Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪
বিজেপির দল দেখে জনতার ঢল

জুলুমের হিসেব দিতে হবে, হুঁশিয়ারি রাজ্যকে

সকাল থেকেই টানা বৃষ্টি চলছিল। রাস্তায় থকথকে কাদা। তবু শনিবারের বারবেলায় সেই জলকাদা ভেঙে বিজেপি নেতারা যখন গ্রামে ঢুকলেন, তাঁদের ঘিরে উপচে পড়ল ভিড়। দলের কয়েকশো কর্মী-সমর্থক তো ছিলেনই, সিপিএমেরও প্রচুর লোকজন তাঁদের সঙ্গে জুটে যান। এঁদের একটা বড় অংশ যে ইতিমধ্যে বিজেপির দিকে ঝুঁকে গিয়েছেন, তা-ও কার্যত স্পষ্ট।

সন্দেশখালির হালদার ভেড়িতে আক্রান্ত বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলছেন আসানসোলের বিজেপির দুই সাংসদ মীনাক্ষি লেখি ও বাবুল সুপ্রিয়।

সন্দেশখালির হালদার ভেড়িতে আক্রান্ত বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলছেন আসানসোলের বিজেপির দুই সাংসদ মীনাক্ষি লেখি ও বাবুল সুপ্রিয়।

নির্মল বসু
সন্দেশখালি শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৪ ০২:৪৬
Share: Save:

সকাল থেকেই টানা বৃষ্টি চলছিল। রাস্তায় থকথকে কাদা।

তবু শনিবারের বারবেলায় সেই জলকাদা ভেঙে বিজেপি নেতারা যখন গ্রামে ঢুকলেন, তাঁদের ঘিরে উপচে পড়ল ভিড়। দলের কয়েকশো কর্মী-সমর্থক তো ছিলেনই, সিপিএমেরও প্রচুর লোকজন তাঁদের সঙ্গে জুটে যান। এঁদের একটা বড় অংশ যে ইতিমধ্যে বিজেপির দিকে ঝুঁকে গিয়েছেন, তা-ও কার্যত স্পষ্ট।

দিল্লি থেকে আসা বিজেপির পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দলে ছিলেন দুই জাতীয় সহ-সভাপতি তথা সাংসদ মুখতার আব্বাস নকভি ও সুরিন্দর সিংহ অহলুওয়ালিয়া, সাংসদ তথা মুখপাত্র মীনাক্ষি লেখি, রাজ্য সহ-পরিদর্শক সিদ্ধার্থনাথ সিংহ ও সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ, রাজ্য নেতা শমীক ভট্টাচার্যেরা। কলকাতায় ফিরে মুখ্যসচিবের কাছে তাঁরা লিখিত বিবৃতিও দেন।

ওই বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়েছে, লোকসভা নির্বাচনের পরেই কোচবিহার থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত সারা রাজ্যে বিজেপি কর্মীদের আক্রমণ করছে শাসকদল তৃণমূলের লোকজন। সন্দেশখালি, ফলতা, বাসন্তী, বর্ধমানে লাউদোহা এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রামের পাঁচটি ঘটনা নির্দিষ্ট ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। পরে প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক বৈঠকে নকভির হুঁশিয়ারি, শাসকদলের অত্যাচার বন্ধ না হলে বিজেপি কর্মীরাও শান্ত হয়ে বসে থাকবেন না। প্রতিনিধি দলের নেতা সুরিন্দর সিংহ অহলুওয়ালিয়া বলেন, “তফসিলি জনজাতি অধ্যুষিত ওই গ্রামে যদি রাজ্য সরকার অবিলম্বে অনগ্রসর শ্রেণিকল্যাণ দফতরের কাউকে না পাঠায়, তা হলে জাতীয় তফসিলি জাতি-জনজাতি কমিশনের প্রতিনিধিরা আসবেন এবং তা রাজ্যের পক্ষে মোটেই সুখকর হবে না।”

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর শপথের পরের দিন, গত ২৭ মে সন্দেশখালির হালদারঘেরি পাড়ায় তৃণমূলের ‘গুন্ডাবাহিনী’ ছররা গুলি চালিয়েছিল বলে অভিযোগ। তাতে বিজেপির ২১ জন জখম হন। তার প্রতিবাদে শুক্রবারই রাজ্যের থানায়-থানায় বিক্ষোভ দেখানো হয়েছে। ১২ ঘণ্টা বন্ধ হয়েছে বসিরহাট মহকুমায়। দিল্লি থেকে প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে সেই আন্দোলন কর্মসূচির তীব্রতাই আরও বাড়ানো হল। এ দিন সকালে তৃণমূলের একটি প্রতিনিধি দলেরও হালদারঘেরি পাড়া গ্রামে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরে তা বাতিল করে দেওয়া হয়। দলের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি তথা খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক জানান, ওখানে এখন কোনও রকম দলীয় কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে না।

বাসন্তীর রাস্তা ছেড়ে বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে সরবেড়িয়া থেকে ধামাখালি যাওয়ার রাস্তা ধরলে দু’পাশে ধু-ধু মেছোভেড়ি। ফাঁকে-ফোঁকরে দু’চারটে করে বাড়ি। দুপুর ২টো নাগাদ ওই রাস্তা ধরেই হালদারঘেরি পাড়া গ্রামের কাছে পৌঁছয় বিজেপি নেতা-কর্মীদের পঁচিশটিরও বেশি গাড়ির কনভয়। দিল্লির প্রতিনিধিদের সঙ্গে ছিলেন কলকাতা ও জেলার বেশ কিছু নেতা-কর্মী। মূল সড়ক থেকে পায়ে চলা যে পথ গ্রামের দিকে নেমে গিয়েছে, তা কাদায় ভর্তি। সেই কাদা ডিঙিয়েই সকলে গ্রামে ঢোকেন।

তখনও বৃষ্টি হয়েই চলেছে। গ্রামে পূর্ব রামপুর আদিবাসী প্রাথমিক স্কুলে নেতাদের বসানো হয়। বাইরে মাইক লাগিয়ে বক্তৃতার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। স্থানীয় বাগদিপাড়া, ঝুপখালি, বেড়মজুর থেকেও প্রচুর মানুষ এসেছিলেন। তাঁরা অভিযোগ করেন, তৃণমূলের সন্ত্রাস রুখতে পুলিশ কিছু করছে না। প্রতিনিধি দল ফিরে গেলেই হামলা শুরু হবে বলেও তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন। গ্রামের লোকজন কার্তুজের কিছু খোল নেতা-নেত্রীদের হাতে তুলে দেন।

মীনাক্ষি বলেন, “কার্তুজগুলো পর্যন্ত সংগ্রহ করেনি পুলিশ। মাত্র তিন জন গ্রেফতার হয়েছে।” বাবুলের কটাক্ষ, “আদিবাসী মানুষের উপর এত বড় আক্রমণের পরেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও আপনাদের দেখতে এলেন না! যেখানে শিশু পর্যন্ত দুষ্কৃতীদের নাম জানে, সেখানে পুলিশ না কি তাদের চিনতে পারছে না!” মীনাক্ষির হুঁশিয়ারি, “রাজ্য ব্যবস্থা না নিলে কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু কমিশন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ও প্রধানমন্ত্রীকে রিপোর্ট দিতে বাধ্য হব।”

এক সময়ে সিপিএমের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত সন্দেশখালিতে এখন বেশির ভাগ এলাকাতেই তৃণমূলের প্রতাপ। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনে হালদারঘেরি পাড়ার দু’টি বুথে এগিয়ে ছিল বিজেপি। স্থানীয় সূত্রের খবর, গ্রামের সিপিএম সমর্থকদের বড় অংশ এ বার বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। সেই আক্রোশে তৃণমূল হামলা করছে। গ্রামের ছায়া সর্দার নিজের বছর তিনেকের মেয়ে প্রিয়াকে দেখিয়ে অভিযোগ করেন, “বাড়িতে ঢুকে ওরা (তৃণমূলের দুষ্কৃতী) আমার স্বামী তপনকে গুলি করল। মেয়েকে লাথি মেরে জলে ফেলে দিল। আমায় ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলল। হুমকি দিচ্ছে, তৃণমূল না করলে গ্রামছাড়া করবে। আতঙ্কে বাইরে বেরোতে পারছি না।’

শুধু সন্দেশখালি নয়, রাজ্যের বহু জায়গাতেই এখন এই একই অভিযোগ উঠছে। অর্থাৎ সিপিএম ছেড়ে বিজেপি করার ঝোঁক আর তা রুখতে তৃণমূলের হুমকি-মারধর। এ দিনই পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলা ব্লকের দুজিপুরে সিপিএমের তিন লোকাল সদস্যের বাড়িতে ভাঙচুর হয়। তাঁদের দাবি, দলের নেতারা নিরাপত্তা দিতে না পারায় তাঁরা বিজেপির দিকে ঝুঁকেছেন। কিন্তু কেন তাঁরা তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন না, সেই প্রশ্ন তুলে তাঁদের মারধরও করা হয় বলে অভিযোগ। এর আগে বর্ধমানেও প্রায় একই ঘটনা ঘটেছে।

কাদা পথ পেরিয়ে। সন্দেশখালির হালদারঘেরিতে আক্রান্ত কর্মী-সমর্থকদের
সঙ্গে দেখা করে ফেরার পথে বিজেপির প্রতিনিধিদল।

গত বিধানসভা ভোটে বিপর্যয়ের পর থেকে সিপিএম যেখানে প্রায় ঘরে ঢুকে গিয়েছে, দলের সাধারণ কর্মীরা বড় নেতাদের পাশে না পেয়ে ক্ষুব্ধ, সেখানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে সরকার গড়ার পরে বিজেপির আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে। এই প্রথম এ রাজ্যে সাফল্যের গন্ধ পেয়ে সামান্য সুযোগও হাতছাড়া করতে চাইছেন না নেতারা। বক্তব্যের সুরও তাই চড়া। এ দিন আক্রান্তদের কথা শুনতে-শুনতেই সদ্য আসানসোল থেকে জিতে আসা বাবুল সুপ্রিয় বলে ওঠেন, “আপনারা রুখে দাঁড়ান। ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়ালে ওরা পালানোর পথ পাবে না।”

অহলুওয়ালিয়াও বলেন, “দিন ঘুরছে, পরিবর্তন অন্য খাতে হচ্ছে। আপনারা মাথা তুলে দাঁড়ান।” রাহুল সিংহের দাবি, “তৃণমূল নেত্রী বুঝেছেন, বিজেপি আগামী দিনের বিকল্প। তাতেই তৃণমূলের ঘুম ছুটে গিয়েছে। ২০১৬ সালে লোক-ঠকানো এই সরকারকে বদল করতে হবে।”

মোদী-ঝড়েও যাঁর খাসতালুক মুর্শিদাবাদে বিজেপি বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি, সেই প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও এ দিন প্রায় বিজেপির সুরেই তৃণমূলকে আক্রমণ করেছেন। বহরমপুরে অধীর বলেন, “বামপন্থীরা ৩৪ বছর যে সন্ত্রাসের রাজত্ব চালিয়েছিল, তৃণমূল সরকার তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। বিজেপির সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক লড়াই। কিন্তু বাংলায় সন্ত্রাস প্রসঙ্গে বিজেপি নেতৃত্বের বক্তব্য তো আমি অস্বীকার করতে পারি না। আমরাও তো সন্দেশখালির ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়েছি।” তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় অবশ্য অভিযোগ উড়িয়ে দাবি করেন, দেশে এক মাত্র বাংলাতেই ‘গণতান্ত্রিক পরিবেশ’ রয়েছে। তাঁর কথায়, “রাজ্যে সন্ত্রাস নেই। বরং তৃণমূলের লোকেরা আক্রান্ত হচ্ছেন এবং খুন হচ্ছেন।”

বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব এ দিন গোসাবার ছোট মোল্লাখালির পশ্চিম রাধানগর গ্রামে আক্রান্ত বিজেপি সমর্থক সুকুমার মণ্ডলের বাড়িতেও যান। সন্দেশখালিতে গুলিতে জখম ১৩ জনের চিকিৎসা চলছে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে। বিকেলে হাসপাতালে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে দেখা করেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। মীনাক্ষি অভিযোগ করেন, গুলিতে জখমদের চিকিৎসাও ভাল করে হচ্ছে না। দিল্লিতে ফিরে গিয়ে বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিংহের কাছে বিস্তারিত রিপোর্ট দেওয়া হবে। নকভি বলেন, “এই জুলুমের হিসেব দিতে হবে রাজ্য সরকারকে।”

শনিবার নির্মল বসুর তোলা ছবি।

অন্য বিষয়গুলি:

nirmal basu sandeshkhali bjp
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy