তপসিয়ায় কান্ট্রি ভ্যাকেশনস ক্লাবের সেই অফিস।—নিজস্ব চিত্র।
হঠাৎই মোবাইলে ফোন পেয়ে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন প্রবীণ দম্পতি। ভ্রমণ সংস্থার লটারিতে পুরস্কার জিতেছেন তাঁরা! একটি শপিং মলে আসতে হবে পুরস্কার নিতে। মলে গিয়ে তাঁরা দেখলেন, ঝাঁ চকচকে স্টল রয়েছে ওই সংস্থার। সপ্রতিভ কর্মীরা তাঁদের হাতে একটা মাঝারি সাইজের উপহারের প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন। তবে এ-ও বললেন, এটা নিছকই নিয়মরক্ষার উপহার। আসলে তাঁরা পাচ্ছেন বিশেষ একটি বেড়ানোর প্যাকেজ! পাঁচতারা বন্দোবস্ত। আলাদা কোনও খরচা লাগবে না। সবই ওই প্যাকেজ থেকে।
তবে হ্যাঁ, প্যাকেজটা নিখরচায় পাওয়া যাবে না!
তা হলে এ কেমন পুরস্কার? কর্মীরা বোঝালেন, লটারিতে যাঁদের নাম উঠেছে, শুধু তাঁরাই ন্যায্য মূল্যে এমন ‘লোভনীয়’ প্যাকেজ বেছে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। আসল পুরস্কার তো সেটাই! পাঁচ কিংবা দশ বছরের একটা প্যাকেজ শুধু বেছে নিতে হবে হবে। প্যাকেজ অনুযায়ী একটা থোক টাকা গোড়াতেই জমা দিতে হবে। এর পর সেই টাকা ভাঙিয়েই প্রতি বছর টানা দিন দশেক করে ঘোরার সুযোগ।
তা হলে তো ভ্রমণের সুবর্ণ সুযোগ বাঙালির কাছে! কিন্তু এ ক্ষেত্রে ক্রেতা সুরক্ষা দফতরে জমা পড়া অভিযোগের দিস্তে অন্য কথা বলছে। একাধিক পরিবারের দাবি, তাঁরা টাকা দিয়েছেন, অথচ বেড়ানোর কথা তুললেই টালবাহানা করে এড়িয়ে গিয়েছে ভ্রমণ সংস্থা। মাঝখান থেকে কেউ খুইয়েছেন কেউ লক্ষাধিক টাকা, কেউ প্রায় ৭০ হাজার। ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের একটি সূত্র বলছে, ‘কান্ট্রি ভ্যাকেশনস’ নামে এক ভ্রমণ সংস্থার বিরুদ্ধে এমন শ’খানেক অভিযোগ জমা পড়েছে। তবে কার্যত কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অভিযোগ এসেছে পুলিশের কাছেও। কিন্তু কোনও গ্রেফতারের খবর নেই।
আপাতত ‘কান্ট্রি ভ্যাকেশনস’-এর নাম সামনে এলেও এমন লোভনীয় টোপ দিয়ে লগ্নি করানোর ব্যবসা আরও বহু সংস্থারই রয়েছে বলে ক্রেতা সুরক্ষা দফতর ও পুলিশের একাংশের বক্তব্য। গত কয়েক বছর ধরে কর্পোরেট ভ্রমণ সংস্থার সংখ্যা বাড়ছে। ভ্রমণ-প্যাকেজে এক দফায় লগ্নিও করায় এই সংস্থাগুলি। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর শিল্প সম্মেলনেও কয়েকটি ভ্রমণ সংস্থা ছিল। রাজ্য সরকারের নানা পর্যটন প্রকল্পেও তাদের অংশীদারিত্ব রয়েছে। অনেকেই বলছেন, এ ধরনের নামী সংস্থার সঙ্গে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা খারাপ নয়। কিন্তু বেড়ানোর টোপ দিয়ে লোক ঠকানোর কারবারেও নেমে পড়েছে অনেকে। কলকাতা পুলিশের এক গোয়েন্দা কর্তার মতে, অনেকটা একই কায়দায় টাকা তুলত সারদা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস।
কী ভাবে ছড়িয়েছে এই প্রতারণার জাল? অনেকেই জানাচ্ছেন, বিভিন্ন শপিং মল বা বাজারে এই সব সংস্থার কর্মীরা ঘুরে ঘুরে লোকেদের নাম ও ফোন নম্বর জোগাড় করেন। হাতে ধরিয়ে দেন কুপন। তার পর তাঁদের ফোন করে পুরস্কারের টোপ দিয়ে অফিসে ডেকে পাঠানো হয়।
‘কান্ট্রি ভ্যাকেশনস’-এ লগ্নি করা একটি পরিবারের অভিযোগ, প্রথমে ডেকে পাঠিয়ে তাঁদের একটি ডিনার সেট দেওয়া হয়। তার পর পাঁচ বছরের বেড়ানোর প্যাকেজ বিক্রি করে ৭০ হাজার টাকা নেওয়া হয়। বলা হয়েছিল, ওই সংস্থার নিজস্ব পাঁচতারা রিসর্টে রাখা হবে। গাড়ির ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু সদস্য হওয়ার পর কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা বললেই সংস্থাটি নানা ছুতোয় এড়িয়ে যেত। বলা হতো, ওই তারিখে রিসর্ট খালি নেই। ইতিমধ্যে ওই পরিবারের কর্তা মারা যান। বিরক্ত হয়ে পরিবারটি সদস্যপদ খারিজ করে টাকা ফেরতের দাবি জানালে সংস্থার তরফে বলা হয়, এমন নিয়ম তাদের নেই।
পরিবারটির এক সদস্যার কথায়, “প্রতারিত হচ্ছি বুঝে ক্রেতা সুরক্ষা দফতরে গিয়েছিলাম। কিন্তু সুরাহা হয়নি।” শুধু এই পরিবারটিই নয়, ‘কান্ট্রি ভ্যাকেশনস’-এ টাকা জমা দিয়ে একই অভিজ্ঞতা সল্টলেকবাসী গুহ দম্পতি, উল্টোডাঙার শঙ্কর সাহা, বর্ধমানের পৌলমী আচার্যের। গুহ দম্পতি বিধাননগর (দক্ষিণ) থানায় অভিযোগ করলেও লাভ হয়নি। পেশায় ব্যবসায়ী শঙ্করবাবু ওই সংস্থায় ১ লক্ষ ৩২ হাজার টাকা রেখেছিলেন। পৌলমীদেবীর স্বামী মৃগাঙ্কমৌলি আচার্য বলছেন, “উপহার ও বেড়ানোর লোভেই টাকা রেখেছিলাম। কিন্তু এখন বুঝছি পুরোটাই ভাঁওতা।”
কেন ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ?
এ ব্যাপারে তেমন কোনও সদুত্তর মেলেনি। বিধাননগরের গোয়েন্দাপ্রধান কঙ্করপ্রসাদ বারুই বলেন, “তদন্ত চলছে। শীঘ্রই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের বক্তব্য, রোজ প্রচুর অভিযোগ জমা পড়ছে। সেগুলো একসঙ্গে করেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দফতরের মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে বলেন, “প্রচুর মানুষ প্রতারিত হচ্ছেন বলে জানতে পেরেছি। দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলেছি। ওই সংস্থাকে নোটিস পাঠানো হবে।”
কী বলছে অভিযুক্ত সংস্থা?
তপসিয়া রোডে ‘কান্ট্রি ভ্যাকেশনস-’এর অফিসে গিয়ে দেখা যায়, অনেকেই বেড়ানোর খোঁজখবর নিতে আসছেন। তাঁদের সদস্য করার জন্য নানা ভাবে বোঝানো হচ্ছে। সংস্থার কলকাতা শাখার দায়িত্বে থাকা আজহার আলি বেগ অফিসে নেই। কখন তিনি অফিসে থাকেন, কর্মীরা জানাতে পারেননি। তবে নার্গিস খান নামে এক কর্মী বলেন, “অভিযোগ যে কোনও সংস্থার বিষয়ে উঠতেই পারে। তবে আমাদের ভাল কাজই বেশি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy