সুন্দরবনের উপকূলবর্তী দ্বীপগুলির জনজীবন স্বনির্ভর হচ্ছে ‘জিরো টিলেজ’ বা বিনা কর্ষণে চাষের এই নতুন পদ্ধতিতে। প্রতীকী ছবি।
ঢাল-তরোয়াল ছাড়া যুদ্ধ করা কত কঠিন, সেই যুদ্ধের সৈনিকেরাই তা জানেন। তবে লাঙল-বলদ ছাড়াও যে নোনা জমিতে অঢেল ফসল ফলানো যায়, তা দেখাচ্ছেন সুন্দরবনের মহিলারা। প্রকৃতির রোষে নোনা জল ঢুকে চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়া বিঘের পর বিঘে জমিতে এখন আলু, পটল, পেঁয়াজ, কুমড়ো ফলছে টন টন। বিনা লাঙলেই। চাষিরা অধিকাংশই মহিলা। ঘরের প্রয়োজন যতটুকু, তা সঞ্চয়ে রেখে রেখে বাজারজাত করা হচ্ছে সেই শস্য। এই উৎপাদন ব্যবস্থায় খরচ ন্যূনতম। তদুপরি রাসায়নিক সারের কোনও ব্যবহার না-থাকায় টাটকা আনাজের চাহিদাও বেড়েছে বহু গুণ। সুন্দরবনের উপকূলবর্তী দ্বীপগুলির জনজীবন স্বনির্ভর হচ্ছে ‘জিরো টিলেজ’ বা বিনা কর্ষণে চাষের এই নতুন পদ্ধতিতে।
গত দেড় দশকের আবহাওয়া ও জলবায়ুর খামখেয়ালিপনা বদলে দিয়েছে সনাতনী বর্ষাসূচি। আয়লা, আমপান, বুলবুল, ইয়াসের মতো একের পর এক ঘূর্ণিঝড় সুন্দরবনের চাষের জমিকে বার বার লবণাক্ত করে দিয়েছে। এমনিতেই সেচের জলের সঙ্কটে ধান রোয়ার সময় জমি কাদা করা যায় না। তার উপরে বর্ষাবাদলে নদীবাঁধ ভেঙে নোনা জল ঢুকে ঘরবাড়ি ভাসানোর পাশাপাশি কৃষিজমিকে রবিশস্য চাষের অনুপযোগী করে তুলছে। শেষ ছোবল মেরেছে চারটি ঘূর্ণিঝড়। নোনা জমিতে চাষের আশা ছেড়ে তাই কাজের খোঁজে ভিন্ রাজ্যে চলে গিয়েছিলেন অধিকাংশ চাষি। হাল ছেড়ে দেওয়া চাষি পরিবারগুলির মহিলারাই বাঁচার তাগিদে নতুন পদ্ধতিতে সুন্দরবনের মাটিকে সুজলা-সুফলা করে তুলেছেন কৃষিবিজ্ঞানীদের পরামর্শে। দেখছেন স্বনির্ভরতার নতুন দিশা। লবণাক্ত মাটিতেও যে পুরোদমে চাষ সম্ভব, তা বুঝতে পেরে চাষের কাজে ফিরতে চাইছেন কৃষক পরিবারের পুরুষেরাও।
আয়লার পরে সুন্দরবনের বালি, সাতজেলিয়া, ছোট মোল্লাখালি, চণ্ডীপুর, গোসাবা, জটিরামপুর অঞ্চলে অধিকাংশ জমিই বহু বছর এক-ফসলি ছিল। এখন সেগুলি তিন-ফসলি। আমন ধান কাটার পরে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সেই জমিতেই পড়ে থাকা ধানের নাড়ার সারির মাঝখানে আলু, পেঁয়াজ, রসুন, কুমড়োর বীজ বপন করা হয় কোনও রকম চাষ ছাড়াই। নাড়ার সারির মাঝখানে না-চষা মাটিতে জৈব সার দিয়ে তার উপরেই বসানো হয় আনাজের বীজ। মুঠো ভরে জৈব সার নিয়ে সেই বীজ চাপা দিতে হয়। খড়চাপা থাকায় মাটি থেকে বাষ্পীভবন কমে। ফলে মাটির জল সংরক্ষিত হয় এবং নুন আর মাটির উপরের স্তরে পৌঁছতে পারে না। সংক্ষেপে বিনা কর্ষণের চাষ এটাই।
বাড়ির লাগোয়া আলু, পেঁয়াজের দশ কাঠা জমি ঘুরিয়ে দেখাতে গিয়ে এই কৃষি-পদ্ধতি নিখুঁত ভাবে বোঝালেন জটিরামপুর তারাপুকুরের রিনা মণ্ডল। এই অঞ্চলে তারাপুকুরই মিষ্টি জলের একমাত্র আধার। এর উপরে ভর করেই যাবতীয় চাষ-আবাদ চলে। রিনা, ঊর্মিলা, বিচিত্রাদের মতো অসংখ্য মহিলা সংসার সামলে গড়ে তুলেছেন চাষি সঙ্ঘ। ভাল বীজ, ভাল আনাজের আরও বেশি জোগান, বাজারজাত করা— এই সব কাজ নিয়ে নিত্য আলোচনা হয় তাঁদের।
একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত সুন্দরবনের এই দ্বীপগুলি এখন আন্তর্জাতিক কৃষি মানচিত্রে ‘মডেল’ বা আদর্শ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় বিজ্ঞান সংস্থা, কেন্দ্রীয় মৃত্তিকা লবণতা গবেষণা সংস্থা, বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ এডুকেশনাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সঙ্গে স্থানীয় টেগোর সোসাইটির সদস্যদের কয়েক জন এই পরিবর্তনের সমবেত কান্ডারি— বলছেন গ্রামবাসীরা। অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় বিজ্ঞান সংস্থার প্রবীণ গবেষক মোহাম্মদ মৈনুদ্দিন আদতে বাংলাদেশের বাসিন্দা। সম্প্রতি তাঁর নেতৃত্বে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ, আর্জেন্টিনা, ফিজ়ির ১১ জন কৃষিবিজ্ঞানী ও গবেষক দু’দিন ধরে ‘ফিল্ড ভিজ়িট’ বা সরেজমিনে পরিদর্শন চালিয়েছেন এই সব দ্বীপে। মৈনুদ্দিন বলেন, ‘‘শুধু পরীক্ষামূলক নয়, সুন্দরবনের এই বিনা কর্ষণের চাষ বাণিজ্যিক ভাবেও সফল। এটা এখন সারা বিশ্বের কাছে রোল মডেল।’’
চাষের এই নতুন পদ্ধতিতে সুন্দরবন যেমন বাঁচার দিশা পেয়েছে, বিশ্বের সর্বপ্রান্তে অনুরূপ সমস্যায় পীড়িত মানুষকেও দিশা দেখাচ্ছে। সর্বোপরি নোনা জমিতে কৃষিকাজের আশা বিসর্জন দিয়ে যাঁরা পরিযায়ী শ্রমিকের কাজে চলে গিয়েছিলেন, সেই দিনেশ মণ্ডল, আতিকুর রহমানদের ফের ঘরমুখী করেছে এই বিনা কর্ষণের চাষ। বছরখানেক আগে ভিটেমাটিতে ফিরে এসে স্ত্রী-কন্যাদের সঙ্গে তাঁরাও হাত লাগিয়েছেন নতুন পদ্ধতির চাষে। মানবজমিনের এই আবাদেই সোনা ফলাচ্ছে সুন্দরবন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy