বার্সেলোনা থেকে কালিকাপুরে মা কবিতার ঘরে আবেগাপ্লুত প্রিয়া। পাশ তাঁর পালক বাবা-মা এবং কবিতার বর্তমান স্বামী। ছবিঃ দেবকল্যাণ চৌধুরি।
দেখতে দেখতে চার চোখ ছাপিয়ে নামা নোনাজলে গলে যাচ্ছে দেশ আর নাগরিকত্বের কাগজ। ধুয়ে যাচ্ছে ২৬ বছর ধরে পেরোনো আট হাজার কিলোমিটার। এর চোখের জল লাগছে ওর গালে। সেই জলে মিশছে অক্ষর আর বর্ণমালা।
প্রিয়া পড়ে নিচ্ছেন ওই জলের দাগে লেখা তাঁর হারানো মায়ের নাম।
ঘুপচি ঘরে তেলচিটে বিছানার ধারে প্রিয়ার হাত ধরে দাঁড়িয়ে মা কাঁদছেন। মায়ের হেঁশেল জুড়ে নিম্নবিত্ত জীবনযাপনের ছাপ। এ শহরের শিরা-উপশিরায় মিশে থাকা এক গলিতে আজও দিন গুজরান করেন প্রিয়ার আটপৌরে বাঙালি গর্ভধারিণী কবিতা সরকার। প্রিয়া তাঁর খোঁজ পেয়ে উড়ে এলেন স্পেনের বার্সেলোনা থেকে। এলেন পালক বাবা-মায়ের দেওয়া নিশ্চিন্ত, বিলাসবহুল জীবন থেকে খানিক ছুটি নিয়ে। সেই স্পেনীয় বাবা-মা, জ়েভিয়ার ও কারমেনকে সঙ্গে নিয়েই বৃহস্পতিবারের রোদে পোড়া বিকেলে কালিকাপুর পূর্বপল্লিতে কবিতার চৌকাঠে দাঁড়ালেন প্রিয়া ইরেন ক্যাবালেরো লোপেজ়।
বাংলা ছাড়া আর প্রায় কোনও ভাষাই বোঝেন না কবিতা। আর প্রিয়া স্প্যানিশের বাইরে খুব ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলতে পারেন। কিন্তু দুনিয়ার সব মায়ের ভাষাই তো এক! গরমে ঘেমেনেয়ে ওঠা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদছিলেন মা। মেয়েও কেঁদে আকুল। কান্নার আওয়াজ পেয়ে উঁকিঝুঁকি দিলেন কবিতার দু’এক জন প্রতিবেশী।
একটু পরে মা চুল বেঁধে দিচ্ছিলেন প্রিয়ার। যেন রোজ বিকেলেই এমন করে জট ছাড়িয়ে মেয়ের চুল বাঁধতে বসেন।
২৬ বছর আগে প্রিয়া যখন এ দেশে জন্মেছিলেন, তখন কবিতার প্রায় খাওয়াই জোটে না দু’বেলা। প্রিয়ার জন্মদাতা বাবা কবিতাকে স্রেফ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। দারিদ্রের সঙ্গে কবিতা আর লড়তে পারেননি। সদ্যোজাত মেয়েকে দত্তক দিয়ে দেন। প্রিয়াকে নিয়ে বার্সেলোনায় চলে যান জ়েভিয়ার ও কারমেন।
প্রিয়া কিন্তু স্বাবলম্বী হওয়া ইস্তক খুঁজে যাচ্ছিলেন তাঁর জন্মদাত্রীকে। গত জানুয়ারিতে কলকাতায় এসে শহরের অলিগলি খুঁজে মাকে না-পেয়ে ফিরে যান প্রিয়া। কিন্তু ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি নাগাদ খোঁজ মেলে কবিতার। মিলে যায় পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ। তার বৈজ্ঞানিক ভিত্তিকে মজবুত করতে প্রিয়া ও কবিতার ডিএনএ আমেরিকায় পাঠানো হলে তা-ও মিলে যায়। সে দিন বার্সেলোনায় নিকটাত্মীয়দের নৈশভোজে ডেকে জনে-জনে প্রিয়া জানান সে কথা।
প্রিয়ার প্রতিনিধি, মহারাষ্ট্রের সমাজকর্মী অঞ্জলি পওয়ার এবং তাঁর সঙ্গী অরুণ ডোল মিলে গত সেপ্টেম্বর থেকে নিরলস খুঁজে গিয়েছেন প্রিয়ার মাকে। বৃহস্পতিবার প্রিয়ার সঙ্গে পালক বাবা-মায়ের পাশাপাশি অঞ্জলি ও অরুণও ছিলেন। কবিতাকে খুঁজে দিতে সাহায্য করেছিলেন জীবন বিমার প্রাক্তন কর্তা প্রলয় দাশগুপ্ত। সাংবাদিককে তিনি বললেন, “কবিতাকে খুঁজে দিতে বারাসত সামাজিক সেবা প্রতিষ্ঠানের এক প্রতিনিধিরও হাত ছিল, লিখতে ভুলবেন না।”
একচিলতে ঘর থেকে ছিটকে আসছিল কথোপকথন। মা-মেয়ে তখন আরও একটু বেশি কথা বলতে চান পরস্পরের সঙ্গে। তাই ক্রমাগত বাংলা ও স্প্যানিশের তর্জমা করে দিচ্ছিলেন দোভাষী অভীক ভট্টাচার্য। কবিতা কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, ‘‘স্বপ্নেও তো ভাবিনি, ওকে দেখতে পাব! শুধু প্রার্থনা করে গিয়েছি। যদি এক দিন এক বারের জন্য চোখের দেখা দেখতে পাই!” চোখ মুছে প্রিয়া তখন হাসছেন। মাকে বলছেন, “আমিও তোমার শহরে এসে মন্দিরে গিয়ে একই প্রার্থনা করেছিলাম।” কথা চলতে থাকে। “অনেক কিছুই তো বলার আছে। অনেক অনেক কথা.....” বিড়বিড় করেন প্রিয়া।
সংসার হারিয়ে, মেয়েকে হারিয়ে অথৈ জলে পড়া কবিতার হাত এক দিন এসে ধরেছিলেন মহানন্দ— তাঁর বর্তমান স্বামী। পেশায় রাজমিস্ত্রি মহানন্দ জোর গলায় বলেন, “হারিয়ে যাওয়া মেয়ে যদি মায়ের কাছে ফিরে আসে, তার চেয়ে আনন্দের তো কিছু হতে পারে না।” প্রিয়ার ‘নতুন’ বাবার খোলা মনের কাছে হার মেনে যায় বইপড়া বিদ্যে।
বার্সেলোনার তাপমাত্রা মোটামুটি এখন ১৪ ডিগ্রিতে। সংখ্যাটা উল্টে দিলেই প্রায় কলকাতার কাছাকাছি। তবু অনেকেই দেখেনি, এ দিন বিকেলে এক ঘিঞ্জি গলির ঘরে ফোঁটায় ফোঁটায় নোনতা বৃষ্টি নেমেছিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy