Advertisement
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
R G Kar Medical College And Hospital Incident

আরজি করের ঘটনা কেন এমন জনরোষের জন্ম দিল? সেই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে শাসকদলের অন্দরে

গণ-ক্ষোভের ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে নানা মত উঠে আসছে তৃণমূলের অন্দরে। দলের একাংশ মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরেই সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের নেপথ্যে বাংলাদেশের প্রভাব দেখছে।

আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ঘটনায় প্রতিবাদ।

আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ঘটনায় প্রতিবাদ। —ফাইল ছবি।

সন্দীপন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০২৪ ০৭:২৬
Share: Save:

পার্ক স্ট্রিট, কাটোয়া, কামদুনি, মধ্যমগ্রাম, ধূপগুড়ি। ঘটনা ঘটেছে অনেক বারই। কিন্তু প্রতিবাদের ঢেউ এ ভাবে উথলে ওঠেনি। প্রতিদিন যেন নতুন নতুন অংশের মানুষ শামিল হয়ে যাচ্ছেন প্রতিবাদের তরঙ্গে! আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ঘটনা কেন এমন জনরোষের জন্ম দিল, সেই প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে শাসক শিবিরের অন্দরে। প্রশাসনের তরফে এক একটা করে পদক্ষেপ হচ্ছে, আরও খেপে যাচ্ছে জনতা। যে জমানায় বারেবারেই অভিযোগ উঠেছে দল ও সরকারের কোনও ফারাক নেই, সেখানেই এখন প্রশ্ন উঠছে, দল ও প্রশাসনের ‘দূরত্ব’ কি বেড়ে গিয়েছে অনেক?

গণ-ক্ষোভের ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে নানা মত উঠে আসছে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের অন্দরে। দলের একাংশ মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরেই সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের নেপথ্যে বাংলাদেশের প্রভাব দেখছে। সিপিএম, কংগ্রেস ও বিজেপিকে দোষ দিয়ে মমতা বলেছিলেন, বিরোধীরা ভেবেছে এখানেও বাংলাদেশ করবে! দলের এক পুর-প্রধানের মতে, ‘‘পাশের বাংলাদেশের ঘটনা টাটকা। সেখানে দেখা গিয়েছে, ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনের সঙ্গে পা মিলিয়ে রাস্তায় নেমে প্রচুর ভোটে জিতে আসা এবং ক্ষমতাশালী সরকারকেও নামিয়ে দেওয়া যায়। অরাজনৈতিক মানুষ বা রাজনৈতিক শক্তি, সব অংশের উপরেই বাংলাদেশের ওই ঘটনা ছাপ ফেলেছে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘পুবালি হাওয়ার সঙ্গে ঝিরঝরে বৃষ্টি মিশলে ইলিশ ভাল হয়! এটাও সেই রকম।’’

তৃণমূল সূত্রের খবর, দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ঘনিষ্ঠ মহলে ক্ষোভের সুরে বলেছেন, আরজি কর পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজ্য সরকার ‘ব্যর্থ’। তাঁর এই মতের সমর্থনও আছে শাসক শিবিরে। এক রাজ্য নেতার কথায়, ‘‘দলের তরফে আমরাও বলছি, বিচার চাই, দোষীদের শাস্তি চাই। কিন্তু সরকার বা প্রশাসনের কিছু পদক্ষেপে জনমানসে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, কিছু যেন আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে। তার ফায়দা নিয়ে বিরোধীরা আসরে নেমেছে। এ সবের জন্যই ক্ষোভ বড় আকার নিয়েছে। নইলে মুখ্যমন্ত্রী ঘটনার পরের দিনই যে কথা বলেছিলেন, তাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফেলার সুযোগ ছিল।’’

বামফ্রন্ট জমানার শেষ দিকে একের পর ঘটনায় প্রশাসন যখন কার্যত দিশাহারা, সেই সময়ে সমালোচনা ছিল সিপিএমের গণ-সংগঠন এবং রাজনৈতিক যোগাযোগের চেয়েও প্রশাসন-নির্ভরতায় জোর দিতে গিয়ে সরকারের ভরাডুবি হল। পরিস্থিতি এখন সেই পর্যায়ে না-গেলেও পুলিশ এবং প্রশাসন-নির্ভরতা নিয়ে প্রশ্ন আছে তৃণমূলেও। দলের একাংশের মতে, আরজি কর-কাণ্ডে নিহত চিকিৎসক-তরুণীর বাড়ির এলাকার হাওয়া বুঝতেও পুলিশ-কর্তাদের কাছে বারবার খোঁজ নিয়েছেন দলের নেতারা। সাংগঠনিক বা দলীয় স্তরে পরিস্থিতি মোকাবিলায় জোর দেওয়া হয়নি। তৃণমূলের এক বিধায়কের আরও বক্তব্য, ‘‘ভোটে আমরা জিতেছি ঠিকই। কিন্তু অন্যান্য ঘটনায় ক্ষোভও জমেছিল। যেমন, পুরসভা এলাকা ধরে ধরে রাস্তা থেকে ছোট ছোট দোকানদার, ব্যবসায়ীদের তুলে দেওয়া হয়েছে। এঁরা ক্ষিপ্ত, স্থানীয় ভাবে আমরা জানি। সুযোগ পেলে এই ক্ষোভ সরকারের বিরুদ্ধে বেরিয়ে আসবে। আরজি করের ক্ষেত্রে সেটাও হয়তো একটা কারণ।’’

কয়েক মাস আগে লোকসভা নির্বাচনে বেশির ভাগ পুর-এলাকায় শাসক দলের ফল ভাল হয়নি। তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশের মত, সাম্প্রতিক ক্ষোভও মূলত শহরাঞ্চলে ছড়িয়েছে। সামনে ৬টি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন হলে আবার তৃণমূলই জিতবে বলেও তাঁরা আশাবাদী। তবে লোকসভায় যে এলাকায় ‘লিড’ আসেনি, সেখানে পুর-প্রধান বা পঞ্চায়েত প্রধানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন অভিষেক। গণ-ক্ষোভের আবহে সেই পদক্ষেপ কত দূর করা যাবে বা সঙ্গত হবে, সেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে শাসক শিবিরের অন্দরে।

প্রকাশ্যে তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য বিরোধীদের উপরেই দোষ চাপাচ্ছেন। দলের রাজ্য সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদারের অভিযোগ, ‘‘সমাজমাধ্যমে অপপ্রচার করে উস্কানি দেওয়া হচ্ছে। বিশৃঙ্খলা তৈরি করে ফায়দা নিতে চাইছে বিরোধীরা।’’ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের পাল্টা দাবি, ‘‘স্বাস্থ্য দফতর এবং পুলিশকে দিয়ে অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলেই মানুষের এত বেশি রাগ, অনাস্থা। মুখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশ থেকে আতঙ্ক বোধ করছেন কিন্তু বাংলাদেশ দেখে শিক্ষা নিচ্ছেন না! সমাজের সব অংশ থেকে প্রতিবাদ হচ্ছে, এই প্রতিবাদ আরও বাড়বে।’’ পুলিশ-প্রশাসন তাদের কৃতকর্মের জন্যই রোষের মুখে পড়ছে বলে দাবি করে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর মন্তব্য, ‘‘উঠিয়েছো লাঠি এ বার যবে, দেখবে কেমন খেলা হবে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE