পিঠে পাহাড়-প্রমাণ মালপত্র ঠাসা। কোনওটিতে সব্জির বস্তা, কোনওটিতে ইট-বালি-পাথর কিংবা সিমেন্ট। জিনিসপত্রের চাপে অতিকায় বাহনগুলি যেন চলতেই পারছে না। কোনও কোনওটি আবার পণ্যের ভারে এক দিকে বিপজ্জনক ভাবে ঝুঁকে পড়েছে। সেই অবস্থাতেই রাস্তা জুড়ে ধীর গতিতে এগোচ্ছে তারা।
ওরা মালবাহী ট্রাক। গভীর রাতে রাজ্যের বড় বড় সড়কে এমন পেল্লাই ট্রাকের ভিড় খুবই চেনা দৃশ্য।
পরিবেশ এবং সড়ক বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এমন ‘ওভারলোডেড’ বা অতিরিক্ত ভার নেওয়া ট্রাকের জন্য রাজ্যের ক্ষতি হয় অনেক দিক থেকে। প্রথমত, রাজস্বের ক্ষতি হয়। দ্বিতীয়ত, ক্ষতি হয় রাস্তারও। তৃতীয়ত, দূষণ বাড়ে। চতুর্থত, রাস্তায় যানবাহনের গতি অনেক কমে যায়। এত কিছু ক্ষতি হয় শুধু অতিকায় ট্রাকগুলো অতিরিক্ত মালপত্র তোলে বলেই। বছরের পর বছর আইন ভেঙে এ ভাবে বাড়তি জিনিসপত্র বহন চলছে। কিন্তু ওভারলোডেড ট্রাক নিয়ে রাজ্য সরকার উদাসীন। এই বিষয়ে সরকারের কাছে বারবার অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও কোনও কাজ হয়নি।
আইনে অবশ্য শাস্তির ব্যবস্থা আছে। মোটরযান আইনের ১১৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে অতিরিক্ত মালপত্র বহন করলে ন্যূনতম দু’হাজার টাকা জরিমানা দিতে হয়। তার পরে প্রতি টন পণ্যের জন্য জরিমানার পরিমাণ এক হাজার টাকা করে বাড়ে। কিন্তু ট্রাক-মালিকেরা ওই আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে বেশি জিনিসপত্র ট্রাকে তোলেন। উদ্দেশ্য একটাই, পণ্যমাসুল ফাঁকি দেওয়া।
ব্যবস্থা নেওয়া হয় না কেন?
পরিবহণ দফতর সূত্রের খবর, রোজ রোজ হাজার হাজার ট্রাক এ রাজ্যে অতিরিক্ত পণ্য নিয়ে ঢুকলেও তা পরীক্ষা করার কোনও ব্যবস্থাই নেই। পরিবহণ দফতরের এক কর্তার কথায়, “ওভারলোডেড ট্রাক ধরার জন্য যে-পরিকাঠামো দরকার, রাজ্যের কোথাও তা নেই। চেকপোস্টে ওজন মাপার যন্ত্র নেই। পরিবহণ দফতরের পর্যবেক্ষক নেই। ফলত, কোনও ট্রাককেই ধরা হয় না।” একই সঙ্গে ওই কর্তা কবুল করেছেন, কোনও কোনও জায়গায় কিছু কিছু পরিকাঠামো থাকলেও মাপামাপির কাজটা ঠিকমতো হয় না। যেখানে পরিবহণ দফতরের পরিকাঠামো নেই, সেখানে পুলিশ এ কাজ করতে পারে। কিন্তু ওভারলোডেড ট্রাক ধরার জন্য রাজ্য পুলিশও বিশেষ উদ্যোগী নয়। এ ক্ষেত্রে বহু ‘ধর্মকাঁটা’ বা মাপন কেন্দ্রে দুর্নীতি চলে বলেও অভিযোগ করেন ওই পরিবহণকর্তা। তিনি জানান, বিভিন্ন ধর্মকাঁটায় যেটুকু পরিকাঠামো আছে, তার সাহায্যে ট্রাকে বাড়তি পণ্য বহনে রাশ টানা যায়। কিন্তু সেখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে টাকার বিনিময়ে রফা হয়ে যায়।
ট্রাক বাড়তি পণ্য বহন করলে রাজস্বের কী ভাবে কতটা ক্ষতি হয়?
পরিবহণ দফতরের কর্তারা জানান, অতিরিক্ত মালপত্র বহনের জন্য সব চেয়ে বেশি ক্ষতি হয় রাজ্যের কোষাগারেরই। ওই দফতরের একটি সমীক্ষা বলছে, প্রতিদিন এ রাজ্যে অন্তত ২০ হাজার ওভারলোডেড ট্রাক ঢোকে। তারা বাড়তি পণ্য না-নিলে ট্রাকের সংখ্যা আরও বাড়ত। তাদের কাছ থেকেও রাজস্ব পেত রাজ্য। ওভারলোডেড ট্রাক না-ধরার প্রত্যক্ষ ক্ষতি এটা। অসংখ্য ট্রাককে যথেচ্ছ জিনিসপত্র তুলে বিনা বাধায় চলাচল করতে দেওয়ায় পরোক্ষেও প্রচুর ক্ষতি হয় রাজস্বের। অতিরিক্ত পণ্যবাহী ট্রাকের ভারে রাস্তা দ্রুত খারাপ হয়ে যায়। সরকারকে তখন অতিরিক্ত টাকা খরচ করে রাস্তা মেরামত করতে হয়।
ক্ষতি আছে আরও। সাধ্যের অতিরিক্ত জিনিসপত্র তোলায় ট্রাকের গতি কমে যায়। বাড়তি ভারের জন্যই বেশির ভাগ সময় ওই সব ট্রাক সেকেন্ড গিয়ারে চালাতে হয়। এতে পরিবেশ-দূষণ বাড়ে বলে জানান পরিবহণ-কর্তারা। পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত বলেন, “ওভারলোডেড ট্রাক পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে। সব চেয়ে বেশি ক্ষতি হয় ধোঁয়া থেকে। ওই সব ট্রাক ধোঁয়া বেশি ছাড়ে। ফলে বায়ুদূষণ বাড়ে। শব্দদূষণও হয়। মূলত ওভারলোডেড ট্রাকই রাতে দূষণের মাত্রা বাড়ায়।” সুভাষবাবু জানাচ্ছেন, অনেক দিন আগেই সুপ্রিম কোর্ট ওভারলোডিং বন্ধ করতে বড় বড় সড়কে ওজন মাপার যন্ত্র বসানোর নির্দেশ দিয়েছে। বাড়তি জিনিসপত্র থাকলে ট্রাক থেকে সেগুলো নামিয়ে দেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত। কিন্তু এ রাজ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই নির্দেশ বাস্তবায়িত হয়নি বলে অভিযোগ ওই পরিবেশকর্মীর।
কী বলছে ট্রাক সমিতি?
রাজ্যের ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতা শ্যামল দাস জানান, যে-সব ট্রাক একাধিক রাজ্যের মধ্যে চলাচল করে, সেগুলোর ক্ষেত্রে ওভারলোডিংয়ের সমস্যা কম। যে-সব ট্রাক রাজ্যের মধ্যে চলে, সেগুলোতেই ওভারলোডিং বেশি হয়। একই বক্তব্য ফেডারেশন অব ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রাক অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশনের। সংগঠনের নেতা সত্যজিৎ মজুমদার বলেন, “বেশির ভাগ রাজ্যে ইতিমধ্যেই ট্রাকে ওভারলোডিং বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আমরা রাজ্য সরকারের কাছে বারবার আবেদন জানিয়েছি। সরকার প্রতি বারেই আশ্বাস দেয়। কিন্তু কোনও সুরাহা হয়নি।
ট্রাক সমিতি ব্যবস্থা নেয় না কেন?
ট্রাক সংগঠনের নেতারা জানান, তাঁদের পক্ষে বাড়তি পণ্য বহন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তাঁরা অতিরিক্ত পণ্য নিতে অস্বীকার করলে আর কোনও কাজই পাবেন না। নিয়মবিধি রূপায়ণ করতে পারে শুধু প্রশাসনই।
প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন?
কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। তিনি বলেন, “আমরা এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়েছি। ভোটের জন্য সেটা স্থগিত রয়েছে। ভোটের পরে আমরা এই নিয়ে রাস্তায় নামব। ওভারলোডেড ট্রাকের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে সরকার বদ্ধপরিকর।”
লোকসানের বহর
• রাজস্বের ক্ষতি হয়।
• ক্ষতি হয় রাস্তার।
• দূষণ বাড়ে।
• যানবাহনের গতি কমে যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy