মেহদি মসরুর বিশ্বাস
হুজি, সিমি, আল কায়দা, ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন, জেএমবি-র পরে এ বার আইএস (ইসলামিক স্টেট) জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গেও কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের নাম জুড়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠল।
পশ্চিম এশিয়ায় সক্রিয় জঙ্গি সংগঠন আইএস-এর সব চেয়ে প্রভাবশালী টুইটার অ্যাকাউন্ট বেঙ্গালুরু থেকে চালানোর অভিযোগে পুলিশ যাঁকে গ্রেফতার করেছে, বছর চব্বিশের সেই মেহদি মসরুর বিশ্বাসের বাড়ি কলকাতায়। বিমানবন্দরের কাছে কৈখালির বিমাননগরে। ওই তল্লাট বিধাননগর কমিশনারেটের বিমানবন্দর থানা এলাকার অন্তর্গত। এর আগে আইএস যোগে প্রবাসী কিছু বাংলাদেশির নাম উঠলেও এই প্রথম পশ্চিমবঙ্গের কোনও বাসিন্দা এই অভিযোগে গ্রেফতার হলেন। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার ওই যুবক ২০১২ থেকে কর্মসূত্রে বেঙ্গালুরুতে রয়েছেন।
পশ্চিম এশিয়ার ইরাক ও সিরিয়ার একটা অঞ্চল এখন কট্টর ইসলামি জঙ্গি আইএস-এর দখলে। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের শিরচ্ছেদে সিদ্ধহস্ত এই সংগঠনে নাম লেখানো জঙ্গিরা। আইএস-এর হাতে শিরচ্ছেদের বেশ কয়েকটি ভিডিও সম্প্রতি প্রকাশিত হওয়ার পরে তাদের নিষ্ঠুরতায় বিশ্ববাসী স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছেন। দিন কয়েক আগে ইরাকে ৪ সদ্যকিশোরকে মাথা কেটে হত্যা করেছে আইএস জঙ্গিরা। ভিন রাজ্যের পুলিশ এমন একটি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে কলকাতার এক যুবকের নাম জড়িয়ে অভিযোগ তোলায় উদ্বিগ্ন পশ্চিমবঙ্গের গোয়েন্দা সংস্থাগুলিও।
বেঙ্গালুরুতে তাঁর ফ্ল্যাট থেকেই শুক্রবার গভীর রাতে কর্নাটক পুলিশ গ্রেফতার করেছে মেহদিকে। বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনের (ইউএপিএ) পাশাপাশি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মতো কঠোর অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেছে পুলিশ। মামলা দায়ের করা হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি আইনেও। তদন্তকারীদের দাবি, গ্রেফতার হওয়ার সময়ে মেহদির মধ্যে অনুশোচনার লেশমাত্র দেখা যায়নি। পুলিশকে তিনি বাধা দেওয়ার চেষ্টাও করেননি। তবে কলকাতায় মেহদির বাবা মেকাইল বিশ্বাস তাঁকে নির্দোষ বলে দাবি করেছেন। তাঁর দাবি, সাইবার দুনিয়ায় অন্য কারও কারসাজিতেই তাঁকে ফাঁসতে হয়েছে।
‘শামি উইটনেস’ নামে একটি টুইটার অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে মেহদি প্রচার চালাতেন বলে বৃহস্পতিবার একটি ব্রিটিশ টেলিভিশন চ্যানেল তার খবরে জানায়। চ্যানেলটি জানায়, তারা মেহদির সঙ্গে যোগাযোগ করার পরেই তিনি ‘শামি উইটনেস’ টুইটার অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করে দেন। প্রতি মাসে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ এই অ্যাকাউন্টের টুইট দেখতেন। টুইটারে শামি উইটনেস-এর ‘ফলোয়ার’-এর সংখ্যা ছিল ১৭ হাজারেরও বেশি।
কী ভাবে ব্রিটিশ চ্যানেলটি মেহেদি পর্যন্ত পৌঁছল?
তাদের দাবি, ‘আল-সালতাদোর’ নামে অন্য একটি টুইটার অ্যাকাউন্টও ব্যবহার করতেন মেহদি। একই নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ও গুগল প্লাস পেজ-ও ছিল তাঁর। সেখান থেকে মেহদির ছবি মেলে ও কোথায় বসে ‘শামি উইটনেস’ অ্যাকাউন্ট টুইটারে চালাচ্ছেন, তার হদিস মেলে। চ্যানেলটি তার খবরে ওই যুবককে শুধু ‘মেহদি’ বলেই উল্লেখ করেছিল।
ওই চ্যানেলকে দেওয়া দু’মিনিট বারো সেকেন্ডের সাক্ষাৎকারে মেহদি বলেন, “আমি কোনও অন্যায় করিনি। কোনও আইন ভাঙিনি। ভারতের জনসাধারণের বিরুদ্ধে কোনও হিংসা বা যুদ্ধের প্রচার করিনি। ভারতের কোনও প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কথাও বলিনি।” ওই সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে মেহদির বক্তব্য, “জানাতে চাই, সময় এলে আমার গ্রেফতারিতেও বাধা দেব না। আমার কাছে কোনও অস্ত্র নেই।” চ্যানেলটি মেহদিকে উদ্ধৃত করে জানায়, পরিবার তাঁর উপর আর্থিক ভাবে নির্ভরশীল বলে ইচ্ছে সত্ত্বেও তিনি ইরাক ও সিরিয়ার জেহাদিদের সঙ্গে যোগ দেননি।
তার পরেই একটি দল তৈরি করে ওই যুবকের সন্ধানে নামে বেঙ্গালুরু পুলিশ। ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এসআই ৫-এর দেওয়া তথ্য থেকেই মেহদিকে চিহ্নিত করে পুলিশ। তাদের দাবি, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে টুইটার অ্যাকাউন্টটি চালাচ্ছিলেন বলে মেহদি স্বীকার করেছেন। ওয়েস্ট বেঙ্গল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি-র ছাত্র মেহদি বেঙ্গালুরুতে একটি বহুজাতিক সংস্থায় ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কমর্রত। বেতন বছরে পাঁচ লক্ষ তিরিশ হাজার। তাঁর সংস্থার এক কর্তা জানিয়েছেন, পুলিশকে তদন্তে সহযোগিতা করবেন তাঁরা।
ওই বাঙালি যুবকের গ্রেফতারির খবর ঘোষণা করে কর্নাটক পুলিশের ডিজি লালরোখুমা পাচুয়াউ বলেন, “মেহদি দিনের বেলা অফিসে কাজ করতেন আর গভীর রাতে তাঁর বিচরণ ছিল ইন্টারনেট দুনিয়ায়। ডিজিপি-র বক্তব্য তুরস্ক, সিরিয়া, লেবানন, ইজরায়েল, গাজা ভূখণ্ড, মিশর ও লিবিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে মেহদির উৎসাহ ছিল। আইএস সংক্রান্ত খবর ও ওয়েবসাইট দেখার জন্য মেহদি মাসে ৬০ জিবি-র ইন্টারনেট সংযোগ নেন বলে ডিজিপি-র দাবি।
পুলিশের দাবি, ইংরেজিভাষী জঙ্গিদের সঙ্গে যোগ ছিল মেহদির। আইএস-এর নতুন সদস্যদের কাছে কলকাতার ওই যুবক ছিলেন উৎসাহ ও তথ্যের বড় উৎস। তবে পরিচয় গোপন রাখার ক্ষেত্রে মেহদি সাবধানী ছিলেন। বেঙ্গালুরুর পুলিশ কমিশনার এম এন রেড্ডি বলেন, “আরবি ভাষার টুইটগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করে মেহদি জেহাদি আদর্শের প্রতি ঝোঁক থাকা ইংরেজিভাষী মানুষের মধ্যে ছড়াতেন।” তবে মেহদির বাবার দাবি, তাঁর ছেলে আরবি ভাষা জানেই না।
তদন্তকারীদের এক সূত্রের খবর, মেহদির সঙ্গে আইএস বা আল-কায়দার মতো জঙ্গি সংগঠনের সরাসরি যোগের প্রমাণ মেলেনি। তাঁর সঙ্গে জেহাদি মনোভাবাপন্ন লোকজন দেখা করতে আসতেন, সে প্রমাণও নেই। গোয়েন্দাদের একাংশের ধারণা, নিজেই কট্টর মনোভাবাপন্ন হিসেবে তৈরি হন ওই যুবক এবং তাঁর চলাফেরা সীমাবদ্ধ ছিল সাইবার দুনিয়ায়। তদন্তকারীদের দাবি, মেহদি নানা তথ্য ও ভিডিও টুইটারের ‘শামি উইটনেস’ অ্যাকাউন্টে পোস্ট করতেন। তবে সাইবার দুনিয়ায় তাঁর অধিকাংশ কীর্তির চিহ্নই মুছে ফেলা হয়েছে। তা পুনরুদ্ধার করতে টুইটারের সাহায্য চেয়েছে পুলিশ। ভারত-বিরোধী কার্যকলাপ বা ভারতে কোনও সম্ভাব্য জঙ্গি হামলার প্রসঙ্গে প্রচার বা এই সংক্রান্ত টুইট মেহদি করেছেন বলে প্রমাণ মেলেনি।
এক তদন্তকারী অফিসারের কথায়, “মেহদি আইএসের সদস্য নিয়োগ করতেন বা নিজে জঙ্গি ছিলেন, তা হয়ত নয়। মনে হচ্ছে, মেহদি ইসলামিক স্টেট-এর এক জন প্রচারক।” মেহদি কখনও দেশের বাইরে যাননি বলেও জানান। মেহেদিকে জেরা করতে শনিবার এনআইএ (জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা)-র দল বেঙ্গালুরুতে পৌঁছেছে।
তবে আইএস-এর প্রচারক হিসেবে বাঙালি যুবক যে রাজ্যে গ্রেফতার হলেন, সেই কর্নাটকের সঙ্গে জেহাদি জঙ্গিদের সম্পর্ক রয়েছে। কর্নাটকের ভটকল শহরের দুই ভাই রিয়াজ ও ইকবাল ভারতীয় জঙ্গি সংগঠন আইএম-এর দুই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। পুলিশের নথি অনুযায়ী, এখনও পর্যন্ত ভারতে ২১টি সন্ত্রাসবাদী হামলা চালিয়েছে এই আইএম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy