Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

মধুর মোহ আর ভয়েই কি বাড়াবাড়ি, চর্চা তৃণমূলেই

সাম্প্রতিক অতীতে প্রায় সব নির্বাচনেই জয়ের মসৃণ রেকর্ড। গত দু’মাসে জনমত সমীক্ষাতেও বিশেষ মাথাব্যথার কোনও ইঙ্গিত নেই। জয়ের রাস্তার আভাসই বরং পরিষ্কার। এত কিছুর পরেও তবু এ বারের পুরভোটে বিস্তর হিংসা এবং জালিয়াতির অভিযোগে বিদ্ধ শাসক দল! জয় করেও ভয় কি তবে যায় না? প্রশ্ন উঠছে তৃণমূলের অন্দরেও!

সন্দীপন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৩১
Share: Save:

সাম্প্রতিক অতীতে প্রায় সব নির্বাচনেই জয়ের মসৃণ রেকর্ড। গত দু’মাসে জনমত সমীক্ষাতেও বিশেষ মাথাব্যথার কোনও ইঙ্গিত নেই। জয়ের রাস্তার আভাসই বরং পরিষ্কার। এত কিছুর পরেও তবু এ বারের পুরভোটে বিস্তর হিংসা এবং জালিয়াতির অভিযোগে বিদ্ধ শাসক দল! জয় করেও ভয় কি তবে যায় না? প্রশ্ন উঠছে তৃণমূলের অন্দরেও!

শাসক দলের নেতৃত্বের একাংশ ঘরোয়া আলাপচারিতায় মেনে নিচ্ছেন, কলকাতা এবং বাকি ৯১টি পুরসভার ভোট তাঁদের দল সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কাছে ভুল বার্তাই পৌঁছে দিয়েছে। যারা এমনিতেই জিতবে, তার এত মারপিট করবে কেন— এই প্রশ্ন তুলে মানুষ নিজেরাই ভাবতে পারেন, তার মানে নিশ্চয়ই মনে মনে ভয় আছে! বুঝতে পারছেন শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের একটি পুরসভার বিদায়ী চেয়ারম্যান ভোটের দিন প্রকাশ্যে বলেও ফেলেছেন, তাঁর দল তৃণমূল যে ভাবে পুরভোট করিয়েছে, তাতে তিনি লজ্জিত! তিনি চেষ্টা করেছিলেন এই পথ পরিহার করাতে। কিন্তু পারেননি।

শহরতলির এক পুর-চেয়ারম্যান না হয় ভিন্ন সুরে কথা বলার চেষ্টা করে শাসক দলে কল্কে না-ই পেতে পারেন। কিন্তু তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব? তাঁদের এক জন বলছেন, ‘‘কাজটা ঠিক হয়নি। সুষ্ঠু ভোট হলেও আমরা বেশির ভাগ জায়গায় এমনিতেই জিততাম। আজেবাজে লোকের হাতে সবটা ছেড়ে দিয়ে ভবিষ্যতের জন্য খুব খারাপ কাজ হল!’’ তাঁরা ঠেকালেন না কেন? ঘরোয়া আলোচনায় কেউ বলছেন, ‘‘আমাদের কথা শুনছে কে? আমাদের কথায় কাজই বা কতটা হবে?’’ আবার কেউ বলছেন, ‘‘কী দরকার বলতে যাওয়ার? তৃণমূল দলটা চলে দলনেত্রীর নামে। তিনি যা ভাল বুঝবেন, তা-ই করবেন!’’

তৃণমূলের অন্দরেই অন্য একাংশ অবশ্য দাবি করছে, প্রথম সারির নেতাদের ভিন্ন মতের কোনও প্রতিফলন কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়নি। বরং, বিধানসভা ভোটের আগের বছরে দলনেত্রীর হাতে যত বেশি সম্ভব পুরসভা এবং ওয়ার্ড তুলে দেওয়ার প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়েছেন উপর তলার নেতারা। তার প্রভাবে ক্রমান্বয়ে নীচের তলায় চাপ বেড়েছে। এলাকায় এলাকায় যিনি প্রভাবশালী, তিনি তাঁর মতো করে বাহিনী নামিয়ে উপর তলার ‘মন রাখা’র চেষ্টা করে গিয়েছেন। যার ফল প্রথমে কলকাতা এবং পরে আরও ৯১টি শহরের বাসিন্দারা চোখের উপরে দেখেছেন! দলেই চর্চা হচ্ছে, রাজ্য জুড়ে কিছু এলাকা ছাড়া কোথাও বিরোধীরা তেমন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি বলে রক্ষে! নয়তো তীব্র সংঘর্ষ বাধতো। তাতে দলের রক্তক্ষয় হতো, আবার জনমানসে ভাবমূর্তির ক্ষতিও আটকাতো না!

শাসক দল সূত্রেই ব্যাখ্যা মিলছে, তৃণমূলে এত দিন সংগঠনের ‘মাস্টার কি’ ছিল মুকুল রায়ের হাতে। কোন ব্লকে কাকে বললে কাজ হবে, তিনি নিমেষে সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। প্রাক্তন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক দলে ব্রাত্য হয়ে যাওয়ার পরে এখন সংগঠনের কাজ দেখভাল করে সুব্রত বক্সী, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অরূপ বিশ্বাস, ফিরহাদ (ববি) হাকিম, শোভন চট্টোপাধ্যায়দের ‘টিম’। এঁদের কারওরই সংগঠনের উপরে মুকুলের মতো অবিসংবাদী প্রভাব নেই। অথচ সকলেই চেয়েছেন, মুকুল-হীন তৃণমূল যে আরও ভাল ফল করতে পারে, পুরভোটে দলনেত্রীকে দেখিয়ে দেবেন! অতএব, আদা-জল খেয়ে নেমেছেন তাঁদের অনুগামীরা আর সেটা করতে গিয়েই বোতল থেকে দৈত্য বেরিয়ে গিয়েছে! যে দৈত্যকে ফের বোতলে ভরার উপায় বক্সীদের জানা নেই!

মুকুল-ঘনিষ্ঠেরাও এই পুরভোটের কাণ্ডকারখানা দেখে বলছেন, এর সুদূরপ্রয়াসী ফল ক্ষতিকর হতে বাধ্য। তাঁরা বলছেন, মুকুল থাকলে এ জিনিস নাকি হতো না! তাঁদের দাবি, মুকুল যতই এ দল-ও দল ভাঙান, নানা রকমের লোকের হাতে তৃণমূলের ঝান্ডা ধরান, এমন ‘দুষ্কৃতী বাহিনী’কে বেলাগাম করে ছেড়ে দেননি কখনও। তৃণমূলের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতার আবার পাল্টা দাবি, ‘‘যা হচ্ছে, এ সবই তো দলে মুকুলায়নের ফল! মুকুল যে সব উপকরণ জোগাড় করে রেখে গিয়েছিল, সে সবই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আমাদের নিয়ন্ত্রণ খাটছে না!’’

চাপানউতোর যেমনই থাক, জয়ের আবহে থেকেও ভোটে জবরদস্তির মূলত দু’রকম কারণ মিলছে তৃণমূলের ঘরোয়া আলোচনায়। নেতাদের একাংশ বলছেন, অহেতুক সব জেতার খিদেই অনর্থের মূল কারণ। এক রাজ্য নেতার কথায়, ‘‘যারা এমনিই এক হাজার-দেড় হাজার ভোটে জিততে পারত, তাদের ইচ্ছা হয়েছে পাঁচ হাজারে জেতার! যারা দলের টিকিট পায়নি, তারা নির্দল হয়ে দাঁড়িয়েছে।’’ ওই নেতার মতে, বিক্ষুব্ধ তথা নির্দল-কাঁটা সামলাতে গিয়েই পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। মার খেয়েছেন বিক্ষুব্ধেরা, বিরোধীরা। ওই নেতার আরও আশঙ্কা, ‘‘এই ভোটে তো প্রায় সবই আমাদের জেতার কথা! তার পরে কী হবে? রামকে চেয়ারম্যান করলে শ্যাম মানবে না। শ্যামকে করলে যদু বিক্ষুব্ধ হবে। তখন কী হবে?’’

আবার দলেরই অন্য একাংশ মনে করছে, এত গা-জোয়ারির কারণ শুধু লোভ নয়। ভয়ও। বিরোধী ভোট বেশি পড়ার ভয়, বাড়া ভাতে বিক্ষুব্ধদের ছাই দেওয়ার ভয়! দলের এক বর্ষীয়ান নেতার মন্তব্য, ‘‘বিরোধী ভোট ভাগ হলে আমাদের লাভ। জনমত সমীক্ষায় বামেদের ভোট সামান্য হলেও একটু বেড়ে যাওয়ার ইঙ্গিত ছিল। বামেদের ভোটবৃদ্ধি মানেই যদি বিপদ হয়! তা ছাড়া, লোকসভার জয়েও তো কিছুটা জল মিশে ছিল! কেউ তাই ঝুঁকি নিতে চায়নি।’’ এই ‘ঝুঁকি’ না নিতে চাওয়া থেকেই দঙ্গলে দঙ্গলে বহিরাগত আমদানি এবং বলপ্রয়োগের তত্ত্ব কাজ করেছে, ব্যাখ্যা ওই অংশের।

বিরোধী দল সিপিএম ও বিজেপি নেতাদের একাংশও বলছেন, ‘ঝুঁকি’ নেবেন না বলে তৃণমূল নেতারা দলের স্থানীয় কর্মীদেরও পাত্তা দেননি! এক সিপিএম নেতার কথায়, ‘‘এক পাড়ায় থেকে বিজেপি বা বামফ্রন্ট করে, এমন লোকজনের উপরে চড়াও হতে স্থানীয় তৃণমূল কর্মীরা রাজি ছিলেন না। নেতারা তাই পুরো অপারেশনটাই বাইরের লোক আনিয়ে করিয়েছেন!’’ বিজেপির এক রাজ্য নেতার কথায়, ‘‘বাইরের ছেলেরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অথচ স্থানীয় তৃণমূলের ছেলেরা ভোট দিতেই যায়নি, এমন ঘটনা বেশ কয়েক জায়গায় দেখেছি।’’

তৃণমূল নেতৃত্ব প্রত্যাশিত ভাবেই এ সব ‘গল্পকথা’ বলে প্রকাশ্যে উড়িয়ে দিচ্ছেন। দলের মহাসচিব পার্থবাবু যেমন রবিবারই বলেছেন, ‘‘৯১টা পুরসভায় এত বুথ। তার মধ্যে মাত্র ৩৬টা বুথে পুনর্নির্বাচন হবে। ৩৬টা তো নগণ্য! এতেই বোঝা যাচ্ছে, অশান্তির অভিযোগের সত্যতা কতটুকু!’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘দু-চারটে বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটেছে। তা দুঃখজনক। আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করি।’’

দলের অভ্যন্তরে অবশ্য প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, মাত্র চার বছরের শাসক দলের আরোগ্য কী ভাবে হবে? বিধানসভা ভোটের আগে রোগ আরও জাঁকিয়ে বসবে না তো? কারণ, নিরপেক্ষ ভোটে যতটুকু হাতছাড়া হতো, জোর করে এক বার তা নিজের দিকে আনতে গেলে পরে স্বাভাবিক নিয়মেই ক্ষোভ আরও বাড়বে। তখন আরও বেশি বলপ্রয়োগ করতে হবে। এ ভাবেই চলবে বিষচক্র! দলের এক তরুণ নেতার কথায়, ‘‘সরকারে এসে এলাকায় যা কাজ করেছি, বিধানসভা ভোটের আগে তার উপরে জনসমর্থন যাচাই করে নেওয়ার সুযোগ ছিল এ বার। কিন্তু সেখানেই জল ঢুকিয়ে ফেললে পরে বড় বিপদ আসবে!’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE