প্রকাশ্য সভামঞ্চে বক্তৃতায় দলীয় কর্মীদের উদ্দেশে তাঁর আহ্বান ছিল, পুলিশের উপরে বোমা মারুন। বছর গড়াতে চললেও বক্তা, অর্থাৎ তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলকে কেন গ্রেফতার করা হল না?
সোমবার পাড়ুই মামলার শুনানিতে সে প্রশ্নই তুলল কলকাতা হাইকোর্ট। এবং রাজ্য পুলিশের ডিজি-র কাছে জানতে চাইল, গত বছরের ১৭ জুলাই বীরভূমের কসবা গ্রামের কর্মিসভায় অনুব্রতবাবু এ হেন উক্তি করার সঙ্গে সঙ্গে কেন তাঁকে গ্রেফতার করা হয়নি। অনুব্রতবাবুর বিরুদ্ধে প্রশাসন শেষমেশ কী ব্যবস্থা নিল, পরশু বৃহস্পতিবারের মধ্যে রাজ্যের কাছ থেকে হাইকোর্ট সে সম্পর্কে অবহিত হতে চায়। আর সেই রিপোর্টের উপরেই পাড়ুই-মামলার ভবিষ্যৎ কার্যত নির্ভর করছে বলে এ দিন জানিয়ে দিয়েছেন বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত।
প্রসঙ্গত, বীরভূমের পাড়ুই থানা-এলাকার কসবা গ্রামের বাসিন্দা সাগর ঘোষের হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত মামলাটির চূড়ান্ত রায় এ দিনই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হাইকোর্ট রায় দেয়নি। কী হল এ দিন আদালতে?
শুনানির সূচনায় বিচারপতি দত্ত বলেন, তিনি দু’টি বৈদ্যুতিন মাধ্যম থেকে পাওয়া দু’টি সিডি আদালতে বসে দেখতে চান। সেগুলো তৃণমূলের সেই কর্মিসভার সিডি, কসবা গ্রামে যার আয়োজন হয়েছিল গত ১৭ জুলাই, পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্কালে। আদালতের সিদ্ধান্ত শুনে জিপি (গভর্নমেন্ট প্লিডার) অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় বিচারপতিকে অনুরোধ করেন, এজলাসে যেন সিডি না চলে। “আপনি চেম্বারে বসে দেখুন।” বিচারপতিকে বলেন জিপি। বিচারপতি জবাব দেন, “রিজওয়ানুর-মামলাতেও আমি এজলাসে বসে সিডি দেখেছি। তখন আপনি কোথায় ছিলেন?”
বিচারপতি দত্ত তাঁর ল্যাপটপে একটা সিডি চালিয়ে দেন।
আদালতকক্ষ জুড়ে গম গম করে বাজতে থাকে অনুব্রত মণ্ডলের কণ্ঠস্বর ‘কসবায় কোনও নির্দল প্রার্থী যদি বাড়িতে গিয়ে হুমকি দেয়, তার বাড়িটা ভেঙে, জ্বালিয়ে দিন। কোনও নির্দল প্রার্থী যদি কোনও হুমকি দেয়, তার বাড়িতে চড়াও হোন। এটাই কিন্তু আমি বলতে এসেছি আপনাদের। আর যদি কোনও প্রশাসন ভাবে যে, নির্দলকে সমর্থন করবে, সেই প্রশাসনের পুলিশের উপরে বোমা মারুন। আমি বলছি বোমা মারতে।’
এ পর্যন্ত শুনে বিচারপতি দত্ত ল্যাপটপ বন্ধ করেন। বলেন, “এই হচ্ছেন রাজনৈতিক নেতা! আর এই তাঁর উক্তি! এ বার কী বলবেন!” আদালতের প্রশ্ন, “যে ভাবে সরাসরি পুলিশকে বোমা মারতে বলা হচ্ছে, তা বিচারযোগ্য অপরাধ! পুলিশ কী করছিল? সভাস্থলেও তো পুলিশ ছিল! এক বছর কাটতে চলল। পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছে কি? এত দিনে ডিজি-ই বা কী করলেন?” এক জন রাজনৈতিক নেতা এ ভাবে পুলিশ-প্রশাসনের দিকে ‘চ্যালেঞ্জ’ ছোড়ায় বিস্ময় প্রকাশ করে বিচারপতি দত্ত বলেন, “পুলিশের উচিত ছিল ১৭ জুলাই-ই ওই নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।”
আর এত দিনেও পুলিশ কাজটা করে উঠতে না-পারায় আদালত পুলিশি তদন্তে কী ভাবে আস্থা রাখবে, সে প্রশ্নও তোলেন বিচারপতি দত্ত। জিপি’র ব্যাখ্যা, “আজকাল রাজনৈতিক নেতারা এ রকম সব কথা বলেন।”
শুনে বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, “ওঁরা যে-ই হোন না কেন, যা খুশি তা-ই বলতে পারেন না। ওঁদেরও কথা বলার একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা প্রত্যেকে সংবিধানের কাছে দায়বদ্ধ। আদালত সে দায়বদ্ধতাকে অস্বীকার করতে পারে না।” এর পরে জিপি’র উদ্দেশে বিচারপতির মন্তব্য, “আমার মনে হচ্ছে, ডিজি বোধহয় সিডিটি দেখেননি। ওঁকে বলবেন দেখে নিতে। তা হলে উনি বুঝতে পারবেন, কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”
গত বছরের ২১ জুলাই, অর্থাৎ চতুর্থ দফার পঞ্চায়েত ভোটের আগের রাতে পাড়ুইয়ের কসবা গ্রামের বাঁধ নবগ্রামে খুন হন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলকর্মী সাগরবাবু, যাঁর ছেলে হৃদয় ঘোষ নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। পুত্রবধূ শিবানীদেবী অভিযোগ ছিল, শ্বশুরমশাইকে আহত অবস্থায় ফেলে রেখে পুলিশ জবরদস্তি তাঁদের দিয়ে সাদা কাগজে সই করিয়ে নিয়েছে, এবং তাতে ক’জনের নাম লিখে সেই সব ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে আসল অপরাধীদের আড়াল করেছে। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে পুলিশ সাগর-হত্যার এফআইআর নেয়, যাতে অনুব্রত মণ্ডলের পাশাপাশি বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরীরও নাম আছে। এফআইআরে উল্লিখিত তৃতীয় ব্যক্তি গ্রেফতার হলেও অনুব্রত-বিকাশ এখনও অধরা।
এ দিকে সাগর খুনের অভিযোগে পুলিশ যাঁদের গ্রেফতার করেছিল, তাঁরা জামিন পেয়ে ঘটনার সিবিআই-তদন্তের আর্জি জানিয়ে হাইকোর্টে মামলা করেন। পরে সাগরবাবুর পরিবার মামলায় সামিল হয়। কোর্টের কাছে পরিজনদের দেওয়া জবানবন্দিতেও অভিযুক্ত-তালিকায় অনুব্রতের নাম রয়েছে এক নম্বরে।
এমতাবস্থায় গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পাড়ুই-তদন্তে বিশেষ দল (সিট) গড়ে দিয়ে হাইকোর্ট রাজ্য পুলিশের ডিজি’কে মূল তদন্তকারী নিযুক্ত করে। তদন্তের প্রথম অগ্রগতি-রিপোর্ট হাইকোর্টকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। সিটের পরবর্তী রিপোর্টও কোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছে। ইতিমধ্যে ডিজি জিএমপি রেড্ডি নির্বাচনী দায়িত্বের যুক্তি দেখিয়ে পাড়ুই-তদন্তের ভার ছাড়তে চাওয়ায় আদালত ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
ডিজি অবশ্য এ দিন আদালতে একটি রিপোর্ট দিয়ে স্বীকার করেছেন, পাড়ুই-তদন্তের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়ে তিনি ঠিক কাজ করেননি। এ জন্য আদালতের কাছে ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছেন ডিজি। অন্য দিকে অনুব্রতের কর্মিসভাটির একটি সম্পাদিত সিডি জমা দিতে চেয়ে রাজ্য সরকারের তরফে হাইকোর্টে আবেদন পেশ করা হয়।
আদালত সিডি পেশের অনুমতি দিয়েছে। পাশাপাশি জানিয়ে দিয়েছে, সবই করতে হবে বৃহস্পতিবারের মধ্যে। “বৃহস্পতিবারের মধ্যে জানাতে হবে, পুলিশ অনুব্রতের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে কী ব্যবস্থা নিল। আদালত সন্তুষ্ট হলে অন্য কথা। নচেৎ সিবিআই-তদন্তের জন্য তৈরি থাকতে হবে।” বলেছেন বিচারপতি দত্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy