Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

তদন্ত-নজরদারি-সমন্বয়ের ত্রিমুখী দাওয়াই

ভদ্রেশ্বরে চটকল-কর্তা খুন এবং শিল্পমহলের উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে নড়েচড়ে বসল রাজ্য সরকার। রাজ্যের চটকলগুলির সার্বিক পরিবেশের উন্নয়নে ত্রিমুখী ব্যবস্থা নিচ্ছে তারা। সেগুলো হল: ভদ্রেশ্বরে সিআইডি তদন্ত। চটকল-পুলিশ সমন্বয়। চটকলে নিয়মিত পুলিশি নজরদারি। প্রথমত, ভদ্রেশ্বরে নর্থব্রুক চটকলে সিইও-হত্যার তদন্তভার রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশ (সিআইডি)-এর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, চটকলগুলির সমস্যা বুঝতে মিল-কর্তাদের সঙ্গে সরাসরি সমন্বয় বৈঠকের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ।

বুধবার নর্থব্রুক জুটমিলে তদন্তে সিআইডি দল।  ছবি: তাপস ঘোষ।

বুধবার নর্থব্রুক জুটমিলে তদন্তে সিআইডি দল। ছবি: তাপস ঘোষ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০১৪ ০৩:৪৮
Share: Save:

ভদ্রেশ্বরে চটকল-কর্তা খুন এবং শিল্পমহলের উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে নড়েচড়ে বসল রাজ্য সরকার। রাজ্যের চটকলগুলির সার্বিক পরিবেশের উন্নয়নে ত্রিমুখী ব্যবস্থা নিচ্ছে তারা। সেগুলো হল:

• ভদ্রেশ্বরে সিআইডি তদন্ত।

• চটকল-পুলিশ সমন্বয়।

• চটকলে নিয়মিত পুলিশি নজরদারি।

প্রথমত, ভদ্রেশ্বরে নর্থব্রুক চটকলে সিইও-হত্যার তদন্তভার রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশ (সিআইডি)-এর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, চটকলগুলির সমস্যা বুঝতে মিল-কর্তাদের সঙ্গে সরাসরি সমন্বয় বৈঠকের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ। ইতিমধ্যেই এলাকার কয়েকটি চটকলের কর্তাদের সঙ্গে শ্রীরামপুর থানার পুলিশ এক প্রস্ত বৈঠক সেরে নিয়েছে। তৃতীয়ত, চটকলের কাজ শুরু ও শেষের সময় পুলিশি নজরদারি চলবে নিয়মিত। এই ত্রিমুখী দাওয়াই চটকলের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে বলে নবান্নের কর্তাদের আশা।

নর্থব্রুক চটকলের সিইও হরিকিষান মহেশ্বরীকে খুনের ঘটনায় বুধবারেই তদন্তভার হাতে নিয়েছে সিআইডি। এ দিনই সিআইডি-র ১০ সদস্যের একটি দল ওই চটকল-চত্বর ঘুরে দেখে। দলের নেতৃত্বে ছিলেন সিআইডি-র আইজি নীরজ সিংহ এবং ডিআইজি দিলীপ আদক।

রবিবার ভদ্রেশ্বরের চাঁপদানিতে নর্থব্রুক জুট মিলের মধ্যেই এক দল লোকের হাতে প্রহৃত হন মহেশ্বরী। কলকাতায় নিয়ে আসার পথে মারা যান তিনি। ওই ঘটনার পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, সিপিএম এবং বিজেপি-র শ্রমিক সংগঠন মহেশ্বরীর খুনের সঙ্গে জড়িত। ওই চটকলের মালিক প্রকাশ চুরারিয়া অবশ্য মানতে চাননি যে, তাঁর কারখানার শ্রমিকেরা ওই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। তাঁর বক্তব্য ছিল, বহিরাগতেরাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। পরে মহেশ্বরী পরিবারের পক্ষ থেকেও অভিযোগ করা হয়, চটকলের শ্রমিকেরা নন, বাইরে থেকে আসা লোকেরাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে।

এ দিন বিকেলে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন হরিকিষানের ভাই পিকে মহেশ্বরী। সঙ্গে ছিলেন তাঁদের এক আত্মীয়। নবান্ন সূত্রের খবর, তাঁদের মধ্যে প্রায় আধ ঘণ্টা কথা হয়। নবান্ন থেকে বেরোনোর মুখে সাংবাদিকের প্রশ্নের কোনও উত্তর দেননি মহেশ্বরীরা। লাল বাতি লাগানো গাড়িতে পুলিশি নিরাপত্তায় নবান্ন ছাড়েন তাঁরা। মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয় থেকেও ওই বৈঠকের ব্যাপারে কেউ কিছু বলতে চাননি।

হরিকিষান-হত্যার তদন্ত সিআইডি-র হুগলি শাখার গোয়েন্দারা করবেন বলে ভবানী ভবন সূত্রের খবর। সিআইডি-র ডিআইজি (অপারেশন) দিলীপ আদক জানান, খুনের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বার করা হবে। ইতিমধ্যে ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে জেলা পুলিশ যাদের গ্রেফতার করেছে, তাদেরও নিজেদের হেফাজতে নেবে সিআইডি। ওই গোয়েন্দা সংস্থা জানাচ্ছে, এ দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্তকারীরা চটকল-কর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। রবিবার হাঙ্গামার সময় চটকলে যে-সব শ্রমিক হাজির ছিলেন, তাঁদের নামের তালিকা দেখতে চান গোয়েন্দারা। এক সিআইডি-কর্তা জানান, সেই সময় চটকলে যে-সব শ্রমিক উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের কাছে ওই ঘটনার খুঁটিনাটি জানতে চাইবে সিআইডি।

প্রাথমিক ভাবে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, ঘটনার সময় ওই চটকলের শ্রমিকেরা ছাড়াও বাইরে থেকে আসা লোকজনও ঘটনাস্থলে হাজির ছিলেন। তাঁরা কারা, তদন্তকারীরা তা জানার চেষ্টা করছেন। সিআইডি আধিকারিকেরা এ দিন প্রায় দেড় ঘণ্টা ছিলেন ঘটনাস্থলে। কারখানা থেকে বেরোনোর আগে তদন্তকারীরা নিহত চটকলকর্তার মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গেও কথা বলেন।

পুলিশি সূত্রের খবর, হুগলির অন্তত আটটি চটকলের কর্তারা এ দিন জেলার পুলিশ সুপার সুনীল চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা প্রতিটি চটকলের চত্বরে নিরাপত্তার দাবি জানান। পুলিশের তরফে চটকলকর্তাদের আশ্বস্ত করে বলা হয়, মিলে কোনও ঘটনা ঘটলে তা যেন প্রশাসনকে দ্রুত জানানো হয়। হুগলির পুলিশ সুপার পরে বলেন, “জেলার চটকলগুলিতে ইতিমধ্যেই পুলিশি টহল শুরু হয়ে গিয়েছে।”

রাজ্যের চটকলগুলির পরিবেশ যে এখন আর ততটা নিরাপদ নয়, নর্থব্রুক জুটমিলের কর্তা খুনের ঘটনা সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। চটকল মহলের আশঙ্কা, যে-কোনও মুহূর্তে এই ধরনের আরও ঘটনা ঘটতে পারে। ওই অবাঞ্ছিত ঘটনা রাজ্যে শিল্পের পরিবেশ নিয়েও বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছে। নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে বণিকমহলে। এই পরিস্থিতি ঠেকাতেই রাজ্য সরকার এখন অতি মাত্রায় সক্রিয়।

জেলা পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ইতিমধ্যেই শ্রীরামপুর থানায় চটকল-কর্তাদের সঙ্গে একটি সমন্বয় বৈঠক হয়ে গিয়েছে। ওই বৈঠকে মিল-কর্তাদের সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে, মিলের মধ্যে ছোট বা বড় যে-কোনও ঘটনা ঘটলেই সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানাতে হবে। পুলিশ পরিস্থিতি যাচাই করে পদক্ষেপ করবে। অতীতে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, কিছু কিছু ঘটনা ঘটলেও মিল-কর্তারা পুলিশকে তা জানাননি। কিন্তু পরে তা নিয়েই আইনশৃঙ্খলার সমস্যা দেখা দিয়েছে। আগে হুগলির একাধিক কারখানায় শ্রমিকদের মারধরে আধিকারিকদের মৃত্যু হয়েছে। যদিও নর্থব্রুকের ঘটনা অতীতের সব ঘটনাকেই ছাপিয়ে গিয়েছে।

হুগলিতে চটকল আছে ১৪টি। ওই সব চটকলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে প্রায় এক লক্ষ শ্রমিক কাজ করেন। হঠাৎই শিল্প ক্ষেত্রে মন্দা দেখা দেওয়ায় প্রবল অনিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি হয়েছে হুগলি শিল্পাঞ্চলে। নর্থব্রুকের ঘটনার পরে লাগোয়া ভিক্টোরিয়া জুটমিলের এক কর্তাকেও মারধর করা হয়। তার জেরে ওই মিলের একটি বিভাগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে কয়েক জন শ্রমিকের বিরুদ্ধে। ওই মিলের শ্রমিক সংগঠনের সহ-সভাপতি মনোজ উপাধ্যায় বলেন, “মিলে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফেরাতে কর্তৃপক্ষকে বলেছি, শ্রমিকদের উপর থেকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা তুলে নিয়ে বিভাগটি খুলে দেওয়া হোক।”

প্রশাসনের এক কর্তার বক্তব্য, কেন্দ্রীয় সরকার চটকলগুলির বরাত কাটছাঁট করায় এই শিল্পে সার্বিক ভাবেই অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। তারই প্রতিক্রিয়ায় উদ্বিগ্ন শ্রমিকেরা মেজাজ হারাচ্ছেন। এর দায় কিন্তু শুধুই শ্রমিকদের ঘাড়ে চাপালে চলবে না। হুগলির জেলাশাসক মনমীত নন্দা বলেন, “জুটমিলগুলিতে যে-কোনও পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশি নজরদারি শুরু হয়েছে।”

অন্য বিষয়গুলি:

northbrook jutemill bhadreswar harikishan maheswari
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy