আড়াই মাসে ১৮০ ডিগ্রি! গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে গদিচ্যুত করতে কংগ্রেসের ‘হাত’ ধরতে রাজি তৃণমূল। বিজেপির বিরোধী জোট প্রসঙ্গে সোমবার নবান্নে এমনটাই জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে পাশাপাশিই তিনি কংগ্রেসের জন্য ‘ত্যাগ’-এর বার্তাও দিয়েছেন। মতান্তরে, শর্ত দিয়েছেন। মমতার শর্ত বা ফর্মুলা খুব সহজ— যে যেখানে শক্তিশালী, সে সেখানে একচ্ছত্র ভাবে লড়বে। অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গে জোট হলে তার চাবিকাঠি থাকবে মমতা তথা তৃণমূলের হাতে।
কংগ্রেস এই শর্ত মেনে নেবে, এমন কোনও ইঙ্গিত মঙ্গলবার পর্যন্ত দেখা যায়নি। তবে কংগ্রেস সম্পর্কে এমন মনোভাব প্রকাশের আগেই অন্যান্য বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গেও যোগাযোগ শুরু করে দিয়েছিলেন মমতা। যা থেকে এমনটাই ইঙ্গিত মিলছিল যে, তৃণমূল ‘নীতিবদল’ করতে চলেছে। উল্লেখযোগ্য ভাবে, সেই বদল ঘটছে মাত্র আড়াই মাসের মধ্যে। কারণ, মার্চের গোড়ায় সাগরদিঘি উপনির্বাচনে পরাজয়ের পরেই মমতা ঘোষণা করেছিলেন, আগামী লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল একলা লড়বে। তৃণমূলের জোট হবে মানুষের সঙ্গে।
জোট নিয়ে মমতার মার্চ এবং মে মাসের অবস্থান ১৮০ ডিগ্রি বিপরীত হলেও এর মধ্যে তৃণমূল প্রত্যাশিত ভাবেই কোনও ‘নীতিবদল’ দেখছে না। বরং দলের বক্তব্য— বরাবরই জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপির প্রধান বিরোধী মুখ হিসাবে মমতার নাম রয়েছে। সিপিএম অবশ্য এর মধ্যে ‘নীতিহীনতা’ই দেখছে। অধুনা বামেদের ‘বন্ধুদল’ কংগ্রেসেরও একই বক্তব্য। তাদের দাবি, অস্তিত্বের সঙ্কট বুঝেই তৃণমূল আবার জোটের কথা বলছে। আর রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল তথা কেন্দ্রের শাসক বিজেপির অবশ্য বক্তব্য, একলা লড়াইয়ের ক্ষমতা নেই বলেই তৃণমূল নেত্রী জোট গড়ার কথা বলছেন। কিন্তু তাতেও কাজ হবে না।
কেন মমতার এই ‘বদল’? তৃণমূলের একাংশের মতে, মমতা সব সময়েই জানতেন, কংগ্রেস অপ্রাসঙ্গিক না হলে তৃণমূল জাতীয় রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হবে না। ফলে তিনি বরাবরই কংগ্রেসের থেকে পৃথক অস্তিত্ব বজায় রাখতে উদ্যোগী হয়েছেন। গত লোকসভা ভোটে দেশে আশাতীত খারাপ ফল করেছিল কংগ্রেস। রাজ্যেও বিধানসভা ভোটে শূন্য হয়ে গিয়েছিল তারা। সকলেই ধরে নিয়েছিলেন, কংগ্রেসের আরও অধোগতি অনিবার্য। কিন্তু সেই পরিস্থিতিতেই রাহুল গান্ধী ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ শুরু করেন। সমস্ত বিরোধী দলকেই তিনি তাঁর ওই যাত্রায় শামিল হতে অনুরোধ করেছিলেন। তৃণমূল তাতে সাড়া দেয়নি।
কিন্তু ওই কর্মসূচির ফলে কংগ্রেস যে প্রাসঙ্গিক হয়েছে, তা তৃণমূলের একাংশ মেনে নিচ্ছেন। সেই প্রাসঙ্গিকতা আরও জোরদার হয়েছে রাহুলের লোকসভার সাংসদ পদ কেড়ে নেওয়ার পর। তত দিনে অবশ্য মমতার সাগরদিঘি-উত্তর একলা চলার ঘোষণা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রাহুলের সাংসদ পদ খারিজ হওয়ার পর মমতা রাহুলের পাশে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে কড়া আক্রমণ করেন।
এর মধ্যে তৃণমূল তাদের ‘জাতীয় দল’-এর তকমা হারায়। তার পরেই আসে কর্নাটকের বিধানসভার ভোট। যেখানে অপ্রত্যাশিত ভাল ফল করে কংগ্রেস। ফলে জাতীয় রাজনীতিতে তাদের প্রাসঙ্গিকতা এবং গুরুত্ব আরও বাড়ে। যেমন খানিকটা গুরুত্ব কমে আঞ্চলিক দলগুলির। সে তৃণমূলই হোক বা অরবিন্দ কেজরীওয়ালের আম আদমি পার্টি। বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদীর বিরোধী ‘মুখ’ হিসeবে খানিকটা বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরে পান রাহুল।
এই ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেই সোমবার মমতা বিরোধী জোট নিয়ে কংগ্রেসকে বার্তা দিয়েছেন। যদিও একে ‘নীতিবদল’ বলতে চাইছে না তৃণমূল। দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুণাল ঘোষের বক্তব্য, ‘‘আমাদের নেত্রীর ঘোষিত সিদ্ধান্তটাই তো হচ্ছে বিজেপির বিরোধী জোট। কিন্তু সাগরদিঘির ভোটে যে ভাবে সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি জোটবদ্ধ হয়েছিল, তাতে তিনি রাজ্যের ক্ষেত্রে এটা বোঝাতে গিয়েছিলেন যে, উনি একলাই যথেষ্ট। এই রাজ্যে আমাদের কারও সঙ্গে জোটের দরকার নেই। মমতা’দি এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জাতীয় ক্ষেত্রে তো ওঁর ঘোষিত নীতিই হল জোট বেঁধে লড়াই।’’ স্বাভাবিক ভাবেই এর ঠিক উল্টো বক্তব্য বিজেপির। দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী বুঝে গিয়েছেন আগামী লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে কী দশা হতে চলেছে। দলের নবজোয়ার যাত্রা তো আসলে সমীক্ষা। সেই রিপোর্ট পেয়ে গিয়েছেন তিনি। মুখ বাঁচাতে এর-ওর হাত ধরতে চাইছেন। যেটা হতে পারে সেটা চোরেদের জোট। জাতীয় দলের তকমা হারানো তৃণমূল চাইছে এ দিক-ও দিক গিয়ে যদি ভিক্ষার ঝুলি কিছুটা ভরা যায়। কিন্তু সে আশা বৃথা।’’
মমতার বক্তব্য প্রসঙ্গে সিপিএম এবং কংগ্রেসের বক্তব্যে মিল রয়েছে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য, ‘‘তালের ঠিক নেই। তৃণমূলের রাজনীতির ছন্দপতন হয়েছে। যদি লক্ষ্য ঠিক না থাকে, যদি আদর্শ বা নীতি না থাকে, তবেই বলতে হয় আমি কোন পথে যে চলি, কোন কথা যে বলি! প্রতিদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেশুনে সেটাই মনে হয়।’’ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের বক্তব্য, ‘‘সাগরদিঘি দিয়ে শুরু হয়েছে। এ বার সর্বত্র মানুষ তৃণমূলকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করবে। আতঙ্কে ভুগছেন মমতা। অতীতে কংগ্রেসকে হটাতে বিজেপির হাত ধরেছিলেন। এখন উল্টোটা করতে চাইছেন।’’ তৃণমূলকে বিজেপির ‘বি টিম’ আখ্যা দিয়ে মান্নান বলেন, ‘‘কংগ্রেসকে ভাঙিয়ে নিয়ে দল গড়ে এখন কংগ্রেসের পা ধরতে চাইছেন। গণবিদ্রোহের আতঙ্কে জোট বাঁধতে চাইছেন উনি।’’
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালে গত বিধানসভা নির্বাচনে জোট গড়েছিল কংগ্রেস, সিপিএম, আইএসএফ। কিন্তু ভোটের ফলাফলে তার কোনও প্রভাব পড়েনি। একটি মাত্র আসনে জয় পেয়েছিল আইএসএফ। তবে তার বছর দুয়েক পরে সাগরদিঘি উপনির্বাচনে জোটের জোরে কংগ্রেসের টিকিটে জিতেছেন বাইরন বিশ্বাস। তার পরেই মমতা নবান্নে বলেছিলেন, ‘‘তৃণমূল আর মানুষের জোট হবে। আমরা ওদের (বাম এবং কংগ্রেস) কারও সঙ্গে যাব না। একা লড়ব মানুষের সমর্থন নিয়ে।’’
সেই নীতিতে প্রথম বদল শোনা গিয়েছিল মমতার রেড রোডে ধর্না মঞ্চ থেকে। কেন্দ্রীয় সরকারের ‘অত্যাচার’ প্রসঙ্গ টেনে জাতীয় স্তরে সব বিরোধী দলের জোট চেয়ে সরব হন তৃণমূলনেত্রী। তিনি বলেন, ‘‘সব বিরোধীদের বলব, এমন কোনও বিরোধী দল নেই, যাদের বিরুদ্ধে অত্যাচার হচ্ছে না। কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে! কে বাকি রয়েছে? সবাই বলতে পারে না, চুপচাপ থাকে।’’ তার পরেই তাঁর মন্তব্য ছিল, ‘‘সব বিরোধীদের একসঙ্গে লড়তে হবে। বিজেপিকে কুর্সি থেকে হটাতে হবে।’’
উল্লেখ্য, তার আগে থেকেই জাতীয় স্তরে বিজেপি বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে মমতার যোগাযোগ বাড়ছিল। তিনি নিজে যান ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কের বাড়িতে। যদিও নবীন বলেন, ‘‘এটা সৌজন্য সাক্ষাৎ। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী দেখা করতে চেয়েছিলেন। রাজনীতি নিয়ে কোনও কথা হয়নি।’’ আর মমতা বলেন, ‘‘৩৬৫ দিনই তো রাজনীতি থাকে! নবীনের সঙ্গে আমাদের ভাল সম্পর্ক। ওরা আগামী দিনে ভাল ফল করবে।’’
কলকাতাতেও একের পর এক বৈঠক শুরু হয়েছিল। নবান্নে এসেছিলেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার এবং উপমুখ্যমন্ত্রী তথা লালুপ্রসাদের পুত্র তেজস্বী যাদব। সেই বৈঠকের পরে দু’জনকে পাশে বসিয়ে মমতা বলেছিলেন, ‘‘আমি প্রস্তাব দিয়েছি, বিরোধীদের বৈঠকটা বিহারে হলে ভাল হয়। আগে বার্তা দিতে হবে, আমরা সকলে একসঙ্গে রয়েছি। আমরা চাই বিজেপি যাতে শূন্য হয়ে যায়।’’ বিজেপির ‘পুরনো বন্ধু’ নীতীশ বলেছিলেন, ‘‘সমস্ত বিরোধী দলকে একত্রে প্রস্তুতি নিতে হবে। একসঙ্গে বসে আগামিদিনের রূপরেখা তৈরি করা হবে। যারা এখন ক্ষমতায় রয়েছে তারা মানুষের কথা ভাবে না। খালি নিজেদের প্রচার করে বেড়ায়। ইতিহাস বদলে দিচ্ছে এরা। আমাদের এ বার সতর্ক হয়ে একসঙ্গে রুখে দাঁড়াতে হবে।’’
প্রসঙ্গত, কলকাতায় আসার আগে দিল্লি গিয়েছিলেন নীতীশ। সেখানে তিনি দেখা করেছিলেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী, কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে এবং দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সঙ্গে। কলকাতা থেকে ফিরে লখনউ যান নীতীশ। সেখানে তাঁর কথা হয় সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদবের সঙ্গে। অখিলেশ অবশ্য তার আগেই কালীঘাটে মমতার বাড়িতে এসেছিলেন। ১৮ মার্চের সেই বৈঠকের সময়ে অবশ্য মমতার নীতি ছিল, বিজেপি এবং কংগ্রেসের সঙ্গে সমদূরত্ব রেখে বাকি দলকে নিয়ে জোট গড়া। তার নামও ঠিক হয়নি তখন। মমতা-অখিলেশ বৈঠকের দিল তৃণমূলের প্রবীণ সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘আমরা এখনই থার্ড ফ্রন্ট গঠনের কথা বলছি না। আমরা শুধু এটাই বলছি, আগে নির্বাচন হতে দিন। যে রাজ্যে যে দলের ক্ষমতা বেশি, সেখানে তারাই বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ুক। এই মুহূর্তে এটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দর্শন।’’ মমতার সঙ্গে দেখা করেছেন কর্নাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এইচ ডি কুমারস্বামীও।
এত দিন বিরোধী জোটের প্রশ্নে কংগ্রেসকে এড়িয়েই গিয়েছেন মমতা। কিন্তু সম্প্রতি তিনি কংগ্রেসকেও বার্তা দিতে শুরু করেছেন। এখন প্রশ্ন, আগামী ২৭ তারিখ নীতি আয়োগের বৈঠকে দিল্লি গিয়ে কি মমতা কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করবেন বিরোধী ঐক্য নিয়ে। তৃণমূলের একাংশের দাবি, কর্নাটকের ভোটের পরে যে আবহ তৈরি হয়েছে, তাতে তেমন সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আবার অন্য একাংশের বক্তব্য, তাঁদের নেত্রী যা বার্তা দেওয়ার দিয়েছেন। এ বার কংগ্রেসের তরফে আগ্রহ কতটা, সেটাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy