Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪

নগদ কারবারেই সারদায় লুঠের বোলবোলাও, উধাও ৬০০ কোটি

আমানতকারীদের থেকে বেশির ভাগ আদায়ই হতো নগদে। আর সেই টাকার মাত্র সাত শতাংশ জমা পড়ত ব্যাঙ্কে! বাকি ৯৩% নগদ দিয়েই চলত যাবতীয় কারবার! সারদা-কেলেঙ্কারি নিয়ে ফরেন্সিক অডিটের অন্তর্বর্তী রিপোর্টে এমনটাই দাবি করা হয়েছে। সপ্তাহ দুয়েক আগে সেবি-র কাছে জমা পড়েছে সেই রিপোর্ট। তাতে বলা হয়েছে, নগদ লেনদেনের একটি বড় অংশের কোনও হিসেব নেই। টাকার অঙ্কে যা ৫৯২ কোটি।

কে বলবে, ফ্ল্যাটটা বছরখানেক ধরে বন্ধ! সিলিংয়ে ঝুল নেই, মেঝেয় ধুলো নেই। বৃহস্পতিবার এফডি ব্লকে সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেনের ফ্ল্যাটে ঢুকে তাজ্জব ইডি। পুলিশ ফ্ল্যাট সিল করে রেখেছিল। তাও এত সাফসুতরো কী করে রইল সব, বুঝতে পারছেন না ইডি-র অফিসাররা। ছবি: শৌভিক দে

কে বলবে, ফ্ল্যাটটা বছরখানেক ধরে বন্ধ! সিলিংয়ে ঝুল নেই, মেঝেয় ধুলো নেই। বৃহস্পতিবার এফডি ব্লকে সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেনের ফ্ল্যাটে ঢুকে তাজ্জব ইডি। পুলিশ ফ্ল্যাট সিল করে রেখেছিল। তাও এত সাফসুতরো কী করে রইল সব, বুঝতে পারছেন না ইডি-র অফিসাররা। ছবি: শৌভিক দে

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:০৩
Share: Save:

আমানতকারীদের থেকে বেশির ভাগ আদায়ই হতো নগদে। আর সেই টাকার মাত্র সাত শতাংশ জমা পড়ত ব্যাঙ্কে! বাকি ৯৩% নগদ দিয়েই চলত যাবতীয় কারবার! সারদা-কেলেঙ্কারি নিয়ে ফরেন্সিক অডিটের অন্তর্বর্তী রিপোর্টে এমনটাই দাবি করা হয়েছে। সপ্তাহ দুয়েক আগে সেবি-র কাছে জমা পড়েছে সেই রিপোর্ট। তাতে বলা হয়েছে, নগদ লেনদেনের একটি বড় অংশের কোনও হিসেব নেই। টাকার অঙ্কে যা ৫৯২ কোটি। সারদার খাতায় এই খরচকেই ‘প্রশাসনিক ও বিবিধ’ বলে দেখানো হয়েছে। অডিটে ইঙ্গিত, সারদার টাকা নয়ছয় হওয়ার যে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে, তা ওই খরচকে ঘিরেই। কী কারণে ও কাদের জন্য এই খরচ হয়েছে, তা খতিয়ে দেখে তারা চূড়ান্ত রিপোর্ট দেবে বলে জানিয়েছে ফরেন্সিক অডিট সংস্থাটি।

সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে নেমে হায়দরাবাদের শরৎ অ্যাসোসিয়েট্স নামে একটি ফরেন্সিক অডিট সংস্থাকে যৌথ ভাবে নিয়োগ করেছিল সেবি ও বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেট। সংশ্লিষ্ট সংস্থার হিসেবপত্র খতিয়ে দেখে আর্থিক জালিয়াতির সূত্র সন্ধান করার কাজেই বিশেষজ্ঞ ফরেন্সিক অডিট সংস্থাগুলি। এর আগে টুজি কেলেঙ্কারি, সত্যম কেলেঙ্কারি এবং হর্ষদ মেটার জালিয়াতির ক্ষেত্রেও এই ধরনের ফরেন্সিক অডিট সংস্থাকে কাজে লাগানো হয়েছিল।

হায়দরাবাদের সংস্থার প্রাথমিক রিপোর্ট নিয়ে কমিশনারেটের এক কর্তা এ দিন বলেন, “আপাতত সারদার ব্যাঙ্কিং লেনদেন সংক্রান্ত বিষয়ে যাবতীয় তথ্য পাওয়া গিয়েছে। চূড়ান্ত রিপোর্টে বেহাত হওয়া টাকা হাওয়ালা বা হুন্ডির মাধ্যমে কোথাও চালান হয়েছে কি না, জুলাই মাসের মধ্যে তা জানাবে ওই সংস্থা।”

ফরেন্সিক অডিট রিপোর্টে কী পাওয়া গিয়েছে?

সেবি সূত্রের খবর, সাফারি নামে একটি মার্কিন-সফটওয়্যারের মাধ্যমে টাকার হিসেব রাখত সারদা। সেই সফটওয়্যার থেকে প্রাপ্ত তথ্য, সারদার ১৬৪টি কোম্পানির হিসেব, ২২০টি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খতিয়ে দেখে এবং নানা স্তরের কর্মী এবং এজেন্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করে অডিট সংস্থাটি জেনেছে, সব মিলিয়ে ২৪৬০ কোটি টাকা তুলেছে সারদা। জানা গিয়েছে, এর মধ্যে ৪৭৫ কোটি টাকা মেয়াদ শেষে আমানতকারীদের ফেরত দেওয়া হয়। ৮২০ কোটি টাকা খরচ হয় এজেন্টদের কমিশন দিতে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম চালাতে ৩৯০ কোটি টাকা খরচ করেন সুদীপ্ত সেন। এ ছাড়া, বিভিন্ন সম্পত্তি ও প্রকল্প কেনার অগ্রিম বাবদ ১৮৩ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এর বাইরে প্রায় ৫৯২ কোটি টাকা খরচের কোনও হিসেবই পায়নি অডিট সংস্থাটি।

সারদার টাকা কোথায় গিয়েছে তা খোঁজ করতে রাজ্য সরকারের তৈরি স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম বা সিট এবং কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি যে তদন্ত করেছে, তার থেকেও বেরিয়ে এসেছে চমকপ্রদ সব তথ্য।

ইডি সূত্রে যেমন ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসের একটি দিনের ঘটনার কথা জানা যাচ্ছে। সে দিন সল্টলেকের মিডল্যান্ড পার্কে সারদার সদর দফতরে সুদীপ্ত সেনের ঘরের সুইং ডোর ঠেলে ঢোকেন এক সাংসদ-নেতা। তাঁর তাড়া ছিল। ফলে তিনি বসেননি। এমনকী ঘরে যে সুদীপ্ত ছাড়াও আরও এক জন রয়েছেন, সেটাও খেয়াল করেননি। নির্দ্বিধায় স্ট্যাম্প পেপারে ছাপানো চুক্তিপত্র সুদীপ্তবাবুর টেবিলে রেখে সেই নেতা বললেন, এটাতে সই করতে হবে। কাগজে চোখ বুলিয়ে হতবাক সুদীপ্তবাবু। কয়েকশো কোটি টাকা লগ্নির চুক্তিপত্র। সুদীপ্ত বলেন, এত টাকা বিনিয়োগ করার আগে এক বার আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতে চাই।

সাংসদ-নেতা দৃশ্যতই বিরক্ত। মোবাইল ফোন বার করে বলেন, তা হলে দাদাকে (দলে তাঁর থেকে বড় এক সাংসদ-নেতা) ফোন করে জানিয়ে দিই, আপনি এখন সই করছেন না! বড় নেতার নাম শুনে আমতা আমতা করতে থাকেন সুদীপ্তবাবু। বলার চেষ্টা করেন, সই করব না বলছি না। ভেবে দেখতে কয়েক দিন সময় চাইছিলাম। তাঁকে থামিয়ে দিয়ে সেই নেতার উক্তি, এত সময় দেওয়া যাবে না। চাপের মুখে সে দিন চুক্তিপত্রে সই করতে বাধ্য হন সুদীপ্ত। সারদা-কর্তার ঘরে উপস্থিত সেই তৃতীয় ব্যক্তিকে (সারদার উচ্চপদে আসীন এক কর্মী) সম্প্রতি জেরা করে এই তথ্য জেনেছে ইডি।

ইডি সূত্রে বলা হচ্ছে, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ইতিমধ্যেই তারা ৭০ জনকে নোটিস পাঠিয়েছে। এঁদের মধ্যে যেমন সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে কাজ করা সারদা গোষ্ঠীর একাধিক কর্মী, রয়েছেন, তেমনই রয়েছেন রাজনৈতিক নেতা, সাংসদ, শিল্পী, লোকসভা ভোটের প্রার্থী, ক্রীড়া সংগঠক এবং আরও কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি।

এই জেরা পর্ব থেকে নিত্যদিন নতুন নতুন তথ্য পাচ্ছেন তদন্তকারীরা। কী ভাবে সংস্থারই কিছু কর্মী এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের একাধিক নেতা-নেত্রী দিনের পর দিন টাকা নিয়ে গিয়েছেন সারদা-কর্তার কাছ থেকে, কর্মীরা তা জানিয়েছেন। যেমন এক কর্মী জানিয়েছেন, যে সাংসদ সে দিন সুদীপ্তকে দিয়ে চুক্তিপত্র সই করিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর ‘নিজস্ব লোক’ রাখা ছিল সারদা অফিসে। মোটা অঙ্কের টাকা ঢুকলেই খবর পৌঁছে যেত তাঁর কাছে। সঙ্গে সঙ্গেই ফোন আসত সুদীপ্তর কাছে, এখনই এত টাকা দিতে হবে। জানা গিয়েছে, এক সময় সারদার অফিসারদের জন্য ১৬টি বড় এসইউভি গাড়ি কিনেছিলেন সুদীপ্ত। নির্দেশ মতো তার মধ্যে দু’টি পাঠিয়ে দিতে হয়েছিল এক মন্ত্রীর কাছে।

এ পর্যন্ত সারদার যে সব কর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ইডি, তাঁদের বেশির ভাগেরই দাবি, এক দিকে যেমন লোভ দেখিয়ে, ভয় দেখিয়ে সুদীপ্তর কাছ থেকে কার্যত লুঠ করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা। অন্য দিকে তেমনই পরিকল্পনাহীন, বেলাগাম খরচ করে গিয়েছেন সারদাকর্তাও।

সুদীপ্ত কতটা বেহিসেবি ছিলেন, তার উদাহরণ দিয়ে এক কর্মী ইডি-কে জানিয়েছেন, সংস্থার কর্মী-অফিসারদের যাতায়াতের জন্য ২৫০টি গাড়ি কিনেছিলেন তিনি। তা ছাড়াও ১৫০টি ভাড়া গাড়ি ছিল। এক দিন আচমকা ২০টি ছোট বাসের কাঠামো কিনে ফেলেন সুদীপ্ত সেন। উদ্দেশ্য ছিল, কর্মীদের যাতায়াতের জন্য বাস বানাবেন। এক দিন সুদীপ্ত তাঁকে বলেন, বিষ্ণুপুরে সারদা গার্ডেনে গিয়ে বাসের কাঠামোগুলি দেখে আসতে। তিনি গিয়ে দেখেন, ২০ নয়, রয়েছে ১৮টি বাসের কাঠামো। বাকি দু’টির খোঁজ শুরু হয়। পরে অবশ্য তার হদিসও মেলে।

তদন্তকারীরা জেনেছেন, সারদার প্রায় সাড়ে তিন হাজার কর্মী প্রতিদিন দুপুরে নিখরচায় পেটভরা ভাত-ডাল-তরকারি খেতেন। সারদা-কর্তা অন্য রাজ্যে থাকাকালীন জরুরি কারণে কোনও চেক সই করানোর দরকার হলে কোনও কর্মী বিমানে চলে যেতেন সেখানে। চেক সই করিয়ে বিমানেই ফিরতেন কলকাতায়।

ইডি সূত্রের খবর, সুদীপ্তর সঙ্গে ধৃত দেবযানী মুখোপাধ্যায়ও বিপুল পরিমাণ টাকা নিয়ে যেতেন বলে এক কর্মী জানিয়েছেন। ওই কর্মীর দাবি, দেবযানী প্রতিদিন দু’টি ব্যাগ নিয়ে অফিসে আসতেন। একটিতে থাকত তাঁর ব্যবহারের জিনিসপত্র, অন্যটি খালি। খালি ব্যাগটি আয়তনে বড়। দিনের শেষে টাকা ভর্তি হয়ে ফিরত সেটি। একাধিক কর্মী ইডি-কে জানিয়েছেন, এক প্রাক্তন পুলিশ কর্তা (যিনি বর্তমানে রাজনীতিক) প্রতি মাসে এক লক্ষ টাকা নিতেন। তার বদলে তিনি সারদাকে কখনও স্টোন চিপস, কখনও বালি সরবরাহ করেছেন বলে বিল পাঠিয়ে দিতেন। বাস্তবে যদিও সেই সমস্ত সামগ্রীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি!

অন্য বিষয়গুলি:

ed sardha case
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy