Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
কথা রাখলেন কুণাল

খোঁজ করুন, আমি মরলে কাদের ভাল

প্রশ্নটা দিনভর বিরোধীরা তুলেছেন, সংবাদমাধ্যম তুলেছে। তিনি কুণাল ঘোষ প্রাক্তন সাংবাদিক, বর্তমানে তৃণমূলের সাসপেন্ডেড সাংসদ সবার আগে নিজেই প্রশ্নটা উস্কে দিলেন। শুক্রবার সকাল ১০টা। এসএসকেএম হাসপাতালে ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিটের ৫ নম্বর শয্যায় শুয়ে কুণাল ঘোষ তখন মোটামুটি কথা বলতে পারছেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, “ক’টা ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন?”

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:১৫
Share: Save:

প্রশ্নটা দিনভর বিরোধীরা তুলেছেন, সংবাদমাধ্যম তুলেছে। তিনি কুণাল ঘোষ প্রাক্তন সাংবাদিক, বর্তমানে তৃণমূলের সাসপেন্ডেড সাংসদ সবার আগে নিজেই প্রশ্নটা উস্কে দিলেন।

শুক্রবার সকাল ১০টা। এসএসকেএম হাসপাতালে ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিটের ৫ নম্বর শয্যায় শুয়ে কুণাল ঘোষ তখন মোটামুটি কথা বলতে পারছেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, “ক’টা ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন?” কুণাল উত্তর না দিয়ে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলেন, “তার চেয়েও বড় কথা হল, ওষুধগুলি আমার কাছে এল কী ভাবে?”

এ দিনই ভোরবেলায় পেট ওয়াশ করা হয়েছে। বেলার দিকে কুণালের শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীলই ছিল। মানুষ চিনতে পারছিলেন। কথাও বলছিলেন। মেডিক্যাল বোর্ডের কাছে তিনি দাবি করেছেন, ২২টা ঘুমের বড়ি খেয়েছেন। আনন্দবাজারকে সে কথা অবশ্য বলেননি। সংখ্যাটা নিয়ে চিকিৎসকরাও এখনও নিঃসন্দেহ নন। কিন্তু ‘ক’টা খেয়েছেন’-এর চেয়েও ‘কী করে খেতে পারলেন’, সেটাই এখন বড় জিজ্ঞাসা হয়ে উঠেছে। প্রশাসনও সেই অস্বস্তি কোনও ভাবেই এড়াতে পারছে না। জেল কর্তৃপক্ষের গাফিলতি কার্যত মেনে নিয়েই স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তিন জনের তদন্ত কমিটি গড়ার কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। ইতিমধ্যেই প্রেসিডেন্সি জেল সুপার নবীন সাহা এবং জেল হাসপাতালের চিকিৎসক গৌতম দাশগুপ্তকে আপাতত সাসপেন্ড করা হয়েছে। আরও কিছু কারারক্ষীকে সাসপেন্ড করার কথা চলছে। এমনকী কারামন্ত্রী হায়দার আজিজ সফিকেও সরানো হতে পারে বলে তৃণমূল সূত্রের খবর।

সোমবার আদালতে দাঁড়িয়ে নিজেই ৭২ ঘণ্টা সময়সীমা ঠিক করে নিয়েছিলেন কুণাল। তাঁর দাবি ছিল, তিন দিনের মধ্যে সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িত রাঘব বোয়ালদের গ্রেফতার করা না হলে আত্মহত্যা করবেন তিনি। সেই সুর বজায় রেখেই মঙ্গলবার বিচারককে চিঠি লিখে বলেন, ওই চিঠি যেন তাঁর মৃত্যুকালীন জবানবন্দি হিসেবে গণ্য হয়। ফলে ৭২ ঘণ্টা পেরোলে কী করবেন, তা নিয়ে আশঙ্কা ছিলই। প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি কুণাল তাঁর ‘কথা রাখলেন’। বৃহস্পতিবার রাতেই একাধিক ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করলেন। কুণালের সেলে সব সময় এক জন রক্ষী থাকেন এবং রাতে প্রতি এক ঘণ্টা অন্তর তাঁর শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করে দেখা হয়। বৃহস্পতিবার রাত ২টো নাগাদ সেই রুটিন চেকআপ করতে গিয়েই রক্ষীরা দেখেন, কুণাল কাতরাচ্ছেন, তাঁর মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বের হচ্ছে। ভোর চারটে নাগাদ তাঁকে এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

কী ভাবে একগুচ্ছ ঘুমের ওষুধ হাতে পেলেন কুণাল? প্রেসিডেন্সি জেলের কর্তারা জানিয়েছেন, দিন সাতেক আগে সংশোধনাগারের চিকিৎসক গৌতম দাশগুপ্ত কুণালবাবুকে একটি প্রেসক্রিপশন দেন।

তাতে ঘুমের ওষুধ লেখা ছিল। অ্যালপ্রাজোলাম (০.৫ মিলিগ্রাম) নামে ওই ওষুধের ১৫টি-র দু’টি স্ট্রিপ কুণালবাবুর হাতে দিয়ে দিয়েছিলেন গৌতমবাবু। এর মধ্যে একটি স্ট্রিপ খোলা হয়নি। অন্য স্ট্রিপ থেকে কুণাল ঘোষ বৃহস্পতিবার রাতে ৭-৮টি ওষুধ একবারে খেয়ে নেন বলে দাবি করেছেন সংশোধনাগারের একাংশ। যদিও এই সংখ্যা নিয়ে ধন্দ রয়েছে। কারণ এসএসকেএমে আসার পর প্রথমে কুণালবাবু দাবি করেছিলেন তিনি ৫৮টি ওষুধ খেয়েছেন, পরে মেডিক্যাল বোর্ডকে জানান, তিনি ২২টি ওষুধ খেয়েছেন।

কিন্তু জেলবন্দির হাতে ওষুধের গোটা স্ট্রিপ তুলে দেওয়া হয়েছিল কেন? চিকিৎসক গৌতমবাবুকে ফোন করা হলে তিনি উত্তেজিত ভাবে বলেন, “একটি শব্দও আমার কাছ থেকে বের করতে পারবেন না। সুপার সব জানেন। ওঁকে জিজ্ঞাসা করুন।” তবে মেডিক্যাল বোর্ডের ডাক্তারদের কাছে নিজে কুণাল দাবি করেছেন, চিকিৎসককে তিনি জানিয়েছিলেন, রাতে ভাল ঘুম আসছে না। চিকিৎসক তখন প্রেসক্রিপশনে ঘুমের ওষুধ লিখে দেন। সেই ওষুধই বেশ কয়েক দিন ধরে জমিয়ে রেখেছিলেন তিনি। প্রেসক্রিপশনে লেখা ওষুধ তিনি হাতে পেলেন কী ভাবে? উত্তরে কিছুটা হেঁয়ালি করে কুণাল বলেছেন, ‘‘ওষুধ তো শুধু আত্মহত্যার কাজে লাগে না। তাই সেটা চাইলে কেউ দেবে না তা নয়। ঠিক পাওয়া যায়।’’

কিন্তু জেলের নিয়ম হল, কোনও বন্দির ওষুধের প্রয়োজন হলে জেলের তরফে কেউ সামনে দাঁড়িয়ে থেকে সেই ওষুধ খাওয়াবেন। কিন্তু কুণালের নিজের দাবি এবং প্রেসিডেন্সি জেল ও এসএসকেএম সূত্রে জানা যাচ্ছে, কুণালের ক্ষেত্রে সেই নিয়মও মানা হয়নি। ওষুধ খাওয়ার ব্যাপারে কুণালের উপরে নজরদারি ছিল না।

কুণালের মতো হাই প্রোফাইল বন্দির ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবেই এমন শিথিলতা থাকার কথা নয় বলে জানাচ্ছেন প্রাক্তন জেল কর্তারা। উপরন্তু বন্দি নিজে যখন প্রকাশ্যে আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে রেখেছেন, সে ক্ষেত্রে কড়াকড়ি তুঙ্গে থাকারই কথা। সোমবার বিচারক নিজে এডিজি কারা-কে কুণালের নিরাপত্তার সব রকম ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তার পরেও বন্দি কী করে জেলে বসে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারলেন? কুণাল এর আগে তাঁকে মেরে ফেলার চক্রান্ত চলছে বলে যে অভিযোগ করেছিলেন, এ দিন সেটাই বদলে নিয়েছেন আত্মহত্যায় মদতের অভিযোগে। তাঁর বক্তব্য, “আমি মরে যেতে চাওয়ায় কাদের সুবিধা সেটা খোঁজ করুন। আমি মরে গেলে ওদের ভাল। মরিনি, এ বার হয়তো আমাকে পাগল বলে প্রমাণ করতে চাইবে।”

বৃহস্পতিবার রাতের ঘটনার পর ঠিক হয়েছে, এ বার থেকে কুণালের সেলে সিসিটিভি থাকবে। সারা রাত আলো জ্বলবে। কুণালের বিরুদ্ধে হেস্টিংস থানায় ৩০৯ ধারায় আত্মহত্যার চেষ্টার একটি অভিযোগও দায়ের করেছে পুলিশ। এ দিন সন্ধেয় এসএসকেএম কর্তৃপক্ষ জানান, কুণালকে আর অক্সিজেন দিতে হচ্ছে না। রক্তচাপ ঠিক রয়েছে। স্বাভাবিক খাওয়াদাওয়া করছেন। কথাও বলছেন। মেডিসিন বিভাগের প্রধান নির্মলেন্দু সরকারের নেতৃত্বাধীন বোর্ড চিকিৎসা করছে। হাসপাতাল সূত্রের খবর, কুণালের আরও ক’টি পরীক্ষা করতে হবে। সে জন্য দু’এক দিন হাসপাতালে থাকতে হবে। তাঁর পেট থেকে সংগ্রহ করা তরলের নমুনা বেলগাছিয়ার ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছে। সেটা পরীক্ষা করে জানা যাবে কুণাল সত্যিই ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলেন কি না। খেলে কতটা খেয়েছেন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy