Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

মোদীও ব্যর্থ, বাংলায় আর ফিরবে না এবিজি

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিগত উদ্যোগও শেষ পর্যন্ত কাজে এল না। এবিজি জানিয়ে দিল, সার্বিক পরিস্থিতির কোনও উন্নতি না-হওয়ায় তারা আর হলদিয়া বন্দরে কাজ করতে আসবে না। দু’বছর আগে স্থানীয় দুষ্কৃতীদের ধারাবাহিক হামলা-অপহরণের জেরে ফরাসি যৌথ উদ্যোগের পণ্য খালাসকারী সংস্থাটি হলদিয়া তথা এ রাজ্য থেকে পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হয়েছিল। এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আইন-শৃঙ্খলার প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গকে দেশের অন্যতম সেরা হিসেবে দাবি করলেও এবিজি তেমনটি মনে করছে করছে না।

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:১৬
Share: Save:

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিগত উদ্যোগও শেষ পর্যন্ত কাজে এল না। এবিজি জানিয়ে দিল, সার্বিক পরিস্থিতির কোনও উন্নতি না-হওয়ায় তারা আর হলদিয়া বন্দরে কাজ করতে আসবে না। দু’বছর আগে স্থানীয় দুষ্কৃতীদের ধারাবাহিক হামলা-অপহরণের জেরে ফরাসি যৌথ উদ্যোগের পণ্য খালাসকারী সংস্থাটি হলদিয়া তথা এ রাজ্য থেকে পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হয়েছিল।

এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আইন-শৃঙ্খলার প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গকে দেশের অন্যতম সেরা হিসেবে দাবি করলেও এবিজি তেমনটি মনে করছে করছে না। বরং দিল্লিকে এবিজি সাফ জানিয়েছে, তারা হলদিয়া ছাড়ার পরে সেখানকার কর্মসংস্কৃতি বদলায়নি, নিরাপত্তার হালও তথৈবচ। এই পরিস্থিতিতে তারা কোনও অবস্থাতেই হলদিয়ায় বিনিয়োগ নিয়ে ফিরবে না বলে গত ১২ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় জাহাজ মন্ত্রককে এবিজি-র তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবিজি এমন একটা সময়ে সিদ্ধান্তটি নিল, যখন কেন্দ্রীয় জাহাজমন্ত্রী নিতিন গডকড়ী কলকাতা বন্দরের হাল-হকিকত সরেজমিনে দেখতে আসছেন। আজ, মঙ্গলবার তাঁর কলকাতা বন্দরে যাওয়ার কথা।

এমতাবস্থায় বন্দর-কর্তারা বেশ চিন্তিত। কারণ, এবিজি চলে যাওয়ায় হলদিয়া বন্দরের ২ ও ৮ নম্বর বার্থে যন্ত্রনির্ভর মাল খালাস পুরোপুরি বন্ধ। তিন বার দরপত্র চাওয়া হয়েছে, তবু দুই বার্থে কাজ করতে চেয়ে কোনও সংস্থা এগিয়ে আসেনি। কেন্দ্রে পালাবদলের পরে নতুন প্রধানমন্ত্রী এবিজি’কে ফেরাতে ব্যক্তিগত ভাবে সচেষ্ট হলেও সংস্থা কেন তাতে সাড়া দিল না, কেনই বা হলদিয়া বন্দরে তাদের পছন্দের পরিবেশ ফিরল না, সে ব্যাপারে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর প্রশ্নের মুখে পড়তে হতে পারে বলে বন্দর-কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা। ফলে অস্বস্তিও।

আইন-শৃঙ্খলায় অবনতির কারণ দেখিয়ে ২০১২-র ৩১ অক্টোবর এবিজি হলদিয়া ছেড়েছিল। সেখানেই থেমে থাকেনি, আন্তর্জাতিক আরবিট্রেশন আদালতে মামলা করে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাদের ‘বিতাড়ণের’ অভিযোগও তুলেছে। সেই সঙ্গে কলকাতা বন্দরের কাছে দাবি করেছে অন্তত ৮০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ। রাজ্য ছাড়লেও তারা মামলা-মোকদ্দমার জন্য হলদিয়ার ২ ও ৮ নম্বর বার্থ থেকে ছ’টি মোবাইল হারবার ক্রেন, পে লোডার, ডাম্পার ইত্যাদি বার করে নিয়ে যেতে পারেনি।

এবিজি-কাণ্ড কেন্দ্রীয় সরকারেরও নজর এড়ায়নি। জাহাজ মন্ত্রকের খবর: প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে মোদীর সঙ্গে ফ্রান্সের এক শিল্প-প্রতিনিধি দলের বৈঠক হয়েছিল, যেখানে প্রধানমন্ত্রী এ দেশে আরও বেশি ফরাসি বিনিয়োগের আহ্বান জানান। অন্য দিকে ফরাসি প্রতিনিধিরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আক্ষেপ করে বলেন, হলদিয়া বন্দর থেকে এমন এক সংস্থাকে কার্যত ঘাড়ধাক্কা দেওয়া হয়েছে, যাতে ফরাসি লগ্নি রয়েছে। রাজ্য সরকার, বন্দর কিংবা জাহাজ মন্ত্রক কেউই তাদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি। ফলে ভারতে বিনিয়োগের প্রশ্নে ফ্রান্সের শিল্পমহল কিছুটা দ্বিধায় রয়েছে বলে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীকে বার্তা দেওয়া হয়।

কেন্দ্রীয় সূত্রের দাবি: এ হেন প্রেক্ষাপটে ভাবমূর্তি উদ্ধারের তাগিদে এবিজি-কে হলদিয়ায় ফেরাতে মোদী সক্রিয় হয়ে ওঠেন। জাহাজমন্ত্রী গডকড়ীকে তিনি নির্দেশ দেন উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার। এবিজি-র সঙ্গে আলোচনা চালাতে গডকড়ী গড়ে দেন তিন সদস্যের কমিটি, যার মাথায় রাখা হয় কোচি বন্দরের চেয়ারম্যান পল অ্যান্টনিকে। অন্য দুই সদস্য হলেন তুতিকোরিন বন্দরের চেয়ারম্যান এসএসি বসু ও পারাদীপ বন্দরের চেয়ারম্যান এসএস মিশ্র।

কলকাতা বন্দর-কর্তৃপক্ষ এবং এবিজি’র বক্তব্য শোনার পরে অ্যান্টনি কমিটি গত নভেম্বরে মন্ত্রকে রিপোর্ট পেশ করেছে। তাতে এবিজি’র হলদিয়া-ত্যাগ প্রসঙ্গে সংস্থার কর্মী-অফিসারদের উপরে পরের পর হামলা, অপহরণ এবং সব জেনেও রাজ্য পুলিশের নির্লিপ্ত ভূমিকার উল্লেখ রয়েছে। কমিটির পরামর্শ, পাবলিক-প্রাইভেট-পার্টনারশিপের মাধ্যমে এবিজি’কে ফেরানোর কথা ভাবা যেতে পারে। পাশাপাশি কমিটি চায়, বন্দর ও এবিজি পরস্পরের বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ এনেছে, পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে তা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া চালু হোক।

ঘটনা হল, এবিজি হলদিয়ামুখোই হতে চাইছে না আর। সংস্থার অন্যতম কর্ণধার সাকেত অগ্রবালের কথায়, “আমার কর্মীরা বারবার মার খেয়েছেন। বন্দুক ঠেকিয়ে পরিবার সমেত অফিসারকে অপহরণ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে এক বছরের শিশুও ছিল। সেই অবস্থা এখনও বদলায়নি। কার ভরসায় ফিরব?” অ্যান্টনি কমিটির সামনে তিনি এ-ও নালিশ করেন, তৃণমূলের এক রাজ্যসভা সদস্যের যে সংস্থা হলদিয়ায় পণ্য খালাসের কাজ করে, তারা কোনও প্রতিযোগীর উপস্থিতি সহ্য করতে পারে না। সে কারণেই সন্ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করে তাদের তাড়ানো হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ওই সময়ে কেন্দ্রে জাহাজ মন্ত্রকের দায়িত্ব ছিল তৃণমূল সাংসদ মুকুল রায়ের হাতে। আর ওই তল্লাটের তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর লোকজনই পর পর হামলা, অপহরণের নেতৃত্ব দিয়েছিল বলে এবিজি’র অভিযোগ। যা শুনে তমলুকের সাংসদ শুভেন্দুবাবুর প্রতিক্রিয়া, “ডাহা মিথ্যে কথা। এবিজি কম দরে কাজ ধরেছিল, অথচ সেই দরে কাজ করতে পারছিল না। তাই পালানোর বাহানা খুঁজছিল। পালিয়ে যাওয়ার ঢাল হিসেবেই আমাদের কালিমালিপ্ত করা হচ্ছে।” শুভেন্দুবাবুর সংযোজন, “এখন ওরা আসুক না! কর্মীদের ছাঁটাই না-করলে আমার সহযোগিতা থাকবে।”

কলকাতা বন্দর-কর্তৃপক্ষ কী করবেন?

বন্দরের চেয়ারম্যান রাজপাল সিংহ কাহালোঁ বলেন, “এবিজি ফিরলে ভাল। না-হলে আমাদের বিকল্প প্রস্তাব রয়েছে। মন্ত্রক যেমন পরামর্শ দেবে, তেমন কাজ হবে।” বিকল্পটি কী?

বন্দর-সূত্রের খবর, হলদিয়ার ২ ও ৮ নম্বর বার্থে মাল খালাস দু’ভাগে ভাগ করার প্রস্তাব দিয়েছেন বন্দর-কর্তৃপক্ষ। তাঁরা চান, জাহাজ থেকে মাটিতে মাল নামানো, আর তা বন্দরের বাইরে নিয়ে যাওয়া এই দু’ধরনের কাজের জন্য আলাদা আলাদা টেন্ডারের অনুমোদন দেওয়া হোক। এবিজি না-এলে নতুন সংস্থা ছ’টি মোবাইল হারবার ক্রেন-সহ তাদের ছেড়ে যাওয়া যন্ত্রগুলো কিনে নিতে পারবে।

আজ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকেও বন্দর-কর্তারা সেটাই বলতে পারেন।

অন্য বিষয়গুলি:

jagannath chattopadhyay abg haldia dock
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE