প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ‘অগ্নিপথ’ নিয়ে বাঙালির তেমন আগ্রহ নেই। অন্তত সেনায় ভর্তি হওয়ার প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে তেমনই দেখছেন প্রশিক্ষকেরা।
অমিতাভ বচ্চনের ‘অগ্নিপথ’ দেখেছেন? বা হৃতিক রোশনের? গড়পড়তা বাঙালি বলবেন, দেখেছেন। কিন্তু প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ‘অগ্নিপথ’ নিয়ে বাঙালির তেমন আগ্রহ নেই। অন্তত সেনায় ভর্তি হওয়ার প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে তেমনই দেখছেন প্রশিক্ষকেরা।
প্রাক্তন সেনাকর্তা কর্নেল কৃষ্ণেন্দু ভট্টাচার্যের বক্তব্য, সিনেমায় সেনানায়কের বীরত্ব দেখলে একটু-আধটু ইচ্ছা তৈরি হলেও আদতে বাঙালি বাড়ির ছেলেমেয়েরা সৈনিকের আগুনে পথ মাড়াতে চান না। সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর বারাসতে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলেছেন কৃষ্ণেন্দু। সেখানে আসা আগ্রহীদের দেখেই তাঁর বক্তব্য, ‘‘বায়ু বা নৌসেনায় যোগ দিতে চাওয়া বাঙালি তবুও আছেন। কিন্তু স্থলসেনায় যোগ দিতে চান খুব কম ছেলেমেয়ে।’’
কেন্দ্রের অগ্নিপথ প্রকল্পে চুক্তির ভিত্তিতে কম সময়ের জন্য সেনা নিয়োগ ঘিরে দেশজুড়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। শুরু হয়েছে ধংসাত্মক এবং হিংসাত্মক বিক্ষোভ। অনেকে যেমন এর সমালোচনা করছেন, তেমনই একাংশের দাবি, কর্মসংস্থানের নতুন দিশা দেখাতে পারে এই প্রকল্প। কিন্তু তাতে বাঙালির বিশেষ কিছু যাবে আসবে না বলেই মনে করেন কৃষ্ণেন্দু। তাঁর কথায়, ‘‘বাঙালির সেনা হওয়ার প্রতি অনাগ্রহের পিছনে অনেক কারণ আছে। তার মধ্যে আসল কারণটা হল, বাঙালি ছেলেমেয়েদের মধ্যে সেই আগুনটাই নেই। কারও কারও ইচ্ছে থাকলেও যে পরিশ্রম করা দরকার, সেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কেউ করতে চায় না।
সেনাবাহিনীতে চাকরি পাওয়ার কোনও শর্টকাট নেই। কিন্তু বাঙালি ছেলেমেয়েরা সেটাই চায়।’’ ইচ্ছার সঙ্গে সঙ্গে মেধার দিক থেকেও বাঙালি পিছিয়ে বলে মনে করেন কর্নেল কৃষ্ণেন্দু। তিনি বলেন, ‘‘অফিসার পর্যায়ের পরীক্ষার জন্য চাই মেধা। যাঁরা প্রশিক্ষণ নিতে আসেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই দেখা যায় ইংরেজি এবং হিন্দিতে লেখা বা বলায় দুর্বলতা রয়েছে।’’ কৃষ্ণেন্দু আরও জানান, তিনি যখন সেনাবাহিনীতে ছিলেন, তখনও বাঙালি কম ছিল। কিন্তু এখন দিন দিন সেটা আরও কমছে। তাঁর কাছে যাঁরা আসেন, তাঁদের মধ্যে ৩ থেকে ৪ শতাংশ ছোটবেলা থেকে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন। বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই এই চাকরি তৃতীয় বা চতুর্থ পছন্দের।
বাংলার ছেলেমেয়েদের আগ্রহ যে কম, তা বলছেন কলকাতা শহরে সেনায় চাকরির পরীক্ষার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালানো জয়দেব ঘড়ও। কালীঘাটে তাঁর কেন্দ্রের আশপাশে ভাড়ায় থেকে বিহারের ছেলেরা প্রশিক্ষণ নেয়। কিন্তু বাঙালি মেলে না। জয়দেব বলেন, ‘‘আমার কাছে বিহারের বিভিন্ন জায়গা থেকে ছেলেরা প্রশিক্ষণ নিতে আসে। অনেকেই ঝাড়খণ্ডের জামশেদপুরের বাসিন্দা। আর বাংলার যারা আছে, তাদের মধ্যেও বাংলাভাষী হাতে গোনা।’’ এর কারণ কী? জয়দেব বললেন, ‘‘আসলে বাঙালি ছেলেমেয়েরা প্রথমেই শিক্ষক হতে চায়। এসএসসি পরীক্ষায় বসাই বেশির ভাগের লক্ষ্য। বাবা-মায়েরাও সন্তানকে চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়র বানাতেই বেশি আগ্রহী।’’
ভবিষ্যতের সেনা হওয়ার বেসরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কর্মী সুমনা রায়েরও বক্তব্য, তাঁদের সংস্থাতেও বিহার, ঝাড়খণ্ড থেকে আসা ছেলেমেয়ের সংখ্যা বেশি। সুমনা বলেন, ‘‘সেনার অফিসারদের পরীক্ষার প্রশিক্ষণ দিই আমরা। কলকাতার ছেলেমেয়ে সে ভাবে পাওয়াই যায় না। কলকাতার ছেলেমেয়েদের মেধা থাকলেও আগ্রহ নেই। আর জেলা থেকে যাঁরা আসেন, তাঁদের আগ্রহের তুলনায় মেধা অনেক কম। ফলে সাফল্যও কম।’’
কৃষ্ণেন্দু অবশ্য বাঙালির সেনায় চাকরির ব্যাপারে অনীহার পিছনে আরও কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তাঁর বক্তব্য, অনেকেই শারীরিক সক্ষমতা দেখাতে পারেন না। বাঙালির গড় উচ্চতা, দুই হাঁটু ঠেকে যাওয়া, ছাতি ফোলাতে না পারার মতো সমস্যা রয়েছে। অনেকের আবার ইচ্ছে এবং যোগ্যতা থাকলেও পারিবারিক বাধা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কৃষ্ণেন্দুর কথায়, ‘‘আমার কাছে ছেলেকে ভর্তি করতে আসা অনেক বাবা-মা প্রশ্ন করেন, চাকরি পেলে কি গুলি ছুড়তে হবে? কত দিন পরে বাড়ি আসতে পারবে?’’
স্কুল থেকেই ছেলেমেয়েদের সেনায় যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা দরকার বলে মনে করেন কৃষ্ণেন্দু। একই সঙ্গে তাঁর দাবি, সেনা থেকে অবসরের পরে চাকরির সুযোগও রাজ্যে বাড়াতে হবে।
কলকাতার সংস্থাগুলি মূলত সেনায় অফিসার পদে যোগ দিতে চাওয়াদের প্রশিক্ষণ দেয়। রাজ্যের অনেক জায়গাতেই জওয়ান পদে যোগ দিতে আগ্রহীদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। তারা চিন্তিত ‘বিতর্কিত’ অগ্নিপথ প্রকল্প নিয়ে। বারুইপুরের এমনই এক সংস্থার কর্ণধার সুনয়ন নাথ বলেন, ‘‘অনেক দিন সেনায় নিয়োগ হয়নি। করোনাকালের আগে থেকে যাঁরা প্রস্তুতি নিয়েছেন, তাঁদের বয়স চলে যাচ্ছে। এমনিতেই বাঙালি ছেলেমেয়েদের আগ্রহ কম। তার উপর যাঁরা চেয়েছিলেন, তাঁরাও হতাশ। পরিশ্রমের সঙ্গে স্বপ্নও তো মিশে থাকে। পুরোপুরি চাকরির জন্য যারা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তাঁদের যদি এখন চুক্তিতে চার বছরের জন্য যোগ দিতে বলা হয়, তবে ক্ষোভ তো জন্মাবেই।’’
তবে কৃষ্ণেন্দু থেকে সুনয়ন— সকলেরই বক্তব্য, শহরে আগ্রহ কম হলেও গ্রামবাংলার অনেকে সেনায় যেতে চান। অনেকে ছোট থেকে প্রস্তুতি নেন। তাঁদের কথা মাথায় রেখেই খড়্গপুরে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র শুরু করেছেন সুমিত বেজ। অগ্নিপথ প্রকল্প নিয়ে তাঁর অভিমত, ‘‘নেই মামার চেয়ে তো কানা মামা ভাল! আগে তো উপার্জন শুরু হোক। আর যাঁদের ইচ্ছা থাকবে, তাঁরা তো ভাল কাজ করে যোগ্যতা দেখিয়ে স্থায়ী হতে পারবেনই।’’
বাঙালির অবশ্য সে সব শোনার বালাই নেই। তারা খুশি অমিতাভ এবং হৃতিকের ‘অগ্নিপথ’ নিয়ে।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy