অজগাঁয়ে
দেবতার সন্ধানে
খড়্গেশ্বরী, শিবাখ্যা, শ্যামারূপা, রাঢ়েশ্বর, বুড়োরায় বা অখিলেশ্বরী। স্থানে-অস্থানে ছড়িয়ে থাকা এই সব লৌকিক দেবদেবীদের কত জনই বা চেনেন?
যেমন গোহগ্রামে দালান মন্দিরে রাধা দামোদর বিগ্রহের যে একটি কাঠের সিংহাসন তথা পালকি রয়েছে, সে খবর কে-ই বা রাখে? সেই পালকিও অনেক দিন লোকচক্ষুর আড়ালে। এই মন্দিরটি বিরল শিখর দেউল রীতিতে তৈরি। তার গায়ের পোড়ামাটির কাজও বিখ্যাত। এখানেই গ্রামদেবী মা ভগবতীর গাজনের রীতি বহু প্রাচীন।
চম্পাইনগরীর রামেশ্বর শিবমন্দির ঘিরে মেলা বসে শ্রীপঞ্চমীতে। কিন্তু প্রায় ভুলেই যাওয়া হয়েছে, গৌরাঙ্গপুরে ইছাই ঘোষের প্রতিষ্ঠিত শ্যামারূপার গড় বা রাঢ়গ্রামের বাংলায় বিরল রাঢ়েশ্বরের সপ্তরথ শিবমন্দিরের কথা। শ্যামারূপার মন্দিরে জয়দেব এসেছিলেন বলে কথিত। এই রাঢ়গ্রামেই রয়েছে অখিলেশ্বরীর ভগ্ন মূর্তি। তার দু’পাশে দু’টি কলাগাছ। মাথার উপরে ছত্র ধরে সাতটি ফণা। পাদপীঠে হস্তিমূর্তি। দিগনগরেও রয়েছে অখিলেশ্বরীর মূর্তি। পুজো হয় বটের নীচে। অর্ধনারীশ্বরের একটি মূর্তিও রয়েছে এই গ্রামে।
বনকাটিতে আবার রয়েছে গোপালেশ্বর, উমেশেশ্বর, কালীশ্বর শিবমন্দির। শোনা যায়, গালা ব্যবসায় মাত্র এক দিনের লাভ থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে সুবিশাল গোপালেশ্বর মন্দির গড়েছিল স্থানীয় জমিদার তথা ব্যবসায়ী রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের পরিবার। এখানে রয়েছে পঞ্চরত্ন পিতলের রথ। তারাপদ সাঁতরার মতে, এইটিই বাংলার প্রাচীনতম পিতলের রথ। আবার এরুয়ারে আছে কালীর একটি পিতলের রথ।
আরও যে কত রকমের রূপ, রীতি, পুজো-পরব আছে! গলসির গর্গেশ্বর শিবমন্দিরে গাজন হয় শ্রাবণে। উড়ো-তে কালাচাঁদ বিগ্রহকে মানত করা হয় পোড়ামাটির হাতি। কৈতারায় পূজিত হন বুড়োরায়, মাড়ো গ্রামে খড়্গেশ্বরী। মানকড়ে দেখা মিলবে শ্বেতপাথরে উপবিষ্টা কষ্টিপাথরের বিরল চতুর্ভুজা কালী বিগ্রহের। অমরার গড়ে রয়েছে শিবাখ্যার মন্দির। ‘শিবাখ্যা কিঙ্কর’ নামে একটি কাব্যও এককালে রচিত হয়েছিল।
এখন প্রায় বিস্মৃত এই সব দেবদেবী ও বিভিন্ন এলাকার প্রাচীন পুণ্যচর্চার নানা রীতির সন্ধান মিলেছে বর্ধমান ইতিহাস সন্ধানের ক্ষেত্র সমীক্ষায়। বর্ধমান জেলা পরিষদের সাহায্যে এই সমীক্ষা করে তাঁরা বর্ধমান ভ্রমণ একটি বইও প্রকাশ করেছেন। যা আসলে ইতিহাস আর লোক-বিশ্বাসের গলিপথে বেড়াতে বেরোনো। এই এলাকাগুলিতে পর্যটন ভাল সম্ভাবনাও রয়েছে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা। প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আরও উপাদান সংগ্রহ ও তা প্রকাশের আশ্বাসও তাঁরা দিয়েছেন।
এ তো গেল একটি জেলার কথা। বাংলার আনাচে-কানাচে আরও কত দেবদেবী অনাদরে পড়ে রইলেন কে জানে?
সঙ্গের ছবিটি রাঢ়গ্রামের প্রস্তর রেখদেউলের।
পূর্ব পরিচিতি
মেদিনীপুর দুই জেলায় ভাগ হয়ে গিয়েছে, সে প্রায় বারো বছর হয়ে গেল। অথচ পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৌলিক তথ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ নাম-নম্বর একত্রে সংকলন করার কাজটা এতদিন সে ভাবে হয়ে ওঠেনি। সে কাজটাই শুরু করেছেন হরপ্রসাদ সাহু। “আমাদের পূর্ব মেদিনীপুর” বইটির প্রথম খন্ড বেরিয়েছে। জেলার ব্লকওয়ারি তথ্য-পরিসংখ্যান, মৌজার নাম ও জেএল নম্বর, গুরুত্বপূর্ণ মন্দির-মসজিদের বিবরণ, স্কুলের নামের তালিকা, এ সবই পাওয়া যাবে। জেলার ইতিহাস বিষয়ে, বিশেষত স্বাধীনতা সংগ্রাম বিষয়ে বইয়ের তালিকাও রয়েছে। এমন সব তথ্যের পাশাপাশি রয়েছে প্রচলিত কাহিনিও। তমলুক, ময়না, কাজলাগড়, কাশীজোড়ার ভূস্বামীদের ‘রাজকাহিনি’ রয়েছে একটি অধ্যায়ে। জেলার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের তালিকা ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় আছে। এমনকী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জেলায় আসার দিনক্ষণের তালিকাও রয়েছে। সূত্রের উল্লেখ নেই বলে তথ্যের প্রামাণ্যতা নিয়ে হয়তো খুঁতখুঁতে পন্ডিতরা প্রশ্ন তুলবেন, তবে আমজনতার হাতের কাছে এমন একটি বই থাকলে চটজলদি কাজে লাগবে বইকী। সুদৃশ্য বইটির প্রকাশক মহিষাদলের ‘বাকপ্রতিমা।’
ছন্দের ছিরি
ছন্দ কি কেবল বাংলা অনার্সের সিলেবাসে থাকবে? চেনা দৈনন্দিন থেকে চিনে নেওয়া যাবে না? রোজকার জীবনে, বিজ্ঞাপনের ছড়ায়, লোকাল ট্রেনের বিজ্ঞাপনী পদ্যে প্রতি দিন যে ছন্দের ক্লাস চলে, তাকেই ভাল করে পড়েছেন নিউইয়র্ক প্রবাসী প্রীতম বসু। কোনও দিন ক্লাসে তাঁকে ছন্দ পড়াতে হয়নি, কোনও কেঠো পাঠ্যবই পড়েও ছন্দজ্ঞান অর্জন করতে হয়নি। কবিতা লিখতে লিখতেই তিনি ছন্দ শিখেছেন। আর তাই নিয়ে পুরো গল্পের ছলে লিখে ফেলেছেন একটা ছন্দ শেখার বই। ছিরিছাঁদ নামে সেই বই প্রকাশ করল ধ্রুবপদ প্রকাশনী। প্রকাশক শিবনাথ ভদ্র আদ্যন্ত কৃষ্ণনাগরিক। সেখান থেকেই যাতায়াত করে পটলডাঙায় প্রকাশনা চালিয়ে আসছেন। প্রীতমের বইটির মুখবন্ধ ও আশীর্বাণী লিখে দিয়েছেন শঙ্খ ঘোষ ও সুধীর চক্রবর্তী।
তর্জমার তরজা
রুশ চলচ্চিত্রকার আন্দ্রেই তারকোভস্কি মনে করতেন, কোনও পাঠেরই অন্য ভাষায় সম্পূর্ণ তর্জমা সম্ভব নয়। কেননা সংস্কৃতির তর্জমা হয় না। তর্জমার ক্ষেত্রে মূল পাঠের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে থাকা দেশজ সংস্কৃতি বা আচার-ব্যবহার কতটা অনুদিত হতে পারে বা আদৌ পারে কি না, সেই সব প্রশ্ন ও সম্ভাবনার কথা নিয়েই টানা তিন দিন ধরে চর্চা হল পুরুলিয়ার সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ন্যাশনাল ট্রান্সলেশন মিশনের অর্থানুকূল্যে সেই কর্মশালার সূচনা করেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শমিতা মান্না। উপস্থিত ছিলেন বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দেবনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক দেবপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্যমন্তক দাস প্রমুখ। রাজ্যের কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও হায়দরাবাদ এবং বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও পড়ুয়ারা এসেছিলেন।
রেখার গুণে
কাঁটাতার পেরিয়ে কবি মাঝে-মধ্যে আসেন এ পারে। শব্দ-ছন্দের গুণে গুণ করেন গুণগ্রাহীদের। এ বর্ষায় তাঁকে পেল শান্তিনিকেতন। শিক্ষাব্রতী তপোবনের আদলে কাশবন নামে যে গ্রাম তিনি বাংলাদেশে গড়ে তুলেছেন, তা বিশ্বভারতীর থেকে কতটা আলাদা, সেটাই খুঁটিয়ে দেখতে এসেছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। সঙ্গে এসেছিলেন দুই চিত্রকর জামাল আহমেদ এবং রফিকুল নবি। ঘোর বর্ষার এক সন্ধ্যায় তাঁদের বরণ করে নিল স্থানীয় একটি সংস্থা। উপলক্ষ, বাইশে শ্রাবণ। নিজের বাছাই কবিতা পড়লেন ‘গুণদা’। পরের দিন খোয়াইয়ের পাড়ে আর্ট ক্যাম্পে ছবি আঁকলেন দুই আঁকিয়ে। এ পার থেকেও ছিল তুলির টান শেখর কর, মনোজ দত্ত, সুব্রতশংকর সেন, সুব্রত দাস, পুষ্পেন নিয়োগী, তপন মিত্র, সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়। প্রশ্ন কিন্তু একটাই, শান্তিনিকেতন দেখে কবির কি মন ভরল?
সঙ্গের ছবিতে কবি নির্মলেন্দু গুণ।
ডোকরার ডালপালা
আগুনের তাপে গলে যায় পিতল। তা দিয়েই তৈরি হয় অপরূপ শিল্পকর্ম। চার হাজার বছর আগে মহেঞ্জোদড়ো সভ্যতাতেও এই পদ্ধতিতে তৈরি ধাতব শিল্পকর্মের নিদর্শন মেলে। কেন্দ্রীয় সরকারের ললিতকলা অ্যাকাডেমির ৬০ বছর পূর্তিতে বাংলার মুখ সেই ডোকরাই। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে একটি করে শিল্পকর্ম পাঠানো হচ্ছে নয়াদিল্লিতে অ্যাকাডেমির সদর দফতরে। তার জন্য সম্প্রতি বাঁকুড়ার বিকনা থেকে ছ’জন শিল্পী কলকাতায় অ্যাকাডেমির ওয়ার্কশপে এসে টানা পনেরো দিন ধরে কাজ করলেন। মূল শিল্পী রামেশ্বর কর্মকারের তত্ত্বাবধানে এসেছিলেন স্বপন কর্মকার, মাদা কর্মকার, টুটুন কর্মকারেরা। সঙ্গে এনেছিলেন তাঁদের তৈরি ছোট-ছোট সব অনুপম মূর্তি। তাঁদেরই হাতযশে তৈরি হয়েছে ডোকরায় গড়া এক বৃক্ষের অবয়ব। তার মধ্যে রয়েছে সমাজ-প্রকৃতির নানা ছবি। ডোকরা শিল্পীরা সাধারণত যে মাপের কাজ করেন, তার তুলনায় এটি বিশাল। শিল্পিত সেই বৃক্ষ আপাতত দেশজোড়া ডালপালা মেলার অপেক্ষায়।
যথাসাধ্য
আদতে তিনি ছিলেন আইনজীবী, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি। কিন্তু বাংলা ভাষা তাঁকে চেনে যথা-শব্দ বইটির জন্য। চেনারই কথা, ও বই যে বাংলা ভাষার প্রথম ‘থিসরাস’। ১৯২৮ সালের ৩ ডিসেম্বর মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর মহকুমার দয়ারামপুর গ্রামে মুহম্মদ হাবিবুর রহমানের জন্ম। স্বাধীনতা তথা দেশভাগের পরে, ১৯৪৮ থেকে রাজশাহিতে বসবাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৯ সালে ইতিহাসে বিএ এবং ১৯৫১-য় এমএ পাশ করেন। পরে নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস পড়াতে-পড়াতেই হয়ে ওঠেন পুরোদস্তুর আইনজীবী। দীর্ঘ জীবন পাড়ি দিয়ে গত জানুয়ারিতে প্রয়াত হয়েছেন হাবিবুর। তাঁকে নিয়ে সংবাদপত্রে লেখালেখি হলেও তাঁর বাংলা ভাষাচর্চার দিকটি নিয়ে কিন্তু তেমন লেখালেখি হয়নি। সম্প্রতি জাহিরুল হাসান তাঁর সাহিত্যের টুকরো কথা-য় যথা-শব্দ জনককে নিয়ে একটি ছোট লেখা প্রকাশ করেছেন।
হাতের পাঁচ
এই দুর্মূল্যের বাজারেও তাঁর ভিজিট মাত্র পাঁচ টাকা। ‘কলে’ গেলে ডবল। এখন অবশ্য আর তিনি ‘কলে’ যান না। বয়স তো কম হল না, অষ্টআশি। কিন্তু তা বলে দু’বেলা নিয়ম করে রোগী দেখার বিরাম নেই নবদ্বীপের সুভাষচন্দ্র পাকড়াশির। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা, আবার বিকেল ৫টা থেকে রাত ৮টা আগমেশ্বরী পাড়ায় তাঁক চেম্বার খোলা। কালনা, কাটোয়া, কৃষ্ণনগর, কৃষ্ণগঞ্জ থেকে রোগী আসার বিরাম নেই। সুভাষবাবুর ঠাকুর্দা অখিলচন্দ্র ছিলেন প্রসিদ্ধ পাখোয়াজ বাদক। বাবা চারুচন্দ্র নামী ভাগবত পাঠক। তত্কালীন ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল কলেজ থেকে এলএমএফ কোর্স শেষ করে ইস্টার্ন ইন্ডিয়ান রেলে সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জেন পদে যোগ দিয়েছিলেন সুভাষ। চাকরি নিয়ে সোজা ইলাহাবাদ। তার পরে কানপুর, ইটাওয়া, টুন্ডলা, কাংড়া ভ্যালি, অমৃতসর, লখনউ হয়ে ১৯৮৬-তে বারাণসীতে অবসর। পৈতৃক বাড়িতে ফিরে মঠ-মন্দিরে দাতব্য চিকিত্সা শুরু করেছিলেন। পরে চেম্বার খুলে পাঁচ টাকা ভিজিট নিতে শুরু করেন। সেখানেই দাঁড়িয়ে আছেন। “আসলে কিছু না নিলে মানুষ গুরুত্ব বোঝে না। তাই নেওয়া” বলেন ডাক্তারবাবু। স্ত্রী মারা গিয়েছেন আগেই। দুই থেলের এক জন রাজস্থানে, অন্য জন গুয়াহাটিতে। গত ২২ ধরে নিজের ঘরে লালন করছেন এক মূক ও বধির কন্যাকে। সঙ্গী বলতে সে-ই। নিজে রক্তাল্পতায় ভুগছেন। শ্বাসকষ্টও আছে। তবু দু’বেলা রোগী দেখেন কেন? সুভাষবাবু জানান, ১০৫ বছরের এক বৃৃদ্ধ প্রাচীন মায়াপুর থেকে হেঁটে তাঁকে দেখাতে আসেন। ১০৩ বছরের এক মহিলা আসেন বাবলারি থেকে। ৯৫ বছরেরও এক জন আছেন। সুভাষবাবুর কথায়, “ওঁদের দেখে মনে হয় এখনও হাতে অনেকটা সময় আছে। আমি মালা-জপ করতে পারি না। বাবা বলেছিলেন, মানুষের চিকিত্সাই শ্রেষ্ঠ পুজো। তা-ই করে চলছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy