তাঁর সংসার যে কায়ক্লেশে চলছে, গত সাড়ে তিন বছরে বারে বারে রাজ্যবাসীকে সে কথা শুনিয়ে চলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন্দ্রের আর্থিক সহায়তা পাওয়ার চেষ্টাতেও খামতি রাখছেন না। কিন্তু হোক না ‘ভাঁড়ে মা ভবানী’ অবস্থা, মা-মাটি-মানুষের সরকারের দান-খয়রাতি কি বন্ধ হতে পারে? বিশেষ করে, শিয়রে যখন ভোট! তাই এ বারও ঠিক হয়েছে, আরও বেশি পাড়ার ক্লাবকে অনুদান দেওয়া হবে ও তার জন্য খরচ হবে ১২০ কোটি টাকারও বেশি!
নবান্ন সূত্রের খবর, সব কিছু ঠিকঠাক চললে আগামী নভেম্বর মাসেই খয়রাতি-যজ্ঞ চালু হয়ে যাবে। আগে পেয়েছে, এমন প্রায় ৪৪০০টি ক্লাব তো এক লাখ টাকা করে অনুদান পাবেই, তার সঙ্গে এ বার নতুন ৪০০০ ক্লাবকে দু’লক্ষ টাকা করে অনুদান দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারের একটি সূত্রের বক্তব্য, খেলাধুলোর উন্নয়নের নামে পাড়ার ক্লাবগুলিকে ঢালাও অনুদান দেওয়ার শুরু ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে। সে বার ৭৮১টি ক্লাবকে অনুদান দেওয়া হয়েছিল। খরচ হয় প্রায় সাড়ে ১৫ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে সেই খরচ বেড়ে হয় ৪০ কোটি। কারণ, সে বার মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, এক-একটি ক্লাব পাঁচ বছর ধরে সরকারি অনুদান পাবে। প্রথম বছর দু’লক্ষ টাকা, পরের চার বছর এক লক্ষ টাকা করে। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে আরও দু’হাজার ক্লাবকে অনুদান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তাতে নতুন ও পুরনো ক্লাব মিলিয়ে খরচ হয় ৬৪ কোটির কিছু বেশি। এ বার সেই খরচ ১২৪ কোটিতে পৌঁছে যাবে বলেই মনে করছেন প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা।
এ বার ক্লাবের সংখ্যা বাড়িয়ে অনুদান-বরাদ্দ দ্বিগুণ করা হল কেন?
রাজ্য ক্রীড়া দফতর এই নিয়ে মুখ খুলতে চায়নি। তবে প্রশাসনের একাংশের বক্তব্য, আগামী বছরের মাঝামাঝি রাজ্যে ৮৭টি পুরসভার নির্বাচন হওয়ার কথা। ভোট হবে কলকাতা পুরসভারও। তার আগে পাড়ার ক্লাবগুলিকে হাতে রাখতেই এই ঢালাও অর্থ বিলির সিদ্ধান্ত। তাঁদের মতে, গত তিন বছরে বিভিন্ন ঘটনায় শহরাঞ্চলে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়া অনেক বেশি তীব্র হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে একের পর এক মহিলা নিগ্রহের ঘটনা, শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্যের পরিবেশ, পরিবহণে সঙ্কট, সারদা-কাণ্ডে শাসক দলের একাধিক লোকের জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ, শিল্পে লগ্নি না আসা এবং নেতা-মন্ত্রীদের অস্থির আচরণ। অতীতে কামদুনি কিংবা সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় হাজারো মানুষের রাস্তায় নামা সেই বার্তাই দিচ্ছে। লোকসভা ভোটের ফল বিচার করলেও বিভিন্ন পুরসভা এলাকায় পিছিয়ে রয়েছে শাসক দল। সরকারি কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, এই প্রেক্ষাপটে আগামী বছর পুরভোটে (প্রায় অর্ধেক বিধানসভা এলাকা) বিন্দুমাত্র ঝুঁকি নিতে চাইছেন না মুখ্যমন্ত্রী। তাই অনুদানের নামে যথেচ্ছ সরকারি টাকা বিলিয়ে ক্লাবগুলির মাধ্যমে এলাকায় নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে চাইছে শাসক দল।
বিরোধীদেরও বক্তব্য, ভোটের বাজারে ক্লাবগুলিকে শাসক দলের পাশে রাখতে প্রতি বছরই অনুদান দেওয়া হচ্ছে। বাম জমানার এক প্রাক্তন মন্ত্রীর কথায়, “আমাদের সময়ে সুভাষদা’ও (চক্রবর্তী) বিভিন্ন ক্লাব বা সংগঠনকে হাতে রাখার চেষ্টা করতেন। কিন্তু জনগণের করের টাকা এ ভাবে যথেচ্ছ বিলিয়ে বেড়ানোর কোনও ব্যাপার ছিল না!” বিরোধীদের একাংশ এমনও বলছেন, ক্ষমতায় থাকার সময় বামেরা নিজস্ব সংগঠনের উপরে ভরসা করত বেশি। কিন্তু স্থানীয় স্তরে নিয়ন্ত্রণ রাখতে তৃণমূল আর্থিক অনুদান দিয়ে ক্লাবগুলিকে কাছে টানার রাস্তায় গিয়েছে। টানাটানির বাজারে কেন রাজ্য সরকার ক্লাবের অনুদানে আরও বেশি টাকা খরচ করতে চলেছে, সে ব্যাপারে ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্রের বক্তব্য অবশ্য জানা যায়নি। ফোন বা এসএমএসের উত্তর পাওয়া যায়নি তাঁর দিক থেকে।
২০১১ সালে ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার আগে সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেন এই এলাকার ২৭টি ক্লাবকে এক কোটি টাকা দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ।
সেই জের টেনেই বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, “দলের প্রভাব বাড়াতে সরকারি টাকা নয়ছয় হচ্ছে। আগামী বছর পুরসভার ভোট। তার আগে ক্লাবগুলিকে টাকা দিয়ে হাত করার চেষ্টা হচ্ছে। পুরভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকবে না। তাই স্থানীয় ক্লাবগুলিকে হাতে রাখতে পারলে ভোটে প্রভাব খাটানো যাবে বলে মনে করছেন তৃণমূল নেতারা।”
রাজ্য সরকারের বেহিসেবি খরচ আর তা সামাল দিতে ফি মাসে ধার করার সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্প্রতি উদ্বেগ জানিয়েছে প্রিন্সিপ্যাল অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল (পিএজি)-এর দফতর। তারা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, বাজেট বরাদ্দের মাত্র ২৭% পরিকল্পনা খাতে রেখেছে রাজ্য। বাকি টাকা ব্যয় হচ্ছে পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতে। যার মধ্যে মেলা-খেলা-উৎসব-পুরস্কার, ইমাম-মোয়াজ্জিনদের ভাতা, যত্রতত্র নীল-সাদা রঙ করতেই বিস্তর খরচ হচ্ছে। এতে রাজ্যের কোনও দীর্ঘমেয়াদি লাভ হচ্ছে না।
এই অবস্থায় ক্রীড়া দফতরের পরিকল্পনা বরাদ্দের টাকাও জলে দেওয়ার বন্দোবস্ত হচ্ছে বলে জানান দফতরের একাধিক কর্তা। চলতি অর্থবর্ষে পরিকল্পনা খাতে দফতরের বরাদ্দ ১৪২ কোটি টাকা। তার মধ্যে ১২৩ কোটি ৯৫ লক্ষ টাকা দেওয়া হচ্ছে ক্লাবগুলিকে। সরকারের এক ক্রীড়াকর্তা জানান, পরিকল্পনা খাতের টাকা খেলাধুলোর উন্নয়নে খরচ করার কথা। ক্লাবগুলিকে টাকা বিলিয়ে যে সেই কাজ হয় না, তা অতীত অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত। তাঁর কথায়, “ফুটবল ও ক্রিকেট ক্লাবগুলি বহু স্পনসর পায়। অথচ কবাডি, সাঁতার, অ্যাথলেটিকস, পর্বতারোহণ, টেবিল টেনিসের মতো বেশ কিছু খেলা রয়েছে, যেগুলি স্পনসরদের কাছে ব্রাত্য। ওই সব খেলার উন্নয়নে সাধারণত সরকার টাকা খরচ করে।” তাঁর অভিযোগ, পরিকল্পনার টাকায় জেলা-স্টেডিয়াম সংস্কারের কাজ করা যেতে পারে। কিন্তু খয়রাতির টাকা অধিকাংশই বেহিসেবি খরচ করে।
যেমন, গড়িয়ার একটি ক্লাব অনুদানের টাকায় ক্লাবঘর দোতলা করেছে। এখন সেটা বিয়েবাড়ি হিসাবে ভাড়া দিয়ে আয়ের রাস্তা তৈরি হয়েছে বলে সগর্বে জানাচ্ছেন ক্লাব-কর্তারা। এই পথেই হেঁটেছে রাজ্যের বহু ক্লাব। অথচ অন্য এমন ক্লাব, যেখানে নিয়মিত খেলাধুলোর চর্চা হয়, তারা সরকারি অনুদান থেকে বঞ্চিত রয়ে গিয়েছে। জঙ্গলমহলের কয়েকটি ক্লাব জানিয়েছে, অনুদানের টাকায় তারা গ্রামের রাস্তা তৈরি করেছে। নদিয়ার কয়েকটি ক্লাব অনুদানের টাকায় একটি অ্যাম্বুল্যান্স কিনে তা ভাড়া খাটাচ্ছে। এমন অনেক ক্লাব রয়েছে, যারা স্রেফ খাওয়া-দাওয়া, পিকনিক করেই পুরো টাকা নয়ছয় করেছে!
নিয়ম হল, কোনও ক্লাবকে অনুদান দেওয়ার আগে তার নথিভুক্ত হওয়ার শংসাপত্র, তিন বছরের অডিট রিপোর্ট এবং ক্লাবের সভার কার্যবিবরণী, ক্লাবের নিজস্ব জমি এবং ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের প্রমাণপত্র-সহ বেশ কিছু নথি দেখে নেওয়া। পরবর্তী অনুদান দেওয়ার আগে কী ভাবে আগে পাওয়া অর্থ খরচ হয়েছে তার ‘ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট’ও দেখা হয়। সরকারের দাবি, ক্লাবের দেওয়া তথ্য খতিয়ে দেখতে একটি কমিটি তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু গত দু’বছরে বহু ক্ষেত্রে অভিযোগ উঠেছে, অনুদান পাওয়ার জন্য শাসক দলের স্থানীয় বিধায়কের সুপারিশই মূল মাপকাঠি হিসাবে দেখা হয়েছে।
নিয়ম-কানুন আপাতত শিকেয়! ভোটের মুখে পাড়ার ক্লাবকে খয়রাতি দিতে রাজ্য সরকার অকৃপণ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy