শিল্প ক্ষেত্রে শান্তি ফেরাতে পদক্ষেপ করার আশ্বাস দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সোমবার ইকো পার্কের বৈঠক শেষে ফেরার পথে সুদীপ আচার্যর ছবি।
ভদ্রেশ্বরে চটকল কর্তা খুন হওয়ার পরের দিনই ঘটনাচক্রে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়ে সরাসরি ক্ষোভ উগরে দিল শিল্পমহল। জানিয়ে দিল, শ্রমিক অসন্তোষের নামে এ ভাবে জঙ্গি আন্দোলন মাথাচাড়া দিলে রাজ্য নতুন লগ্নি আসা তো দূরস্থান, যেটুকু শিল্প রয়েছে, তা-ও পাততাড়ি গোটাবে। মুখ্যমন্ত্রী শিল্পপতিদের আশ্বাস দেন, ইউনিয়নের নামে জঙ্গি আন্দোলন তাঁর সরকার বরদাস্ত করবে না।
রাজারহাটের ইকো পার্কে সোমবার মুখ্যমন্ত্রীর গড়া শিল্প সংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠক পূর্ব নির্ধারিতই ছিল। ফলে রবিবার ভদ্রেশ্বরের নর্থ ব্রুক জুট মিলের সিইও-কে পিটিয়ে মারার ঘটনা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সামনে নিজেদের অসন্তোষ তুলে ধরার সুযোগ পেয়ে যান কমিটির সদস্য শিল্পপতিরা। শ্রমিক আন্দোলনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তাঁরা বলেন, সেই ষাটের দশক থেকেই এমন ঘটনা লগ্নিকারীদের কাছে চিন্তার কারণ। প্রশাসনকে কড়া হাতে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, এ দিন বৈঠকে শিল্পে জঙ্গি আন্দোলনের কথা তোলেন ভারত চেম্বারের ভাইস প্রেসিডেন্ট এন জি খেতান। তিনি জানান, ১৯৬৯ সালে আসানসোল-দুর্গাপুরে জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলনে গুরুতর জখম হয়েছিলেন একটি
বড় সংস্থার বিদেশি শীর্ষ কর্তা। কিন্তু তার পর মহাকরণে এসেও কোনও সাহায্য পায়নি সংস্থাটি। শেষমেশ রাজ্য থেকে পাততাড়ি গোটায় তারা। এর পরেই খেতান বলেন, “এ সব ক্ষেত্রে সরকারের কাছে সাহায্য বা নিরাপত্তা না-পেলে, লগ্নি গোটানোর কথাই ভাবে সংস্থা।”
নবান্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, ভদ্রেশ্বরের ঘটনা নিয়ে শিল্প মহলের ক্ষোভের কথা মুখ্যমন্ত্রীর অজানা ছিল না। এ দিন বৈঠকের শুরুতেই তিনি নিজেই ওই প্রসঙ্গ তোলেন। ঘটনার নিন্দা করার পরে নিহত হরিকিষেন মহেশ্বরীর স্মরণে দু’মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। আর শিল্পপতিদের বক্তব্য শোনার পরে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ারও আশ্বাস দেন তিনি।
এর আগে বিধানসভাতেও একই বার্তা দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এ দিন সভায় ভদ্রেশ্বর এবং রায়দিঘির ঘটনার উপর সরকার পক্ষের আনা নিন্দাপ্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলাকালীন লিখিত বিবৃতি পাঠ করে মমতা বলেন, “ট্রেড ইউনিয়নের নামে জঙ্গি হামলা বরদাস্ত করবে না আমার সরকার।”
এই বিবৃতিকে কেন্দ্র করেই বিরোধী পক্ষের সঙ্গে বাদানুবাদে জড়ান মুখ্যমন্ত্রী। কংগ্রেসের বিধায়ক মনোজ চক্রবর্তী খবরের কাগজ তুলে ধরে সভায় বলেন, “আপনারা বলছেন শ্রমিকদের একাংশ এই ঘটনায় যুক্ত। কিন্তু চটকল মালিক নিজে বলছেন, তাঁর কারখানার কোনও শ্রমিক জড়িত নন।” তিনি অভিযোগ করেন, মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে চটকল মালিকের বক্তব্যের কোনও মিল পাওয়া যাচ্ছে না।
ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কালকের (রবিবার) ঘটনার পরে আমি ভদ্রতা করে কোনও রাজনৈতিক দলের নাম করিনি। আজ বলে দিই? ওখানে সিপিএম এবং বিজেপির শ্রমিক সংগঠন রয়েছে।” মনোজবাবু ভদ্রেশ্বরের ঘটনায় সিবিআই তদন্তের দাবি তুললে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “তা হলে সিবিআই-কে বলুন সরকার চালাতে। বিধানসভার দরকার নেই। সরকারের দরকার নেই।”
মমতা জানান, ভদ্রেশ্বরের ঘটনায় জড়িতদের উপযুক্ত কঠোর শাস্তি দিতে সরকার পিছপা হবে না। ইতিমধ্যেই ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এক জন দোষীও পার পাবে না।
কিন্তু শুধু ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাসে কি নিশ্চিন্ত হতে পারবে শিল্প মহল? নিরাপত্তা বা শান্তির অভাব যে বিনিয়োগের গন্তব্য হিসেবে কোনও রাজ্যকে কতটা পিছনে পাঠিয়ে দিতে পারে, হাতের কাছেই তার অন্যতম উদাহরণ অসম। দীর্ঘ দিনের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এমনিতেই ওই রাজ্যে লগ্নি আসার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার পর যখন পরিস্থিতি সামান্য শোধরাতে শুরু করে, ঠিক তখনই, ১৯৯০ সালের এপ্রিলে সেখানে খুন হন শিল্পপতি সুরিন্দর পল। অভিযোগের আঙুল ওঠে আলফা-র দিকে। অনেকেই মনে করেন, ওই ঘটনার খেসারত গুনে তার পর বহু দিন প্রায় লগ্নিশূন্য থাকতে হয়েছে অসমকে।
পশ্চিমবঙ্গের প্রতি শিল্প মহলের অনীহা প্রায় ঐতিহাসিক। যার একটা বড় কারণ ষাটের দশকে বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনগুলির জঙ্গি আন্দোলন। তখন থেকেই একের পর এক শিল্পের রাজ্য ছেড়ে চলে যাওয়ার সূত্রপাত।
পশ্চিমবঙ্গের প্রতি শিল্পপতিদের আস্থা আর কখনওই ফেরেনি। সিঙ্গুরের ঘটনার পরে কলকাতায় এসে ফোর্ড মোটরের কর্তা মাইকেল বোনহ্যাম বলেছিলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ঝুঁকি বেশি বলেই পশ্চিমবঙ্গ তাঁদের লগ্নি মানচিত্রে ঠাঁই পায়নি।
শিল্প মহলের মতে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলের শেষের দিকে খানিকটা হলেও আশার ঝিলিক দেখা দিয়েছিল। শিল্পপতিদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে লগ্নি টানার অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন বুদ্ধবাবু। কিন্তু সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনার জেরে সেই প্রয়াস থমকে যেতে সময় লাগেনি।
আর তৃণমূল আমলে তো রাজ্যের প্রতি শিল্পপতিদের অনীহা ক্রমশ বেড়েছে। মমতার ডাকে সাড়া দিয়ে মুম্বইয়ের শিল্প সম্মেলনে মুকেশ অম্বানীর মতো শিল্পপতি এসেছিলেন বটে, কিন্তু তার পরেও রাজ্যের শিল্পচিত্র বিন্দুমাত্র উন্নত হয়নি বলেই সংশ্লিষ্ট মহলের মত। তাঁদের অভিযোগ, রাজ্যের প্রতিশ্রুতি এখনও খাতায়কলমে বন্দি। শিল্পপতিদের একটা বড় অংশের অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রী টালিগঞ্জের কলাকুশলীদের সঙ্গে সময় কাটাতে যতটা স্বচ্ছন্দ বোধ করেন, লগ্নিকারীদের সঙ্গে ততটা নয়। ফলে সরকারে শীর্ষ স্তরে নিজেদের অভাব অভিযোগের কথা পৌঁছে দিতে যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হয় তাঁদের। এ ছাড়া, জমি অধিগ্রহণ, জমির ঊর্ধ্বসীমা সংক্রান্ত ছাড়পত্র (১৪ওয়াই) ইত্যাদি সমস্যা তো রয়েইছে।
ফলে রাজ্যে নতুন লগ্নি আসার সম্ভাবনা ক্রমেই ক্ষীণ হচ্ছে। তার সঙ্গে ভদ্রেশ্বরের মতো ঘটনা ঘটলে সামান্য লগ্নি যেটুকু পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে, তা-ও অন্যত্র তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে হবে বলে শিল্প মহলে গুঞ্জন। সেই কথাই মুখ্যমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরেছেন কোর কমিটির সদস্যরা।
বেঙ্গল চেম্বারের ভাইস প্রেসিডেন্ট অলোক রায় জানান, শিল্পায়নের জন্য রাজ্যে শান্তি জরুরি। হিংসাত্মক শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ফিকি-র গৌরব স্বরূপ, এমসিসি-র সঞ্জয় অগ্রবাল, সিআইআই-এর অনিল বর্মা, বেঙ্গল ন্যাশনাল চেম্বারের দিব্যেন্দু বসুরা।
মুখ্যমন্ত্রী শিল্পপতিদের আশ্বস্ত করে জানান, রাজ্যে শান্তি রয়েছে। পাশাপাশি, রাজ্যের বিভিন্ন উদ্যোগকে সদর্থক ভাবে দেখার জন্যও শিল্প কর্তাদের আহ্বান জানান তিনি। বৈঠকের পর ইন্দো-ইতালিয়ান চেম্বারের কর্তা পঙ্কজ পারেখ বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, কিছু লোকজন এ সব ঘটাচ্ছে। কিন্তু তারা সফল হবে না। রাজ্য ব্যবস্থা নিচ্ছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy