মেয়ে সম্প্রীতির সঙ্গে পূর্ণিমা গড়াই। ফাইল চিত্র
রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ ফোন করে ছেলেকে পৌঁছনোর খবর দিয়েছিলেন বছর সাতচল্লিশের পূর্ণিমা গড়াই। মায়ের সঙ্গে কথা বলে ছেলেও নিশ্চিন্তে ঘুমোতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার কিছু ক্ষণ পরেই অঘটন।
২২ অগস্ট তারিখটা তাই চিরকালের মতোই কালো হয়ে রইল গড়াই পরিবারের কাছে। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে উত্তর ২৪ পরগনার কচুয়ায় লোকনাথ মন্দিরের সামনে পাঁচিল ভেঙে পড়ার ঘটনায় মারা যান রাজারহাট থানা এলাকার নয় পুকুরের বাসিন্দা পূর্ণিমা। ঠিক তিন বছর আগে, ২০১৬ সালের ২২ অগস্টেই কিডনির অসুখে ভুগে মারা গিয়েছিলেন তাঁর স্বামী সঞ্জয়।
পূর্ণিমার ছেলে সায়ন জানান, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ বাড়ি থেকে মোটরবাইকে কচুয়ার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন তাঁর মা। সঙ্গে একাদশ শ্রেণির ছাত্রী, পূর্ণিমার মেয়ে সম্প্রীতি ও তার এক বন্ধু। সায়ন বলেন, “মা ফোনে বলেছিল, পৌঁছে গিয়েছি। এ বার জল ঢালতে যাচ্ছি। শুনে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে গেলাম। কে জানত, সেটাই মায়ের সঙ্গে শেষ কথা!” এর ঘণ্টা দু’য়েকের মধ্যেই বোনের ফোন পান সায়ন। সম্প্রীতি তাঁকে জানায়, পুণ্যার্থীদের লাইন যখন মন্দিরের দিকে এগোচ্ছিল, তখনই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে পাঁচিল। আতঙ্কে ছোটাছুটি শুরু হতেই পদপিষ্ট হয়ে যান অনেকে। পড়ে গিয়েছিলেন পূর্ণিমাও।
ধর্মস্থানে পদপিষ্ট
• জুলাই, ২০১৫: অন্ধ্রপ্রদেশের রাজামুন্দ্রিতে পুস্করালু মেলায় মৃত ২৭।
• অক্টোবর, ২০১৩: নবরাত্রির সময়ে মধ্যপ্রদেশের রতনগড়মাতা মন্দিরের কাছে সেতুতে মৃত ১১৫।
• ফেব্রুয়ারি, ২০১২: গুজরাতের জুনাগড়ের ভবনাথ মন্দিরে শিবরাত্রির মেলায় মৃত ৬।
• জানুয়ারি, ২০১১: কেরলের শবরীমালা মন্দিরে মৃত ১০৬।
• মার্চ, ২০১০: উত্তরপ্রদেশের রাম-জানকী মন্দিরে মৃত ৬৩।
• সেপ্টেম্বর, ২০০৮: রাজস্থানের চামুণ্ডা দেবী মন্দিরে মৃত ১২০ জন।
• জুলাই, ২০০৮: পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে রথযাত্রার সময়ে মৃত্যু ৬ জনের।
• অগস্ট, ২০০৬: হিমাচলপ্রদেশের নয়না
দেবী মন্দিরে প্রাণ হারান ১৬০ জন।
• জানুয়ারি, ২০০৫: মহারাষ্ট্রের সাতারা জেলার মান্দর দেবী মন্দিরে মৃত্যু ৩৫০ জনের।
• অগস্ট, ২০০৩: নাসিকের কুম্ভ মেলায় মৃত ৪০।
• ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৪: ইলাহাবাদের মহাকুম্ভ মেলায়
৮০০ পুণ্যার্থীর মৃত্যু।
সম্প্রীতি শুক্রবার বলেন, ‘‘পরিস্থিতি স্বাভাবিকই ছিল। হঠাৎই কে আগে যাবে, তা নিয়ে শুরু হয় ঠেলাঠেলি। ধাক্কাধাক্কির জেরে পাঁচিলের ধারে চলে গিয়েছিলাম আমরা। মায়ের হাতটা ধরে ছিলাম। ধাক্কায় হাত ছেড়ে যায়। তখনই ভেঙে পড়ে পাঁচিল। আমি লোকজনের উপরে পড়ি। মা মনে হয় আগেই রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল। মায়ের উপরে পাঁচিল ভেঙে পড়ে। তার উপর দিয়েই লোকজন দৌড়য়।’’ সম্প্রীতির কথায়, ‘‘পুলিশকে ডেকে বারবার বলি, স্যর, আমি মরে যাচ্ছি, শ্বাস ফেলতে পারছি না। পুলিশ বলল, ‘যেমন এসেছেন, তেমন দাঁড়িয়ে থাকুন। তর্ক করবেন না।’ লাঠি চালাচ্ছিল পুলিশ। ওদের ব্যবস্থা ঠিক ছিল না। সহযোগিতাও পাইনি।
দুর্ঘটনার পরে প্রথমে দাদার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে সম্প্রীতি ফোন করে পিসতুতো দিদি সুমিতা মণ্ডলকে। রাত আড়াইটে নাগাদ ঘুম চোখে ফোন ধরে সুমিতা শোনেন, বোন কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ‘মা বোধহয় আর নেই। দাদাকে খবর দাও, ওর ফোন বন্ধ।’ পরে অবশ্য দুই বোনই ফোনে যোগাযোগ করতে পারেন সায়নের সঙ্গে। শুরু হয়ে যায় দৌড়োদৌড়ি। স্থানীয় হাসপাতাল থেকে ভোরেই পূর্ণিমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে দাঁড়িয়ে পূর্ণিমার ভাই রাজকুমার পাত্র বলেন, “ঠাকুরের ভক্ত ছিল খুব। কিছু দিন আগেই তারকেশ্বরে জল ঢালতে গিয়েছিল।” পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে পূর্ণিমার আয়েই চলত সংসার। অন্য এক পরিজনের কথায়, “এ বছর জন্মাষ্টমী আর ওর স্বামীর মৃত্যুদিন পরপর পড়েছিল। মেয়েটাও এ বার মাধ্যমিক পাশ করেছে। সব মিলিয়ে প্রথম বার কচুয়ায় যাবে বলে স্থির করেছিল পূর্ণিমা।”
মর্গের ঠান্ডা ঘর থেকে মাকে নেওয়ার প্রতীক্ষায় তখন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে সায়ন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy