Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
ভোটের বাতাসে ভয়

গড় সামাল দিতে মরিয়া শাসক

এক পক্ষের চ্যালেঞ্জ দুর্গ রক্ষার। অন্য পক্ষের কাছে প্রশ্ন মর্যাদা বাঁচানোর। রাজ্যে লোকসভা ভোটের শেষ পর্বে লড়াই তাই ধুন্ধুমার! চার দফা পেরিয়ে আজ, সোমবার পঞ্চম ও শেষ দফায় ভোট মূলত শাসক দল তৃণমূলের গড়ে। যে ১৭টি কেন্দ্রে আজ ভোট হচ্ছে, গত লোকসভা নির্বাচনে সেখানে একক ভাবে তৃণমূলের দখলে ছিল ১৪টি আসন। তাদের জোটসঙ্গী এসইউসি-র দখলে ছিল একটি।

সন্দীপন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৪ ০৩:৩৯
Share: Save:

এক পক্ষের চ্যালেঞ্জ দুর্গ রক্ষার। অন্য পক্ষের কাছে প্রশ্ন মর্যাদা বাঁচানোর। রাজ্যে লোকসভা ভোটের শেষ পর্বে লড়াই তাই ধুন্ধুমার!

চার দফা পেরিয়ে আজ, সোমবার পঞ্চম ও শেষ দফায় ভোট মূলত শাসক দল তৃণমূলের গড়ে। যে ১৭টি কেন্দ্রে আজ ভোট হচ্ছে, গত লোকসভা নির্বাচনে সেখানে একক ভাবে তৃণমূলের দখলে ছিল ১৪টি আসন। তাদের জোটসঙ্গী এসইউসি-র দখলে ছিল একটি। বামেদের বক্তব্য, বহরমপুরে কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী নিজস্ব ক্যারিশ্মায় জিতলেও তাঁর দলের জোট কিন্তু ছিল তৃণমূলের সঙ্গে। সেই অর্থে গত বার তৃণমূল জোটের হাতের বাইরে ছিল মাত্র একটি আসন! এ বারে তৃণমূলের সঙ্গে কারও জোট হয়নি। বিরোধীদের এখন লক্ষ্য, তৃণমূলের ঝুলি থেকে এই একগুচ্ছ আসনের মধ্যে যথাসম্ভব কেন্দ্র ছিনিয়ে নেওয়া। শাসক দলের কাছে আজ তাই আক্ষরিক অর্থেই ঘাঁটি আগলানোর লড়াই।

টেট কেলেঙ্কারি, সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ-সহ একাধিক বিষয়কে সামনে রেখে শাসক দলকে দুর্নীতির দায়ে কাঠগড়ায় তুলে এ বারে প্রচার চালিয়েছে বিরোধীরা। তাদের দাবি, তৃণমূলের তিন বছরের শাসনে শহুরে মানুষের মধ্যেই বেশি মোহভঙ্গ হয়েছে। শহর ও শহরতলির সেই অংশের বহু মানুষ আজই ভোট দেবেন। আবার সারদা-কাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের একটা বিরাট অংশ ছড়িয়ে আছেন দুই ২৪ পরগনা, নদিয়া ও পূর্ব মেদিনীপুর জেলায়। সারদা-কাণ্ড প্রকাশ্যে আসার পরে গত বছর পঞ্চায়েত ভোটে দুই ২৪ পরগনা এবং নদিয়ায় গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে তো বটেই পঞ্চায়েত সমিতিরও বহু আসন হাতছাড়া হয় তৃণমূলের। বিরোধীদের বক্তব্য, এই সব এলাকায় যেখানে সুষ্ঠু ভোট হয়েছিল, সেখানেই বিপাকে পড়েছিল তৃণমূল। উদাহরণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, সারদা-কাণ্ডের বড় প্রভাব বোঝা গিয়েছিল বনগাঁ, বসিরহাট, বারাসতের একাংশ, ডায়মন্ড হারবার, রায়দিঘি, বজবজ, ফলতা, বিষ্ণুপুর, কাকদ্বীপের একাংশ এবং রানাঘাট ও চাকদহের একাংশের ফলাফলে। বিরোধীদের বক্তব্য, লোকসভাতেও সুষ্ঠু এবং অবাধ ভোট হলে শাসক দলের ভোটব্যাঙ্কে ভাঙন আরও স্পষ্ট হবে বুঝেই সন্ত্রাসের আশ্রয় নিচ্ছে তৃণমূল।

অন্য দিকে বিরোধীদেরও আর পিছু হঠার জায়গা নেই। গত চার দফায় তাদের তরফে সর্বতো ভাবে চেষ্টা হয়েছে নিবার্চন কমিশনের উপরে চাপ বাড়ানোর। যাতে পরের দফায় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। কিন্তু আজকের পরে আর সেই সুযোগ নেই। তাই দুই প্রধান বিরোধী পক্ষ, বাম এবং কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব দলের নেতা-কর্মীদের বার্তা দিয়ে রেখেছেন, শেষ পর্বে অনিয়ম দেখলে রুখে দাঁড়াতেই হবে। শাসক ও বিরোধী, দুই শিবিরের এই নাছোড় মনোভাবের আবহেই রাজ্যে শেষ দফার ভোট রাজনৈতিক ভাবে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চলেছে। স্বাভাবিক ভাবেই চড়ছে উত্তেজনার পারদও।

শেষ পর্বে আর সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না বুঝেই রণকৌশল তৈরি করেছে দুই যুযুধান শিবির। বাম ও কংগ্রেস তাদের কর্মী-সমর্থকদের তৈরি রাখছে যথাসাধ্য পরিস্থিতি ‘মোকাবিলা’র জন্য। বিরোধী দলনেতা তথা সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্রের কথায়, “বামপন্থী কর্মী-সমর্থকদের বলছি, মানুষের ভোটাধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য যা যা করার, করবেন। প্রতিবাদের সামনের সারিতে থাকবেন।” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি এবং বহরমপুরের কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীরও বক্তব্য, “আমরা অশান্তি চাই না। গত চার পর্ব ধরে একই কথা বলে আসছি। এ বার শেষ পর্ব। তৃণমূল কী করবে, জানি না। কিন্তু এইটুকু বলতে পারি, যত ক্ষণ প্রাণ আছে, আমরা পালাব না!” শুধু বহরমপুর নয়, রাজ্যের অন্যত্রও কংগ্রেস কর্মী-সমর্থকদের ‘প্রয়োজনীয়’ বার্তা দেওয়া হয়েছে।

শাসক দলের তরফে আবার তাদের কর্মী-সমর্থকদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে প্ররোচনায় পা না দিতে। শেষ পর্বের ভোটের প্রাক্কালে তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যেপাধ্যায় যেমন প্ররোচনা এড়িয়ে চলার কথা বলেছেন, তেমনই তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় কংগ্রেস-সিপিএম-বিজেপি’র বিরুদ্ধে একজোট হয়ে সন্ত্রাসের ‘নীল নকশা’ তৈরির অভিযোগ এনেছেন। মুকুলবাবুর কথায়, “কোনও রকম প্ররোচনায় পা না দেওয়ার কথা আমাদের কর্মীদের বলা হয়েছে।” আর তৃণমূল নেত্রীর বার্তা, “মাথা ঠান্ডা রাখুন। বি টাফ অ্যান্ড স্মার্ট!” বিরোধীরা আবার পাল্টা প্রশ্ন, তারাই যদি সন্ত্রাসের পরিকল্পনা করবে, তা হলে বেলঘরিয়া, বেলেঘাটা-সহ সর্বত্র বিরোধীরাই আক্রান্ত হচ্ছে কেন?

বামেদের অভিযোগ, এখনও পর্যন্ত উত্তর কলকাতা, দমদম ও ব্যারাকপুর এই তিনটি লোকসভা কেন্দ্রের কিছু অংশে ভোটের আগেই গোলমাল বাধাতে শুরু করেছে শাসক দল। প্রশাসন ও কমিশনের ভূমিকা বহু ক্ষেত্রেই সন্তোষজনক নয়। বামেদের যুক্তি, সেই কারণেই শেষ পর্বে প্রতিরোধের কথা বলতে হচ্ছে। বামেদের অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন অনুযায়ী, স্বাভাবিক ভোট হলে উত্তর ২৪ পরগনার পাঁচটি আসনই তৃণমূলের জন্য খুব ‘নিরাপদ’ নয়। সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক গৌতম দেব যে কারণে হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন, জেলায় রিগিং হলে পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে বাম কর্মী-সমর্থকেরা বড় ধরনের প্রতিবাদের পথে যাবেন। পঞ্চায়েত ভোটের আগেও জেলায় একই ধরনের হুঁশিয়ারির কৌশল নিয়েছিলেন গৌতমবাবু এবং তাতে কিছু কাজও হয়েছিল।

বাম, কংগ্রেস এবং বিজেপি-র অভিযোগ, যে সব জেলায় ইতিমধ্যে ভোট হয়ে গিয়েছে, সেখান থেকে আজ শেষ দফার ভোটের জন্য লোক ঢোকানো হচ্ছে। কলকাতা ও দুই ২৪ পরগনায় যেমন হাওড়া-হুগলি থেকে বহিরাগতদের আনা হয়েছে, তেমনই বীরভূম থেকে লোক এসেছে মুর্শিদাবাদ জেলায়। কমিশনের কাছে এই নিয়ে অভিযোগও জমা দিয়েছে বিরোধীরা। কংগ্রেসের এক বিধায়কের বক্তব্য, “মুর্শিদাবাদ জেলায় তৃণমূলের সংগঠন তেমন কিছু নয়। কিন্তু বাইরে থেকে লোক এনে তারা যদি ভোটের দিন গোলমাল বাধানোর চেষ্টা করে, যে কোনও পরিস্থিতির জন্য তাদের তৈরি থাকতে হবে!” রবিবারই অধীরের গাড়ি ঘিরে তৃণমূলের বিক্ষোভ এবং তৃণমূল প্রার্থী ইন্দ্রনীল সেনের উপরে কংগ্রেস কর্মীদের হামলা নিয়ে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ উঠেছে। বিজেপি-র সংগঠন এখনও সর্বত্র তেমন শক্তপোক্ত না হওয়ায় এবং মোদী-হাওয়ার উপরে ভরসা থাকায় তারা সরাসরি প্রতিরোধের কথা না বলে কমিশনের উপরেই চাপ সৃষ্টি করেছে।

প্রথম দিকে বিমানবাবুরা প্রতিরোধের কথা বলছিলেন না। কিন্তু একাধিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা ভোট দিতে না পারা মানুষদের রাস্তায় বসে পড়ার ডাক দিয়েছিলেন। সেই আহ্বানই শেষ পর্বের আগে আরও জোরালো করেছেন তাঁরা।

অন্য বিষয়গুলি:

sandipan chakroborty vote
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE