সন্ধ্যায় দিল্লির টিভি চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি ঘোষণা করলেন, সারদা কেলেঙ্কারির সঙ্গে তাঁর নিজের যোগাযোগ প্রমাণিত হলে মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দেবেন। আর তার কয়েক মিনিটের মধ্যেই কলকাতায় জানা গেল যে, তাঁর এক মন্ত্রী ও এক সাংসদকে তলব করেছে সিবিআই। মঙ্গলবার পরপর এই দুই ঘটনাই ফের সংবাদের শিরোনামে এনে দিল সারদা তদন্তকে।
সারদা কেলেঙ্কারিতে এর আগে রাজ্যের বস্ত্রমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে ডেকে পাঠিয়েছিল সিবিআই। কিন্তু পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রকে শুক্রবার তদন্তকারীদের সামনে হাজির হতে বলাটা অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। কেন না, এই ঘটনায় গোড়া থেকেই মদনবাবুর নাম উঠেছে। সারদা মামলায় গ্রেফতার হওয়া সাসপেন্ডেড তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষ দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের পাশাপাশি মদনবাবুর নামেও অভিযোগ করেছিলেন। মমতাও একাধিক বার এঁদের সমর্থনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, “মদন চোর? মুকুল চোর?...” গোড়ায় অবশ্য তিনি এর সঙ্গে কুণালের নামও জুড়েছিলেন। কিন্তু কুণাল বিদ্রোহী হয়ে ওঠার পরে তাঁকে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলেন। কুণালকে জেলেও ভরে রাজ্য পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট)।
মদনবাবুর পাশাপাশি তৃণমূল সাংসদ সৃঞ্জয় বসুকেও ডেকে পাঠিয়েছে সিবিআই। তাঁর দিকেও অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন বিদ্রোহী কুণাল। এর আগে সৃঞ্জয়কে জেরা করেছে এসএফআইও এবং ইডি। সিবিআই তলবের কথা স্বীকার করে নিয়ে সৃঞ্জয় এ দিন দাবি করেছেন, “আমাকে সাক্ষী হিসেবে ডাকা হয়েছে। দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে আমি সিবিআই দফতরে যাব।”
মদনবাবু কিন্তু এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। অসুস্থতার কারণে গত রবিবার তিনি একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাঁর চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, মদনবাবুর শিরদাঁড়ায় একটি টিউমার ধরা পড়েছে। সেটি অস্ত্রোপচার করা প্রয়োজন। সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মদনবাবু বলেন, “আমি এখন হাসপাতালে ভর্তি। তাই কিছু বলতে পারব না।” একটি সূত্রের অবশ্য দাবি, রবিবারই মদনবাবুকে ফোন করে সিবিআই দফতরে আসতে বলা হয়। আর তার পরেই হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি।
গত বছর এপ্রিলে সারদা কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই মদনবাবুর নাম বারবার উঠে এসেছে। সারদার যাত্রা শুরু হয়েছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুর থেকে। ঘটনাচক্রে সেই সময় এলাকার বিধায়ক ছিলেন মদনবাবু। অভিযোগ, সেই সময়ই সুদীপ্তর সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা শুরু হয়। সারদার কর্মচারী ইউনিয়নের নেতাও ছিলেন মদনবাবু। সিবিআই-এর এক কর্তা এ দিন বলেন, “সারদার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যে মদনবাবু গিয়েছিলেন, তা টিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছে।” পরিবহণমন্ত্রীর প্রাক্তন আপ্ত সহায়ক বাপি করিমকে ইতিমধ্যেই একাধিক বার জেরা করেছে সিবিআই। জেরা করা হয়েছে মদন-ঘনিষ্ঠ প্রশান্ত প্রামাণিককেও। সিবিআই-এর একটি সূত্রের দাবি, এই দু’জনের কাছ থেকেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে নামা সিবিআই তাদের দ্বিতীয় চার্জশিটেও প্রভাবশালী কারও নাম না-করায় কেউ কেউ মনে করছিলেন, তদন্ত বোধহয় গতি হারিয়েছে। যদিও সিবিআই সূত্রে সেই দাবি অস্বীকার করে বারবার বলা হচ্ছিল, প্রভাবশালীদের ডেকে পাঠানোর আগে হাতে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ থাকা দরকার। না হলে আখেরে আদালতে মুখ পুড়বে। এ দিন মদনবাবু ও সৃঞ্জয়কে ডেকে পাঠানোর খবর প্রকাশ্যে আসার পরে এক সিবিআই কর্তা জানান, রাজ্যের বেশ কয়েক জন রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ জোগাড় করা হয়েছে। তার ভিত্তিতেই তাঁদের একের পর এক জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। জেরায় তাঁদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সদুত্তর মিললে তাঁরা ছাড় পাবেন। নইলে তাঁদের গ্রেফতার করা হবে।
এই পরিস্থিতিতে এ দিন তৃণমূলের কোনও শীর্ষস্থানীয় নেতাই বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেননি। একান্তে তাঁদের বক্তব্য, সিবিআই তো অনেককেই ডাকছে। শেষ পর্যন্ত কী হয় না-দেখে আগাম মন্তব্য করাটা উচিত হবে না।
দিল্লিতে তৃণমূল নেত্রী অবশ্য এ দিনই সারদা কেলেঙ্কারির সঙ্গে তাঁর যোগ প্রমাণ হলে মুখ্যমন্ত্রী পদ ছেড়ে দেবেন বলে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন। একটি টিভি চ্যানেলের সাক্ষাৎকারে তাঁর বিরুদ্ধে কুণালের অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন করা হতেই মমতা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলেন, “কে বলল? শুধু অভিযোগ করলেই হবে? আপনাকে প্রমাণ করতে হবে! যদি প্রমাণ হয়, তা হলে আমার দিক থেকে আমি ইস্তফা দেব!”
মমতাকে ফের প্রশ্ন করা হয়, তিনি সত্যিই ইস্তফা দেবেন? মমতার জবাব, “হ্যাঁ! আমি তো বারবার বলছি, এই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। ৩৪ বছর ধরে, বাম জমানায় এ সব হয়েছে। আমরা তো এক জনকে গ্রেফতার করেছি। ৫ লক্ষ মানুষের টাকাও ফেরত দিয়েছি। আমাদের বিরুদ্ধে বাজে অভিযোগ আনা হচ্ছে।”
পরে আনন্দবাজারকে তিনি বলেন, “আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বন্যা বইছে। বিভিন্ন মহল থেকে অপপ্রচার করা হচ্ছে। তাই আমি চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি। যদি সারদার সঙ্গে আমার যোগাযোগ প্রমাণিত হয়, তা হলে আমি মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেব।”
ঘটনা হল, মমতার একদা স্নেহধন্য কুণালই প্রকাশ্যে দাবি করেছেন, সারদা কেলেঙ্কারিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে সবচেয়ে বেশি সুবিধা যদি কেউ পেয়ে থাকেন, তা হলে তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রাক্তন তৃণমূল নেতা এবং একদা মুকুল-ঘনিষ্ঠ আসিফ খান সোমবারই ‘ডাকাতরানি’ বলেছেন মমতাকে। মমতার বিধানসভা এলাকার ক্লাবগুলিতে সুদীপ্ত সেন ঢালাও টাকা ঢেলেছিলেন বলেও সূত্রের দাবি। টিভি সাক্ষাৎকারে অবশ্য এ সব নিয়ে আলোচনা এগোয়নি। কারণ, সারদা প্রসঙ্গ পাড়তেই চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ার উপক্রম করেছিলেন মমতা। আর সারদা-কর্তা প্রায় দু’কোটি টাকা দিয়ে তাঁর আঁকা ছবি কিনেছিলেন কি না, এই প্রশ্ন করার পরেই দৃশ্যতই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন তিনি। আগে রেকর্ড করা সাক্ষাৎকারে দেখা যায় এর পরই প্রসঙ্গ পাল্টে গিয়েছে।
বিরোধীরা কিন্তু সারদা নিয়ে আলোচনা থামাতে নারাজ। মদন-সৃঞ্জয়কে সিবিআই তলব এবং মমতার মন্তব্য, এই জোড়া বিষয়কে হাতিয়ার করে আক্রমণে নেমেছেন তাঁরা। মদন প্রসঙ্গে তাঁদের বক্তব্য, কান টানলে মাথাও আসবে। বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের কটাক্ষ, “লাগা চুনরি মে দাগ! তৃণমূল সর্বাঙ্গে সারদাকে মেখে ফেলেছে। কোনও ভাবেই মুছে ফেলা যাবে না।” আর মুখ্যমন্ত্রীর চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের মন্তব্য, “কার যোগাযোগ প্রমাণ করার কথা বলছেন, স্পষ্ট করে বলুন! আর মুখ্যমন্ত্রী দোষী প্রমাণিত হলে তো তাঁর পদত্যাগ করার দরকার নেই। ভোটে লড়ার অধিকারই খারিজ হয়ে যাবে!” সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের কথায়, “অপরাধীরা যখন আত্মবিশ্বাসী থাকে, তখন বলে ‘প্রমাণ আছে’? সারদা-কাণ্ডে তো এক বছর ধরে রাজ্য পুলিশকে দিয়ে প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর প্রমাণ চাওয়ার কথায় সেই রকমই ইঙ্গিত মিলছে না কি?”
ঘটনাচক্রে কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীর আমন্ত্রণে দিল্লি গিয়ে গত দু’দিন ধরে বিজেপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন মমতা। সোমবার দুপুরে দেখা করেছেন লালকৃষ্ণ আডবাণীর সঙ্গে। রাতে যান অরুণ জেটলির বাড়িতে। মঙ্গলবার রাজনাথ সিংহের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। মমতা নিজে এই সব সাক্ষাৎকারকে সৌজন্যমূলক বলে দাবি করলেও সারদার চাপ সামলানোই ‘আসল উদ্দেশ্য’ কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন বিরোধীরা।
এ দিনের ঘটনাক্রম অবশ্য সেই উদ্দেশ্যসিদ্ধির আভাস দিচ্ছে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy