অলোক রাজোরিয়া
অকপটে ‘সত্যি’ কথাটা গত বছর তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়েই পড়েছিল। স্বীকার করেছিলেন পুলিশের এখন ‘কঠিন সময়’। নবান্নের বিরাগভাজনের সূচনা করে দিয়েছিল তাঁর ওই মন্তব্যই।
দায়িত্ব পাওয়ার এক বছরের মধ্যেই বীরভূমের সেই পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়াকে সরিয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট হল, শাসক-শিবির আর তাঁকে চাইছে না! বৃহস্পতিবার নবান্ন থেকে জারি করা নির্দেশে রাজনৈতিক সংঘর্ষক্লিষ্ট বীরভূমের নতুন পুলিশ সুপার করা হয়েছে মুকেশ কুমারকে। তিনি বাঁকুড়ার এসপি ছিলেন। গত বছর জানুয়ারিতে বীরভূমের তৎকালীন পুলিশ সুপার সি সুধাকরকে সরিয়ে রাজোরিয়াকে ওই দায়িত্বে আনা হয়েছিল। লাভপুর গণধর্ষণ-কাণ্ডে দেশজুড়ে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁরই নির্দেশে সরতে হয়েছিল সুধাকরকে।
আশ্চর্য সমাপতন!
যে ঘটনার পরে রাজোরিয়াকে সরতে হল, সে-ও নারী নির্যাতন সংক্রান্ত। পাড়ুইয়ের বধূকে বর্বরোচিত নির্যাতনের সেই ঘটনায় নাম জড়িয়েছে বীরভূম পুলিশেরই একাধিক অফিসার ও কর্মীর। অভিযুক্তদের মধ্যে এক জনকে সাসপেন্ড ও বাকিদের শো-কজ করেছিলেন রাজোরিয়াই। এই নিয়ে তৃণমূল সরকারের শাসনে বীরভূমে মোট সাত বার এসপি বদল হল। ঘটনাচক্রে বৃহস্পতিবার পাড়ুইয়ের সাত্তোরে গিয়ে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুও এই নিয়ে সরকারকে বিঁধেছেন। তাঁর কটাক্ষ, “সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সাত-সাত বার এসপি বদল মানে ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়’! এই তথ্যই বুঝিয়ে দিচ্ছে, এই রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা কোন জায়গায় পৌঁছেছে!”
নবান্ন অবশ্য এই পরিবর্তনকে ‘রুটিন বদলি’ হিসেবেই ব্যাখ্যা করেছে। ওই রুটিন বদলিতেই শিলিগুড়ির নতুন পুলিশ কমিশনার করা হয়েছে মনোজ বর্মাকে, যাঁকে পালাবদলের পরে ‘সিপিএমের লোক’ বলে দেগে দিয়েছিল তৃণমূলের সরকার। সেই সূত্রেই রাতারাতি তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ‘কম্পালসারি ওয়েটিং’-এ। শাসক দলের অভিযোগ ছিল, মনোজ বর্মার পরোক্ষ মদতেই জঙ্গলমহলে হার্মাদ ক্যাম্প তৈরি করেছিল সিপিএম। পরে অবশ্য মাওবাদী দমনে বিশেষ দল ‘কাউন্টার ইনসার্জেন্সি ফোর্স’-এর প্রধান করে ‘পুরস্কার’ দেওয়া হয় মনোজকে।
তার পরে তাঁকে করা হয় রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের ডিআইজি। আর এ বার জগমোহনকে সরিয়ে তাঁকে দেওয়া হল শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটের দায়িত্ব।
অলোক রাজোরিয়া অবশ্য প্রথম থেকেই শাসক দলের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। গত বছর লোকসভা নির্বাচনের সময় যে সাত জন পুলিশ সুপারকে বদলির নির্দেশ দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন রাজোরিয়াও। কিন্তু, রাজোরিয়া-সহ তাঁর ‘আস্থাভাজন’ ওই সাত পুলিশকর্তাকেই তাঁদের পুরনো জেলায় পুনর্নিয়োগ করেন মুখ্যমন্ত্রী।
লোকসভা ভোটের পর থেকে শাসকদল-পুলিশ সুপার ‘সমীকরণ’ কিছুটা হলেও বদলাতে শুরু করে। এই সময়ের মধ্যেই বীরভূমে (বিশেষ করে পাড়ুইয়ে) উত্থান শুরু বিজেপি-র। রাজনৈতিক জমি দখলের মরিয়া চেষ্টায় বিজেপি-র সঙ্গে বারবার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে তৃণমূল। বাড়তে থাকে রক্তপাত।বিভিন্ন রাজনৈতিক সংঘর্ষে জড়িত থাকার অভিযোগে বিজেপি-র পাশাপাশি শাসকদলের বহু কর্মীকেও ধরপাকড় করে জেলা পুলিশ। এই নিয়ে জেলা তৃণমূলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এমনকী, বোলপুরে মুকুল রায়ের সামনেই পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেন দলের বহু নেতা-কর্মী।
এরই মাঝে রাজনৈতিক সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে বোমার ঘায়ে মারা যান দুবরাজপুর থানার এএসআই অমিত চক্রবর্তী। রাজোরিয়ার আমলেই জেলায় একাধিক বার পুলিশি নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে। বোলপুর থানায় ঢুকে পুলিশ পেটানোয় অভিযুক্ত জেলা যুব তৃণমূল নেতা সুদীপ্ত ঘোষকে গ্রেফতার না করার সাহস করেনি জেলা পুলিশ। চারপাশ থেকে প্রবল সমালোচনার মুখে রাজোরিয়া এক দিন বলে বসেন, বীরভূম পুলিশের এখন ‘কঠিন সময়’। আর তখনই নবান্নের রোষানলে পড়া শুরু। সুদীপ্তকে না ধরলেও তাঁর বিরুদ্ধে যে ‘কেস ডায়েরি’ জমা দিয়েছিল রাজোরিয়ার পুলিশ, তাতে পরপর দু’বার ওই দাপুটে তৃণমূল নেতার আগাম জামিনের আবেদন খারিজ হয়ে যায় বোলপুর ও সিউড়ি আদালতে। জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সুদীপ্ত। এই ঘটনাতেও পুলিশ সুপারের উপরে ক্ষোভ ছিল শাসকদলের।
রাজোরিয়ার বদলিতে শেষ উপাদান হিসাবে কাজ করেছে পাড়ুইয়ের সাত্তোরের বিজেপি সমর্থক পরিবারের বধূকে নির্যাতনের ঘটনা। সাত্তোরে একটি সংঘর্ষের ঘটনায় অভিযুক্ত এক বিজেপি কর্মীকে খুঁজতে বর্ধমানের বুদবুদ থানার কলমডাঙা গ্রামে গিয়ে ওই বিজেপি কর্মীর কাকিমাকে নৃশংস ভাবে মারধরে জড়িয়ে পড়ে বীরভূম পুলিশ। অভিযুক্ত পুলিশকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও তখন থেকেই প্রশাসনে কানাঘুষো চলছিল, রাজোরিয়াকে এ বার বদলি করে দেওয়া হবে।
বিরোধী দলগুলি বিশেষ করে বিজেপি এই নিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গেও দেখা করে। রাজ্যপাল ডিজি-কে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। ওই ঘটনায় কলকাতা হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা করার নির্দেশ দেয়। সম্প্রতি জাতীয় মহিলা কমিশনের প্রতিনিধিদলও পাড়ুইয়ে এসে নির্যাতিতার সঙ্গে দেখা করে পুলিশের সমালোচনা করেছে। ওই দলের নেতৃত্বে থাকা ললিতা কুমারমঙ্গলম বলেন, “আগে শুনেছি। কিন্তু, এমন বর্বরোচিত নারী নির্যাতন প্রথম দেখলাম!”
নারী নির্যাতনের এই ঘটনায় পুলিশের সঙ্গে তৃণমূলের কিছু নেতা-কর্মীর নামও জড়িয়ে যাওয়ায় আরও মুখ পুড়েছে রাজ্য সরকারের। প্রায় রোজই কোনও না কোনও বিরোধী দল পাড়ুইয়ে যাচ্ছে আর রাজ্য সরকারের মুণ্ডপাত করছে। সরকারের এক সূত্রের মতে, এর দায় এড়াতে পারেন না পুলিশ সুপার। অন্য জেলায় বীরভূম পুলিশ অভিযান চালাবে, আর পুলিশ সুপার তা জানবেন না, এই তত্ত্বও খাটে না!
রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, শেষ পর্যন্ত প্রশাসনের মুখ রক্ষাতেই বৃহস্পতিবার সরিয়ে দেওয়া হল অলোক রাজোরিয়াকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy