগর ঘোষ হত্যা মামলায় বিশেষ তদন্তকারী দলের কাছে এমনটাই অভিযোগ করলেন নিহতের পুত্রবধূ শিবানী ঘোষ।
সোমবার পাড়ুইয়ের বাঁধনবগ্রামে নিহত সাগরবাবুর বাড়িতে তদন্তে যায় সিট। তখনই পুলিশের বিরুদ্ধে খুনের তথ্যপ্রমাণ লোপাট করার অভিযোগ তোলে সাগরবাবুর পরিবার। এ দিনই তদন্তকারী দলের সদস্যেরা ঘটনার সময় সাগরবাবুর পরনে থাকা রক্তমাখা লুঙ্গি সংগ্রহ করেন। পাশাপাশি ব্লেড ও খুর্পি দিয়ে রান্নাঘরের মেঝে থেকে প্রায় শুকিয়ে যাওয়া রক্তও তাঁরা সংগ্রহ করেন। খুনের পরে প্রায় সাত মাস কেটে গেলেও পুলিশ তা সংগ্রহ করেনি। সাগরবাবুর পরিবারের অভিযোগ, বারবার আবেদন করলেও খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত এমনই বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস তদন্তকারীরা সংগ্রহ করেনি। বরং পাড়ুই থানার পুলিশ প্রথম থেকেই খুনের তথ্যপ্রমাণ লোপাট করতে সক্রিয় ছিল বলেই তাঁদের দাবি। দিন কয়েক আগেই সিআইডি খুনের রাত থেকে পরিবারের হেফাজতে থাকা একটি গুলিও সংগ্রহ করেছিল। তদন্তকারী দল চলে গেলে শিবানীদেবী বলেন, “তথ্যপ্রমাণ লোপাট করে তদন্তকে প্রভাবিত করতে পুলিশের ওই অপচেষ্টা তখনই আমাদের নজরে পড়েছিল। তা না হলে কেন কোনও পুলিশ অফিসার গুলিবিদ্ধ শ্বশুরমশাইয়ের গা থেকে বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় চুঁইয়ে পড়া রক্তের দাগ ধুয়ে মুছে ফেলতে আমাদের উপরে জোর করবেন?” এমনকী, পুলিশ সাগরবাবুর জামাকাপড়ও সাবান দিয়ে ধুয়ে নিতে নির্দেশ দেয় বলে অভিযোগ। শিবানীদেবীর সংযোজন, “ভাগ্যিস আমরা রান্নাঘরে পড়ে থাকা রক্তের ছোপ পুলিশে নজর এড়িয়ে কোনও রকমে একটা চটের বস্তা দিয়ে ঢেকে ফেলতে পেরেছিলাম। লুঙ্গিও ধুয়ে ফেলেছি বলে জানিয়েছিলাম। তা না হলে এ দিন সিট-এর হাতে সেটি-ও তুলে দিতে পারতাম না।”
এ দিন সকালে পৌনে ১১টা নাগাদ প্রথমে ডিএসপি (সিআইডি) শঙ্কর ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে সিট সাগরবাবুর বাড়িতে যায়। ঘটনার রাতে বারান্দায় গুলি খেয়ে সাগরবাবু প্রাণ বাঁচাতে পাশেই রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছিলেন। সেখানে তাঁর শরীর থেকে খানিকটা রক্ত মেঝেতে পড়েছিল। পরিবারের কথামতো তদন্তকারীরা সেই জায়গাটিকে চিহ্নিত করে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের নমুনা সংগ্রহ শুরু করেন। খুব সাবধানে ব্লেড ও খুর্পির সাহায্যে ধীরে ধীরে মেঝে থেকে চেঁছে তুলে তা সংগ্রহ করা হয়। পুরো প্রক্রিয়াটিই ভিডিও রেকর্ড করে রাখা হয়েছে। পরে সাগরবাবুর পরিবার তদন্তকারীদের হাতে সাগরবাবুর রক্তমাখা লুঙ্গিটি তুলে দেন। তদন্তকারীরা সিজ করেন রক্ত চাপা রাখা চটও। পাশাপাশি রক্ত সংগ্রহ করতে সাহায্য করা ব্লেড, খুর্পিও তাঁরা সিজার লিস্টে তুলেছেন। দুপুর ১টার পরে দলটি ফিরে যায়। বিকেলে সাগরবাবুর বাড়িতে তদন্তে আসেন এডিজি (সিআইডি) রামফল পওয়ার এবং আইজি (সিআইডি) নীরজ সিংহও। দু’জনে নিহতের স্ত্রী সরস্বতীদেবী ও পুত্রবধূর সঙ্গে প্রায় আধঘণ্টা ধরে কথা বলেন। ঘটনার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ তাঁদের বয়ানে ভিডিও রেকর্ডিং করে তুলে রাখা হয়। নীরজবাবুদের কাছেই সাগরবাবুর পরিবার পুলিশের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগ করেন। তাঁরা ফিরে গেলে সরস্বতীদেবী বলেন, “ওঁরা তদন্তের ব্যাপারে আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন। আমাদের যা যা বলার, তা প্রায় সবই শুনেছেন। আরও কিছু বলার থাকলে ভবানীভবনে এসেও অভিযোগ জানাতে পারি বলে জানিয়েছেন।”
ঘটনার রাতে সাগরবাবুর বাড়িতে এসেছিলেন পাড়ুই থানার তৎকালীন ওসি সম্পদ মুখোপাধ্যায় এবং তদন্তকারী অফিসার দ্বিজরাজ সাহানা। তাঁদের বিরুদ্ধে আগেই ঘটনার রাতে গুলিবিদ্ধ সাগরবাবুর দেহ আটকে রেখে জোর করে সাদা কাগজে সই করে নেওয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন শিবানীদেবীরা। এ বার তাঁদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ লোপাটে সামিল হওয়ার অভিযোগও উঠল। তাঁরা ঘটনাস্থল থেকে ঠিক কী কী উদ্ধার করেছিলেন? সরস্বতীদেবীর দাবি, “আগেও বলেছি, ওরা সাদা কাগজে আমার আর বৌমার সই করিয়ে নিয়েছিলেন। তাতে নিজের মতো করে অভিযোগ লিখিয়েছিলেন। অনেক কিছুই তাঁরা সংগ্রহ করেননি। একই ভাবে সিজার তালিকাতেও গরমিল করা হয়েছে।” তাঁর দাবি, সে দিন ঘরের মেঝেতে দু’টি কার্তুজের খোল মিলেছিল। কিন্তু পুলিশের সিজার তালিকায় একটি খোলেরই উল্লেখ আছে। তিনি বলেন, “ওরা আর কী কী গরমিল করেছেন, জানি না। তবে, তদন্ত করতে আসা পুলিশ অফিসারদের আসল উদ্দেশ্য আমাদের কাছে ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে আসছিল।”
পাড়ুই থানার তৎকালীন ওসি বর্তমানে সিআই পদে পদোন্নতির জন্য ব্যারাকপুরে ট্রেনিংয়ে রয়েছেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে দ্বিজরাজবাবু এখনও পাড়ুই থানাতেই কর্মরত। তাঁর দাবি, “তদন্তকারী অফিসার হিসেবে ঘটনাস্থল থেকে যা পেয়েছি, সংগ্রহ করেছি। কাউকে আড়াল করা বা কারও প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করার জন্য কিছু করিনি। অভিযোগ ঠিক নয়।” অবশ্য সাগরবাবুর ছেলে হৃদয় ঘোষ বলছেন, “পুলিশ আসল অপরাধীদের আড়াল করতেই তথ্যপ্রমাণ লোপাট করার চেষ্টা চালিয়েছিল। এ দিন সিট-এর সদস্যেরা গুরুত্বপূর্ণ ওই জিনিসগুলি সংগ্রহ করায় আমরা খুশি। তাঁদের তৎপরতা দেখে সঠিক তদন্তের ব্যাপারে ভরসা হচ্ছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy