Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
বন্দর-কাণ্ড

বশংবদ বলে আইনশৃঙ্খলাকেও বিসর্জন

নিজেদের কর্মী দিয়ে জবরদখল উচ্ছেদ করে বন্দর কর্তৃপক্ষ গিয়েছিলেন তারাতলা থানায়। সেখানে তাঁরা লিখিত ভাবে আর্জি জানান, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে পুলিশ যেন সক্রিয় হয়। কিন্তু তার পরেও পুলিশ ওই তল্লাটে পৌঁছল না কেন, সেই প্রশ্ন উঠেছে খাস লালবাজারের অন্দরেই।

স্টুডিওর বাইরে পাহারায় বাউন্সারেরা। — নিজস্ব চিত্র।

স্টুডিওর বাইরে পাহারায় বাউন্সারেরা। — নিজস্ব চিত্র।

সুরবেক বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৩২
Share: Save:

নিজেদের কর্মী দিয়ে জবরদখল উচ্ছেদ করে বন্দর কর্তৃপক্ষ গিয়েছিলেন তারাতলা থানায়। সেখানে তাঁরা লিখিত ভাবে আর্জি জানান, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে পুলিশ যেন সক্রিয় হয়। কিন্তু তার পরেও পুলিশ ওই তল্লাটে পৌঁছল না কেন, সেই প্রশ্ন উঠেছে খাস লালবাজারের অন্দরেই। বন্দর কর্তৃপক্ষও রবিবার থেকেই পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ এনে নিজেদের হতাশা ব্যক্ত করেছেন।

সোমবার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ বলেন, ‘‘বিষয়টি বিচারাধীন। পুলিশ সেই মতোই পদক্ষেপ করছে। আর বন্দর কর্তৃপক্ষ যদি নির্দিষ্ট ভাবে কোনও অভিযোগ করেন, তা হলে সেটাও খতিয়ে দেখা হবে।’’

কিন্তু কলকাতা পুলিশে কর্মরত বিভিন্ন পদমর্যাদার অফিসারদের বক্তব্য, জমি কার কব্জায় থাকবে, সেই বিষয়টি যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেওয়া যায় বিচারাধীন এবং এই ব্যাপারে পুলিশের মাথা গলানো বেআইনি, তা হলেও কোনও তল্লাটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ন্যূনতম যেটুকু সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন, পুলিশ এ ক্ষেত্রে সেটুকুও নড়াচড়া করেনি। পুলিশের এই হাত গুটিয়ে বসে থাকার প্রতিবাদে সোমবার সকালে বিজেপি নেতা সুভাষ সরকারের নেতৃত্বে জনা ৫০ বিজেপি সমর্থক তারাতলা থানার সামনে বিক্ষোভ দেখান। তাঁদের অভিযোগ, ‘‘পুলিশ ও তৃণমূল হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছে।’’ রাতে তারাতলা থানার বাইরে শ্রীকান্ত মোহতাকে গ্রেফতারের দাবিতে বিক্ষোভ দেখান কংগ্রেস নেতা রাকেশ সিংহ ও তাঁর দলবল।


সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন

কিন্তু পুলিশের এই আচরণের কারণ কী?

ওই অফিসারদের অভিমত, শ্রীকান্ত মোহতা খোদ মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী এবং তিনি এর মধ্যে যুক্ত। তাই পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল।

লালবাজার সূত্রের খবর, গোটা বিষয়টি দেখভাল করতে সিপি নির্দেশ দিয়েছেন বিশেষ অতিরিক্ত কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্রকে। কলকাতা পুলিশের ডিসি (দক্ষিণ-পশ্চিম) রশিদ মুনির খান এ দিনই তারাতলা থানায় গিয়ে এই সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখেছেন। বৈঠকও করেছেন অফিসারদের সঙ্গে।

তারাতলার জমি দখলমুক্ত করতে বন্দর কর্তৃপক্ষ বারবার পুলিশি সহায়তা চেয়েও পাচ্ছেন না কেন, সেই ব্যাপারে কথা হচ্ছিল লালবাজারের এক শীর্ষকর্তার সঙ্গে। মাস দুয়েক আগে। অভিজ্ঞ ওই অফিসার বোঝানোর চেষ্টা করেন, বিষয়টি এখনও বিচারাধীন। এটাই আপনার উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহার করি? হাঁ হাঁ করে ওঠেন পোড়খাওয়া পুলিশকর্তা, ‘‘উদ্ধৃতি দূরের কথা, আপনার সঙ্গে আমার এই ব্যাপারে কোনও কথাই হয়নি!’’ সে ক্ষেত্রে অন্তত এটা দেওয়া যাক যে, আপনি কোনও মন্তব্য করতে চাননি! তাতেও তীব্র আপত্তি ওই অফিসারের, ‘‘আমি এই ব্যাপারে কিছু শুনিইনি। জানেন তো জমিটা কার কব্জায়। কেন খামোখা বিপদে ফেলতে চাইছেন!’’

এই অবস্থা যেখানে, সেখানে রবিবার পুলিশের হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল বলে সাফ জানাচ্ছেন অফিসার-কর্মীদের একটা বড় অংশ।

যদিও রবিবারের ঘটনা নিয়ে লালবাজারের এক শীর্ষকর্তার যুক্তি, ‘‘আদালতে যা নিয়ে মামলা চলছে, সেই ব্যাপারে পুলিশ ঢুকলে আদালত অবমাননার দায়ে পড়তে হবে। তাই বন্দর কর্তৃপক্ষের চিঠি রবিবার সকাল সওয়া সাতটা নাগাদ গ্রহণ করলেও পুলিশ সেখানে যায়নি।’’

কিন্তু লালবাজারেরই অন্য একাধিক অফিসার ও শহরের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ থানার ওসি বলছেন, এটা কোনও যুক্তি হতে পারে না। তাঁদের বক্তব্য, বন্দর কর্তৃপক্ষ কিন্তু এক বারও ওই জমি রক্ষার জন্য তারাতলা থানাকে অনুরোধ করেননি। তাঁরা আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে অনুরোধ করেছিলেন।

একই সঙ্গে তাঁরা বলছেন, এ সবের পাশাপাশি পুলিশের নিজেদেরই আন্দাজ করা উচিত ছিল, জবরদখল-পাল্টা দখলকে ঘিরে ওখানে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে এটা বুঝে অন্তত এক জন অফিসারের নেতৃত্বে একদল পুলিশ ওই জমির আশপাশে পাঠালে মোটেই বিচারাধীন বিষয়ে মাথা গলানো বা আদালত অবমাননা হতো না। আইনশৃঙ্খলার সমস্যা আন্দাজ করতে না পারলে সেটা পুলিশের ব্যর্থতা হিসেবেই ধরা উচিত বলে মনে করেন ওই অফিসাররা।

এক ইনস্পেক্টরের কথায়, ‘‘যে ভাবে শতাধিক গুন্ডা পাঁচিল টপকে ওই জমির দখল নিতে তাণ্ডব চালাল এবং সাংবাদিকদের আটকে রেখে মারধর করল, তাতে তো কেউ খুনও হয়ে যেতে পারতেন! সে ক্ষেত্রেও কি আমরা বলতাম, বিষয়টি বিচারাধীন!’’

ওই অফিসারের মতে, বন্দর কর্তৃপক্ষ জমির দখল নেওয়ার পরে সেখানে পুলিশ দেখলে হয়তো নতুন ভাবে তা জবরদখল করার সাহস পেত না ভাড়াটে গুন্ডারা। আর সেটা ভেবেই উপরমহলের নির্দেশে পুলিশ পাঠানো হয়নি। ওই অফিসারের কথায়, ‘‘ক্রমাগত এ সব হতে হতে বাহিনীর মনোবল যে কোথায় গিয়ে ঠেকছে, সেটা বুঝতে পারছেন না সরকার ও লালবাজারের শীর্ষ মহল।’’

এক ওসি বলছেন, ‘‘বিচারাধীন বিষয় বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে না।’’ আর এক ইনস্পেক্টরের বক্তব্য, দুই ব্যবসায়ীর মধ্যে, এমনকী দুই ভাইয়ের মধ্যে জমি-বাড়ির মালিকানা নিয়ে বিচারাধীন বিষয়ে পুলিশ দু’পক্ষের কাছ থেকেই কিছু আদায়ের জন্য হস্তক্ষেপ করে। আর যেখানে পোর্ট ট্রাস্টের মতো সংস্থা নিজেদের জমির দখল নিয়ে সে কথা পুলিশকে লিখিত ভাবে জানিয়ে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে অনুরোধ করেছে, সেখানে পুলিশ গেল না? আর পুলিশকে তো ওই জমি পাহারা দিতে হত না। আইনশৃঙ্খলা রাখার জন্য ওখানে গেলেই হতো।

কলকাতার একটি থানার ওসি-র কথায়, ‘‘কেউ উপরমহলের ঘনিষ্ঠ বা বশংবদ হলে তাঁর স্বার্থরক্ষার জন্য প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয় বিসর্জন দিতে হবে। ইদানীং আমরা এটাই শিখছি, জানছি! তারাতলার ঘটনার পর আরও ভাল ভাবে শিখে নিলাম!’’ এক সহকারী কমিশনারের আক্ষেপ, ‘‘আমরা নাকি আইনরক্ষক! এখন এই কথা শুনলে নিজেদেরই হাসি পায়। আইনরক্ষার চেয়েও অগ্রাধিকার এখন সরকার তথা শাসকদলের ঘনিষ্ঠদের স্বার্থরক্ষা।’’

লালবাজারের এক কর্তা অবশ্য দাবি করছেন, ‘‘আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়েছে এবং হস্তক্ষেপ করেছে। সেই জন্যই তো বড় কিছু হয়নি।’’

পুলিশ পৌঁছনোর আগে শতাধিক গুন্ডার তাণ্ডবে হটে গিয়েছেন পোর্ট ট্রাস্টের নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষীরা। সাংবাদিক-চিত্র সাংবাদিকেরা প্রহৃত হয়েছেন, তাঁদের প্রাণ সংশয়ের উপক্রম হয়েছে। তার পরেও বড় কিছু হয়নি মানে কী?

‘‘মানে, কেউ তো প্রাণে মারা যাননি,’’ বলছেন ওই পুলিশকর্তা!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE