লাইন থেকে নেমে ঘষটে ঘষটে অনেকটা গিয়েও ওল্টায়নি ১২টি কামরার কোনওটাই।
যাত্রী-নিরাপত্তার বিষয়ে তারা কতটা সজাগ, তা দেখতে এবং দেখাতে কয়েক দিন আগে ঢাক পিটিয়ে হাওড়ায় দুর্ঘটনার মহড়া দিয়েছিল পূর্ব রেল। কিন্তু যতই মহড়া হোক, রবিবার দিল্লিমুখী আপ পূর্বা এক্সপ্রেসের বেলাইন হওয়ার ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, রেলের নিরাপত্তায় ফাঁক রয়ে গিয়েছে অনেক। আধুনিক প্রযুক্তির কামরা এ-যাত্রায় বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচিয়ে দিলেও রক্ষণাবেক্ষণের গাফিলতি তাতে চাপা পড়ে না বলে রেলেরই একাংশের অভিমত।
রেলের খবর, ২৩টির মধ্যে এস-১ থেকে এস-১১ অর্থাৎ ১১টি কামরা এবং প্যান্ট্রিকার লাইনচ্যুত হলেও কোনওটিই ওল্টায়নি। সামান্য আহত হয়েছেন কয়েক জন যাত্রী। আতঙ্ক ছড়িয়েছিল ব্যাপক। তবে এত বড় দুর্ঘটনার পরেও কামরাগুলি যে উল্টে যায়নি, সেটা দেখে যাত্রীরা হতবাক। কামরাগুলি রক্ষা পেল কী ভাবে? রেলকর্তারা জানাচ্ছেন, রাজধানী এক্সপ্রেসের মতো পূর্বার কামরাগুলিও আধুনিক মানের অর্থাৎ ‘লিঙ্ক হফম্যান বুশ’ বা এলএইচবি প্রযুক্তির। এই প্রযুক্তির রহস্য এটাই যে, বেলাইন হলেও কামরা সহজে ওল্টায় না। তাই ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো যায়। সেই প্রযুক্তিই রক্ষা করেছে পূর্বার যাত্রীদের।
ঠিক কী ঘটেছিল?
স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী এবং পূর্বার যাত্রীরা জানান, ট্রেনটি মাঝারি গতিতে হাওড়া থেকে আসছিল। লিলুয়া স্টেশনের ঢোকার মুখে আচমকাই ট্রেনটি কেঁপে ওঠে। বাঙ্কে রাখা মালপত্র এ-দিক ও-দিক হয়ে যায়, ঝুপঝাপ পড়তে থাকে নীচে। তখন চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে হাওড়ামুখী একটি মালগাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। তার পাশের লাইন (পাঁচ নম্বর) দিয়ে বিকট শব্দে ঘষটাতে ঘষটাতে ধুলো উড়িয়ে কিছুটা এগিয়ে থেমে যায় পূর্বা। তার ইঞ্জিন এবং জেনারেটর ভ্যান লাইনে থেকে গেলেও ১১টি কামরা এবং প্যান্ট্রিকার লাইন ছেড়ে বেরিয়ে যায়। আর্তনাদ শুরু করে দেন আতঙ্কিত যাত্রীরা। অনেকে ট্রেন থেকে লাফ দেন। তবে কোনও কামরাই না-ওল্টানোয় যাত্রীদের আতঙ্ক বদলে যায় বিস্ময়ে।
রবিবার সকাল সওয়া ৮টা নাগাদ পূর্বা ছেড়েছিল। দুর্ঘটনা ঘটে সাড়ে ৮টা নাগাদ। পাশের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মালগাড়ির চালক জিষ্ণু নন্দী বললেন, “সিগন্যালের অপেক্ষায় ছিলাম। দেখি, পাঁচ নম্বর লাইন ধরে আসছে পূর্বা। কিন্তু কয়েকটা কামরা আসছে দুলতে দুলতে, মাটির উপর দিয়ে ঘষে ঘষে। কামরাগুলো প্রচণ্ড দুলছিল। বিপদ বুঝে লাল পতাকা নাড়াতে থাকি। সেটা দেখেই পূর্বার চালক ইমার্জেন্সি ব্রেক কষেন।”
দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, লাইনচ্যুত কামরার ধাক্কায় চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের বেশ কিছুটা অংশ ভেঙে গিয়েছে। ভেঙে দুমড়েমুচড়ে গিয়েছে রেললাইনের অনেকটাই। ওভারহেড তার ছিঁড়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কামরাগুলির নীচের অংশের যন্ত্রপাতি ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে আছে লাইনে। কামরায় ওঠার পা-দানি ভেঙে লাইনে আটকে গিয়েছে। ভেঙে পড়েছে কামরার মধ্যবর্তী ‘ভেস্টিবিউল’-ও। অনেক কামরার চাকা বেঁকে গেঁথে গিয়েছে মাটিতে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আর একটু জোরে ধাক্কা লাগলে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো যাত্রীদের আঘাত লাগার আশঙ্কা ছিল।
দুর্ঘটনার পরে হাওড়া-বর্ধমান মেন ও কর্ড লাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ওভারহেড তারে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাওড়া নতুন কমপ্লেক্সে থমকে যায় দক্ষিণ-পূর্ব রেলের ট্রেন চলাচলও। রেলের রিলিফ ও মেডিক্যাল ভ্যান পৌঁছে যায় দুর্ঘটনাস্থলে। সেখানে দাঁড়িয়ে পূর্ব রেলের জেলারেল ম্যানেজার আর কে গুপ্ত বলেন, “কী ভাবে দুর্ঘটনা ঘটল, তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।” রেল সূত্রের খবর, মুখ্য নিরাপত্তা অফিসারের নেতৃত্বে যুগ্মসচিব পর্যায়ের পাঁচ জন অধিকারিককে নিয়ে তদন্ত কমিটি গড়া হয়েছে। তাদের তদন্তের পরেই দুর্ঘটনার যথাযথ কারণ জানা যাবে।
তবে প্রাথমিক তদন্তের পরে রেলকর্তাদের অনুমান, ‘পয়েন্ট’ (যেখান দিয়ে ট্রেনকে এক লাইন থেকে অন্য লাইনে নিয়ে যাওয়া হয়)-এ যান্ত্রিক ত্রুটির জেরেই দুর্ঘটনা ঘটেছে। রেললাইনে ফাটল ধরেছিল কি না, সেটাও যাচাই করা হচ্ছে। রেল ইঞ্জিনিয়ারদের বক্তব্য, যান্ত্রিক ত্রুটি বা লাইনে ফাটল, যেটাই ঘটে থাকুক, দু’টোই আসলে রক্ষণাবেক্ষণের ত্রুটি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, লিলুয়া স্টেশনের কাছে ওই লাইনের পয়েন্টে গ্যাংম্যানেরা কাজ করছিলেন। ট্রেন আসতে দেখে তাঁরা সরে যান। তখনই পয়েন্টে গোলমাল হয়ে যায় বলে রেলকর্তাদের একাংশের অনুমান।
লাইনচ্যুত পূর্বা এক্সপ্রেস।
রেল জানাচ্ছে, সব থেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে এস-৮ এবং এস-৯ কামরার। এস-৯ কামরার যাত্রী, বিষ্ণুপুর বাঁকড়াহাটের বাসিন্দা আশুতোষ নস্কর বললেন, “ইন্টারভিউ দিতে দিল্লি যাচ্ছিলাম। লিলুয়া ঢোকার সময়েই কামরা প্রচণ্ড দুলতে শুরু করে। দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখি, লাইন ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে ট্রেন এঁকেবঁকে চলেছে।” ওই কামরারই যাত্রী শেখ জাহিরুদ্দিন শৌচাগারে ছিলেন। বললেন, “আচমকা ভেঙে গেল বাথরুমের জানলার কাচ। ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম।” এস-১০ কামরায় ছিলেন দিল্লিবাসী সুদীপ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর অভিজ্ঞতা, “আচমকা বাঙ্ক থেকে ব্যাগ-বাক্স সব পড়তে আরম্ভ করল। কামরাটা ভরে গেল ধুলো আর ধোঁয়ায়। পাথরকুচি ছিটকে ঢুকতে লাগল কামরায়। কী করে যে বেঁচে গেলাম, ঈশ্বরই জানেন।” শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরার যাত্রীরা বিশেষ ভয় পাননি। কারণ, ওই কামরাগুলি লাইনচ্যুত হয়নি।
দুর্ঘটনার জেরে লিলুয়ায় আটকে পড়েন পূর্বার যাত্রীরা। পরে তিনটি লোকালে তাঁদের হাওড়ায় ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। এ দিনের আপ জোধপুর এক্সপ্রেস বাতিল করে বেলা ৩টে নাগাদ তাতে পূর্বার আটকে পড়া যাত্রীদের দিল্লি পাঠানো হয়েছে। বাতিল হয় বোলপুরগামী কবিগুরু এক্সপ্রেস এবং শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসও। দুর্ঘটনার ফায়দা তুলতে দেরি করেনি চোরেরা। এস-৮ কামরার যাত্রী ব্রিজেশ তিওয়ারি বললেন, “দুর্ঘটনার পরে ভীষণ ভয় পেয়ে লাফ দিয়ে নেমে পড়েছিলাম। পরে ট্রেনে উঠে দেখি, ব্যাগপত্র হাওয়া!”
দীর্ঘ ক্ষণ ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকলেও ছুটির দিন বলে দুর্ভোগ কিছুটা কম হয়েছে। তবে কর্ড লাইনের যাত্রীদের সমস্যায় পড়তে হয়। কারণ, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেন লাইনে আস্তে আস্তে ট্রেন চলাচল শুরু হলেও বেশি রাত পর্যন্ত কর্ড লাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধই ছিল। লাইনচ্যুত কামরা সরাতে এবং ভাঙা লাইনে সারাতে ভোর হয়ে যাবে বলে পূর্ব রেলের কর্তারা জানান। অথচ ভোরেই শুরু হয়ে যাবে নিত্যযাত্রীর ভিড়। কিন্তু কর্ড লাইনে লোকাল ট্রেন ঠিকমতো না-চললে নতুন সমস্যা দেখা দেবে।
ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy