ব্যারাকপুরে মেট্রো সম্প্রসারণের বোর্ড।
ইঙ্গিতটা মিলেছিল বছর দেড়েক আগেই। বি টি রোডের মাটিই নাকি মেট্রোর কাজের উপযুক্ত নয়! একে তো মাটির তলায় পানীয় জল থেকে বিদ্যুৎ হাজারো পাইপলাইন ও তারের জটলা। তার উপরে মাটির ভূতাত্ত্বিক চরিত্রেও সমস্যা রয়েছে। তার জেরেই থমকে থমকে এগোচ্ছিল কাজ। তবু আশাটা রয়ে গিয়েছিল দমদম থেকে ব্যারাকপুর কয়েক লক্ষ মানুষের মনে। ‘মেট্রো হবে’, এই খুড়োর কলে রাতারাতি বেড়ে গিয়েছিল নির্মীয়মাণ ফ্ল্যাটের দামও। কিন্তু রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, ব্যারাকপুরে মেট্রো রেল হবে না। তার পর থেকেই কিছুটা দমে গিয়েছে সেই আশাটা।
বছর চারেক আগের কথা। রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন রেলমন্ত্রী। তিনিই ঘোষণা করেছিলেন, দমদম থেকে ব্যারাকপুর পর্যন্ত মেট্রো সম্প্রসারণ করা হবে। ঠিক হয়ে গিয়েছিল মেট্রো স্টেশনগুলির নামও। ২০১১ সালে দীনেশ ত্রিবেদী রেলমন্ত্রী হওয়ার পরে ঘোষণা করেন, মেট্রো যাবে কল্যাণী পর্যন্ত। ওই বছর থেকেই বি টি রোডের উপরে কাজ শুরু হয়ে যায়। কাজ শুরু হয় ডানলপ থেকে দক্ষিণেশ্বরের দিকেও।
বিরাট বিরাট যন্ত্রপাতি। দিন-রাত লোহালক্কড়ের শব্দ। মাটি খোঁড়ার আওয়াজ। দেখতে দেখতে বদলে গিয়েছে বি টি রোডের চেহারা। এক সময়ে বি টি রোডের দু’পাশে সার সার গাছ ছিল। রাস্তা চওড়া করার জন্য সেগুলি কেটে ফেলা হয়। এখন বি টি রোডের দু’দিক কার্যত ন্যাড়া। রাস্তা চওড়া হওয়ায় বেড়েছে ঝুপড়ি-দোকানের সংখ্যা।
বেড়ে গিয়েছে বহুতল নির্মাণও। বি টি রোড থেকে যে কোনও দূরত্বের ফ্ল্যাটের বিজ্ঞাপনেই লেখা থাকছে, “পাঁচ মিনিটে মেট্রো স্টেশন।” আর তা দেখিয়েই চড়েছে দু’পাশের নির্মীয়মাণ ফ্ল্যাটের দাম। ২০১১ সালে যে ফ্ল্যাটের দাম ছিল বর্গফুট-পিছু ৮০০ টাকা, তা এখন ৩৬০০ টাকায় ঠেকেছে! এলাকার এক বাসিন্দা বললেন, “এখন মেট্রো না হলেও জমির দাম তো কমবে না!”
(ডান দিকে) ডানলপ ও (বাঁ দিকে) দক্ষিণেশ্বরে মেট্রোর অসমাপ্ত কাজ। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়
শুরু থেকেই অবশ্য বারংবার ধাক্কা খেয়েছে মেট্রো সম্প্রসারণ প্রকল্প। বি টি রোডের তলায় পানীয় জলের পাইপ, নিকাশি নালা, ফোনের তার সবই রয়েছে। কিন্তু সেগুলির কোনটা কোথা দিয়ে গিয়েছে, তার কোনও নির্দিষ্ট মানচিত্র রেলের হাতে ছিল না। তাই বি টি রোডের উপরে ৩০টি জায়গায় গর্ত খোড়ার সময়ে থমকাতে হয়েছে রেলকে। ঘিরে রেখে গর্ত খোঁড়ার কাজ চলার জন্য হত যানজট। কখনও সখনও তার কেটে কিংবা পাইপ ফেটে গিয়ে নাগরিক-পরিষেবাও বিপর্যস্ত হয়েছে। কিন্তু তা নিয়ে বিশেষ বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হয়নি। এলাকার বাসিন্দাদের বক্তব্য, উন্নয়নের কাজ চলছিল। তাই এ সব অসুবিধা নিয়ে মাথা ঘামাননি তাঁরা।
গর্ত খোঁড়ার সময়ে কানাঘুঁষো শোনা গিয়েছিল, রেলের পরীক্ষায় ফেল করেছে বি টি রোডের জমি। মাটির গঠনগত দৌর্বল্যের কারণে অনেক জায়গাতেই স্তম্ভ গড়া যাবে না। অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে ব্যারাকপুর মেট্রোর ভবিষ্যৎ। এ সব কারণেই থমকে যায় সম্প্রসারণের কাজ। রেল অবশ্য বলছে, বি টি রোডের তলায় পাইপ ও তারের জটলা কাটানোর অসুবিধা রয়েছে। এ ব্যাপারে রাজ্য সরকারের সাহায্য দরকার। কিন্তু তা মেলেনি বলেই রেল সূত্রের অভিযোগ।
কাজ শুরুর দিকে দমদম থেকে বাগজোলা খাল পর্যন্ত স্তম্ভ গাঁথার কাজ হয়েছিল। শনিবার ওই এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, খালের জলে সেই স্তম্ভ এখনও ডুবে আছে। দক্ষিণেশ্বরের দিকেও ডানকুনি-শিয়ালদহ রেললাইন বরাবর দমদম থেকে বেলঘরিয়া সিসিআর ব্রিজ পর্যন্ত কিছু স্তম্ভ গাঁথা হয়েছিল। স্থানীয় কিছু বাসিন্দারাই জানান, কাজ অনেক দিন হল বন্ধ রয়েছে। রোদে-জলে মরচে ধরেছে স্তম্ভের লোহায়। কাজের কিছু যন্ত্রপাতি পড়ে রয়েছে। বেশির ভাগই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
সমস্যা ছিল অধিগ্রহণেরও। তিরিশ বছর আগে দমদমে মেট্রো তৈরি হওয়ার সময় থেকেই দমদম ও বেলঘরিয়ার মাঝে মেট্রো রেলের ঠিকাকর্মীদের বসতি গড়ে ওঠে। নাম হয় ‘মেট্রোপল্লি’। মেট্রো রেল সম্প্রসারণের জন্য উচ্ছেদ করা হবে, এই আশঙ্কায় ২০১১ সালেই মেট্রোপল্লি-র বাসিন্দারা প্রতিবাদ শুরু করেন। যোগ দেন প্রতিবেশী রাজীবনগরের বাসিন্দারাও। তৈরি হয় ‘রাজীবনগর-মেট্রোপল্লি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি’। রেল সূত্রের অবশ্য দাবি, পরিকল্পনা অনুযায়ী, ওই এলাকায় মাত্র সাড়ে পাঁচশো পরিবারকে উচ্ছেদ করতে হত। সেটা গোটা এলাকার একটা অংশ মাত্র।
কিন্তু সেই সাড়ে পাঁচশো ঘরকেও সরাতে পারেনি রেল। রেলের পক্ষ থেকে বারংবার নোটিস পাঠানো হলেও জমি খালি হয়নি। তার ফলেই দক্ষিণেশ্বর ও ব্যারাকপুরের দিকে সম্প্রসারণের কাজ আটকেছে। রেলের চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করে প্রতিরোধ কমিটির সদস্য প্রশান্ত মজুমদার বলেন, “পুনর্বাসন না পেলে উঠব না। এখানে থাকার অধিকার আমাদের রয়েছে।” তবে মেট্রোপল্লির অনেক বাসিন্দাই অবশ্য মেট্রো না হওয়ার খবরে বেশ আশাহত। তাঁরা চান, মেট্রো হোক। এলাকার বাসিন্দা ও মেট্রো রেলের ঠিকাকর্মী জাকির হোসেন, আতারুল ইসলাম, রতন পাল, প্রবীর মৃধার কথায়: পরিকল্পনা করে কাজ হোক। তা হলে আমরাও পাশে আছি।
ওই এলাকার অনেকেই বলেন, মেট্রোর সম্প্রসারণের পথ যদি কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, তা হলে এত সমস্যা হবে না।
কিন্ত মেট্রো রেলের প্রস্তাবিত সম্প্রসারণ আদৌ হবে কি?
রেল সূত্রের খবর, আশা নেই বললেই চলে। যদিও দমদম-ব্যারাকপুর এলাকার বাসিন্দাদের চোখমুখ বলছে, বৃথা আশা সহজে মরে না। আর এই আশার আলো আরও বাড়িয়েছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ও প্রাক্তন রেলমন্ত্রী মুকুল রায়। এ দিন সন্ধ্যায় তৃণমূল ভবনে এক সাংবাদিক বৈঠকে তিনি বলেন, “রেলের সদিচ্ছা থাকলে এই প্রকল্প হওয়ায় কোনও বাধা নেই।” তিনি জানান, রেল ইচ্ছে করলে নিয়ম মেনে জমি অধিগ্রহণ করতেই পারে। তবে জোর করে অধিগ্রহণ করা যাবে না। মুকুলবাবুর সুরেই ব্যারাকপুর পুরসভার চেয়ারম্যান ও তৃণমূল নেতা উত্তম দাস বলেন, “ব্যারাকপুর পর্যন্ত মেট্রো হবেই।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy