নাইটদের দেখতে উন্মত্ত দৌড় জনতার। মঙ্গলবার ইডেনের বাইরে। ছবি: শৌভিক দে
বেলা আড়াইটে। ইডেনের সামনে এসে দাঁড়াল কেকেআর-এর বাস।
বাইরে তখন হাজারো জনতার তুমুল চিৎকার। সকলের দাবি: ভিতরে ঢুকতে দিতে হবে। বাঁশের ব্যারিকেডও ভাঙো-ভাঙো। অবস্থা দেখে চার নম্বর গেটের সামনে জনতার দিকে লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে গেল ঘোড়সওয়ার পুলিশ। উত্তেজিত জনতা জবাব দিল ঢিল ছুড়ে। পুলিশের পাল্টা লাঠিচার্জ। পালাতে গিয়ে ছিটকে পড়লেন অনেকে। লাঠির ঘায়ে এক যুবকের মাথা থেকে তখন গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। ধাক্কাধাক্কিতে এক পুলিশও পড়ে গেলেন ঘোড়া থেকে।
বেলা পৌনে চারটে। ইডেনের বাইরে তখনও ক’হাজার লোক। হঠাৎ রটে গেল, শাহরুখ খান পার্ক সার্কাস পার হয়েছেন। শুনেই গোষ্ঠ পাল সরণির দিক থেকে হাজার মানুষের দৌড়, লক্ষ্য চার নম্বর গেট। ক্লাব হাউসের পাশে এই গেট দিয়ে ঢুকলেই তারকাদের সব চেয়ে কাছ থেকে দেখা যাবে বলে মনে করেছিল জনতা। ফলে ভিড়ের ধাক্কায় ছিটকে গেল লোহার গার্ডরেল। রাস্তায় পড়ে গেলেন মহিলা-শিশু-সহ অনেকে, তাঁদের উপর দিয়েই দৌড়োলেন বাকিরা। গেটের সামনে পুলিশ তাঁদের আটকাল।
আর তখনই ইডেনের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। পুলিশকে নির্দেশ দিলেন, ‘‘ওঁদের ভিতরে ঢুকতে দিন।” মন্ত্রীর নির্দেশ শুনে ইডেনের চার নম্বর গেট খুলে সকলকে ঢুকিয়ে নেওয়া হল।
দুপুর দেড়টা নাগাদ প্রায় একই নির্দেশ দিয়েছিলেন যুবকল্যাণমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। ক্লাব হাউস গেটের সামনে এসে তিনি দেখেন, ব্যারিকেডের বাইরে হাজার হাজার লোক। এক পুলিশ অফিসারকে তিনি বলেন, “আমি মন্ত্রী বলছি। ভিতরে প্রচুর আসন ফাঁকা। ওঁঁদের ঢুকতে দিন।” কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার জবাব দেন, “স্যার, ভিতর থেকে ওয়াকিটকিতে বলছে, ওভারক্রাউডেড। কী করব?” মন্ত্রী বলেন, “সিপি কোথায়? কথা বলছি। ওঁদের ভিতরে ঢুকতে দিন।” অরূপবাবুর নির্দেশ মেনেও কিছু লোককে ঢুকতে দেওয়া হয় মাঠে।
পুলিশের একাংশের বক্তব্য, এ দিন সকাল থেকেই ইডেনের বাইরে ভিড় জমিয়েছিল উৎসাহী জনতা। তাঁদের অনেকের কাছেই প্রবেশপত্র ছিল না। কিন্তু শাসক দলের একাধিক নেতা-মন্ত্রী তখন থেকেই দফায় দফায় পুলিশকে নির্দেশ দেন, পাশ থাক বা না-থাক, সকলকেই ঢুকতে দিতে হবে। সেই নির্দেশ মানাও হয়। এমনিতেই অতি উৎসাহী জনতাকে নিয়ে নাজেহাল ছিল পুলিশ। এ বার মন্ত্রীদের নির্দেশে আরও শিথিল হয়ে পড়ে পরিস্থিতির উপরে তাদের নিয়ন্ত্রণ।
কিন্তু মন্ত্রীর নির্দেশে পুলিশ কেন বাঁধন আলগা করল? কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্রের ব্যাখ্যা, “মন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের ইন্টারন্যাল সেক্টরের নিশ্চয়ই কথা হয়েছিল। তার পরে ভিতর খালি দেখে লোক ঢোকানো হয়েছে।”
লালবাজারের একটি সূত্র বলছে, শাহরুখ-সহ কেকেআর টিমকে দেখার আগ্রহে ইডেনের লোয়ার টিয়ারেই ভিড় জমিয়েছিল অধিকাংশ জনতা। আপার টিয়ারে কিছু দর্শককে ঠাঁই করে দেওয়ার উপায় থাকলেও সেখানে যাওয়ার পথ আটকে বসে পড়েছিলেন অনেকে। এই অবস্থায় আরও লোক মাঠে ঢুকতে দিলে পদপিষ্ট হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল গেট। কিন্তু মাঠের বাইরে তখন বৈধ পাশ হাতে অসংখ্য মানুষ। তাঁদের সঙ্গে পুলিশের তর্কাতর্কিতে হাওয়া গরম হয়েছে। যা গড়িয়েছে ধাক্কাধাক্কি, ইট-পাটকেল ছোড়া এবং পুলিশের লাঠিচার্জে।
বেলা আড়াইটে নাগাদ ঢিলের আঘাতে এক জনের মাথা ফাটে। মিলন দাস নামে ওই যুবককে পুলিশ ধরে সিএবি অফিসে নিয়ে যায়। তখনই দেখা যায়, এক কিশোর কাঁদতে কাঁদতে ক্লাব হাউসে ঢুকছে। তারও মাথা ফাটা, রক্ত ঝরছে কানের পাশ দিয়ে। তার অভিভাবক জানালেন, পুলিশের লাঠিতে এই হাল।
বস্তুত এই ঘটনার একটু আগেই একটি টাটা সুমো বোঝাই করে লাঠি এবং হেলমেট নিয়ে আসতে দেখা যায় পুলিশকে। রাজীববাবুর অবশ্য দাবি, উত্তেজিত জনতাকে সরাতে পুলিশ লাঠি নিয়ে তেড়ে গেলেও লাঠিচার্জ করেনি। তাঁর অভিযোগ, ব্যারিকেড ভাঙার পাশাপাশি জনতা পুলিশকে লক্ষ করে ইট ছুড়ছিল। অকল্যান্ড রোডে ভিড় ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে আসে। ধাক্কাধাক্কিতে ডিসি (রিজার্ভ ফোর্স) অশোক বিশ্বাস জখম হন, তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। চার-পাঁচ পুলিশকর্মীও আহত হন।
উন্মত্ত জনতাকে সামলাতে ঘোড়সওয়ার পুলিশও নেমেছিল ছড়ি হাতে। উল্টোডাঙা দাসপাড়ার বাসিন্দা শ্যামল সরকারের মাথা ফেটে যায় ঘোড়ার লাথিতে। কিছু লোক তাঁকে পায়ে মাড়িয়ে দৌড়তে থাকেন। পরে প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হওয়ায় শ্যামলবাবুকে এসএসকেএমে নিয়ে যাওয়া হয়। পালাতে গিয়ে চার নম্বর গেটের কাছে পড়ে যান বারাসতের সায়ন মিত্র। চার-পাঁচ জন ঘাড়ে এসে পড়ায় তিনি গুরুতর জখম হন। হাসপাতালে পাঠাতে হয় তাঁকেও। গণ্ডগোল দেখে বাইরে বেরিয়ে আসেন খোদ পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থ। এই অবস্থা কেন? সিপি’র জবাব, “জোগানের চেয়ে চাহিদা অনেক বেশি ছিল। তাই সব থানায় পর্যাপ্ত টিকিট দেওয়া যায়নি। এটাই কারণ।” কিন্তু প্রবেশপত্র থাকতেও অনেকে ঢুকতে পারলেন না কেন?
এর সরকারি ব্যাখ্যা কোনও কর্তার কাছেই মেলেনি। যদিও একান্তে তাঁদের কেউ কেউ বলেছেন, মন্ত্রীরা বারবার লোক ঢোকানোর নির্দেশ না-দিলে লালবাজারের গায়ে এমন কালির দাগ লাগত না। মন্ত্রীদের কী বক্তব্য?
নেতা-মন্ত্রীরা অবশ্য বিশৃঙ্খলাকে সে ভাবে গুরুত্ব দিতে নারাজ। ফিরহাদ যেমন বলেন, “একটা লোক পড়ে গিয়েছে, চারটে চটি পড়ে রয়েছে শুধু এ সব না-দেখিয়ে গোটা বাংলার, কলকাতার ছবি দেখান। বাইরে দশ জন হয়তো পড়ে গিয়েছেন। কিন্তু ভিতরে ৬৫ হাজারের বেশি মানুষ আনন্দ করছেন। সেটা দেখান। খালি আমার পিছনটা না-দেখিয়ে মুখটা দেখান।” ঘটনা হল, এ দিন যে এমন বিশৃঙ্খলা হতে পারে, তার আগাম আশঙ্কা ঘনিষ্ঠ মহলে কিন্তু প্রকাশ করে রেখেছিলেন লালবাজারের এক কর্তা। এ দিন রাতে যাঁর প্রতিক্রিয়া, “এ জন্যই আমি মনে-প্রাণে চাইছিলাম, নাইট রাইডার্স হারুক। কারণ, বিজয় সংবর্ধনার অব্যবস্থা সামাল দেওয়ার সাধ্য আমাদের নেই।”
রক্তারক্তি-ধাক্কাধাক্কি মিলে নাইট বরণের অনুষ্ঠান নিয়ে যতই বিতর্ক হোক, শাহরুখ একে তাঁর দলের প্রতি ‘কলকাতাবাসীর ভালাবাসার’ নির্দশন হিসেবেই দেখছেন। গাড়িতে ওঠার আগে তিনি বলে গেলেন, “থোড়া প্যার পানে কে লিয়ে থোড়া সা ধাক্কা খানা পড়তা হ্যায়।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy