Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Delayed Rain In West Bengal

‘বিপর্যয়’ বাংলার জন্যও ডেকে এনেছে ঘোর বিপর্যয়, তার কারণেও বর্ষার বিলম্বিত লয়

বেশ কয়েক বছর ধরেই বর্ষা চলেছে ঢিমে তেতালায়। তবে এ বার একটু অন্য রকম। এ বার তার রকমসকম আগে থেকে একেবারেই আঁচ করতে পারছেন না আবহবিদেরা।

আষাঢ়ে ‘আশার আলো’ দেখাতে পারছে না বৃষ্টি।

আষাঢ়ে ‘আশার আলো’ দেখাতে পারছে না বৃষ্টি। প্রতীকী ছবি।

দেবদূত ঘোষঠাকুর
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০২৩ ১০:৪৩
Share: Save:

আজ বাদে কাল ১ আষাঢ়। আষাঢ় মানেই বর্ষা। আর বর্ষা মানেই ‘কালীমাখা মেঘে ওপারে আঁধার ঘনিয়েছে দেখ চাহি রে।’

টিনের চালে একটানা বৃষ্টির জলতরঙ্গ, মাটির সোঁদা গন্ধ, ব্যাঙেদের কোরাস আর বেশ কয়েকটা রেনি ডে— এটাই আম বাঙালির বর্ষাকাল। খিচুড়ি-ইলিশ মাছ ভাজা খাওয়ার ইচ্ছে ষোল আনা। কিন্তু ইলিশ হয়তো দামে পোষাবে না, অগত্যা অন্তত খিচুড়ি-ডিমভাজা বাঙালির বর্ষার বিলাসিতা।

কিন্তু বৃষ্টিই যদি তেমন ভাবে না পড়ে, ঘন কালো বর্জ্রগর্ভ মেঘ যদি তৈরি না-হয়, তা হলে তো সব মাটি! কেন্দ্রীয় আবহাওয়া মন্ত্রকে থাকা শতাধিক বছরের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে তৈরি হয় আবহাওয়ার বার্ষিক দিনলিপি বা ক্যালেন্ডার। সেইমতো পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হলেও আষাঢ়-শ্রাবণ মাস বর্ষাকাল। বৃষ্টিতে ভেসে গেলেও ভাদ্র-আশ্বিন এখনও শরৎকাল। শরতে এখন আর মেঘমুক্ত আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ হয় না। বরং দেখা যায় ‘আজি নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।’ শরৎ গিয়ে চেপে বসেছে হেমন্তের ঘাড়ে। হেমন্ত ঋতু হামাগুড়ি দিয়ে উঠে পড়েছে শীতের পিঠে।

এ সব পরিবর্তন আমজনতা হাড়ে হাড়ে টের পেলেও এখনও দক্ষিণবঙ্গে বর্ষা হইহই করে ঢুকে পড়ার দিন হল ৮ জুন। বিদায় নেওয়ার দিন ৮ অক্টোবর। আবহাওয়া দফতরের তৈরি নির্ঘণ্ট মেনে বর্ষা আসুক আর না-ই আসুক, তাতে আমাদের কোনও হেলদোল নেই। তবে যাঁরা আমাদের মুখে ভাতের যোগান দেন, সেই কৃষকদের জন্য বর্ষার নির্ঘণ্ট কিন্তু বাঁচা-মরার শামিল। তাঁদের সেই ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে বীজতলা তৈরি করতে হচ্ছে। তার পরে আকাশের দিকে হা-পিত্যেশ করে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে। গত দু’বছর বীজতলাতেই ঝলসে গিয়েছে ধানের চারা। এ বারেও বর্ষা চলেছে বিলম্বিত লয়ে। তাই উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন বাংলার কৃষক। পঞ্চায়েত ভোটে এসব অবশ্য কোনও দিনও গুরুত্ব পায় না। এবারেও পাচ্ছে না।

বেশ কয়েক বছর ধরেই বর্ষা চলেছে ঢিমে তেতালায়। তবে এ বার একটু অন্যরকম। এ বার তার রকমসকম আগে থেকে একেবারেই আঁচ করতে পারছেন না আবহবিদেরা। পর পর এতগুলি ঘটনা প্রশান্ত মহাসাগর‌, ভারত মহাসাগর, আরব সাগর এবং আন্দামান সাগরে ঘটে চলেছে, যার মাশুল‌ দিতে হতে পারে কৃষকদের।

এক এক করে শুরু করা যাক। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষ পর্যন্ত প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে মুখ করে ছিল মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের মূল ধারাটি। অন্য ধারাটি অবশ্য আন্দামানের উপরে ঘোরাফেরা করছিল বেশ কয়েকদিন ধরে। তারপরে নির্দিষ্ট দিকে, অর্থাৎ বঙ্গোপসাগরের দিকে না-গিয়ে সে চলে যায় দক্ষিণ চিন সাগরের দিকে। ফলে জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের গোড়াতেও উত্তরবঙ্গের পাহাড়ের‌ তাপমাত্রা পাল্লা দিচ্ছিল রাজস্থানের‌ সঙ্গে। পাহাড় জুড়ে ছিল প্রচন্ড জলকষ্ট। উত্তর-পূর্বাঞ্চল হয়ে উত্তরবঙ্গে বর্ষা ঢোকার কথা ছিল ৫ জুনের মধ্যে। কিন্তু সেখানে খুব দুর্বল মৌসুমি বায়ু পৌঁছল চলতি সপ্তাহে।

ভারতীয় উপকূলে বর্ষা কখন, কী ভাবে ঢুকবে, তার একটা নিয়ম আছে। কয়েকটি ঘটনা পর পর সঠিক ছন্দে ঘটলে তবেই বর্ষা তার নির্দিষ্ট গতিপথ বজায় রাখে।

১. দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু আমাদের দেশে আসে দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে। মে মাসে তার যাত্রা শুরু হয়। বিষুবরেখা পেরিয়ে সে আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে ঢোকে।

২. সূর্য কিছুটা উত্তরদিকে সরতে থাকায় এপ্রিল-মে মাসে দিল্লি, রাজস্থানে তাপমাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে যায়। প্রায় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়ে ফেলে। সমতল এবং সমুদ্রের মধ্যে তাপমাত্রার ফারাকটা যত বাড়ে, মৌসুমি বায়ু তত দ্রুত ভারতীয় ভূখন্ডের দিকে এগিয়ে যা‌য়।

কিন্তু এ বার কী হল?

প্রথমত, বিষুবরেখা পেরিয়ে মৌসুমি বায়ু আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে ঢোকার মুখে এবার পাহাড়প্রমাণ বিপদের মুখে পড়েছে। সেটি হল উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে তৈরি হওয়া ‘টাইফুন’। যা মৌসুমি বায়ুকে বিষুবরেখা পেরোতেই দেয়নি। টেনে নিয়ে গিয়েছে নিজের দিকে। অর্থাৎ শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে বর্ষা।

দ্বিতীয়ত, এই পরিস্থিতির জন্য মূলত এল নিনো-কেই দায়ী করছেন আবহবিদেরা। এপ্রিল মাস থেকে শুরু হয়েছে। অর্থাৎ বাড়তে শুরু করেছে প্রশান্ত মহাসাগরের তাপমাত্রা। তার প্রভাবেই যত গোলমাল। উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত‌ মহাসাগরে তৈরি হয়েছে ‘টাইফুন’।

তৃতীয়ত, যে সময়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতে তাপপ্রবাহ শুরু হওয়ার কথা, সেখানে তখন বৃষ্টি হয়েছে। তাপমাত্রা বাড়তেই পারেনি। অর্থাৎ মৌসুমি বায়ুকে যে পরিস্থিতি টেনে আনবে, সেই আকর্ষণ শক্তিটাই এবার অনুপস্থিত।

সবমিলিয়ে বর্ষা বার বার পথ হারিয়ে মূল ভারতীয় ভূখণ্ডে পৌঁছতেই দেরি করে ফেলেছে। দেরিতে পৌঁছনোর পরেও আবার বাধা। আরবসাগরে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড় ‘বিপর্যয়’। এই মুহূর্তে তা গুজরাত উপকূলে ধ্বংসের বার্তা নিয়ে হাজির। ‘বিপর্যয়’ নিয়ে আমাদের এত উদ্বেগের কিছু থাকত না, যদি না সে‌ আমাদের স্বার্থে আঘাত দিত।‌ ‘বিপর্যয়’-এর ঝাপ্টা বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকায় পড়েনি ঠিকই, কিন্তু তার শক্তি যত বেড়েছে, বঙ্গোপসাগর উপকূলের সব জলীয় বাষ্পকে সে তত টেনে নিয়ে চলে গিয়েছে গুজরাতের দিকে।

বর্ষা উত্তরবঙ্গে দেরিতে ঢুকলেও সে এখন সেখানে গা-গরম করছে। দক্ষিণবঙ্গে কবে সে পৌঁছতে পারে, তার জন্য আবহবিদেরা ঘূর্ণিঝড় ‘বিপর্যয়’-এর দিকেই তাকিয়ে আছেন। কারণ, ওই ঘূর্ণিঝড় স্থলভূমিতে ঢুকে দুর্বল হয়ে যাওয়ার পরে বঙ্গোপসাগরের জলীয় বাষ্প আর পশ্চিম উপকূলের দিকে যাবে না। বরং বঙ্গোপসাগর উপকূলে জোরদার বর্ষণের পরিস্থিতি তৈরি হবে।

কিন্তু সেটা হবে কবে? আবহবিদেরা এখনও অঙ্কের ফল পাননি।

অন্য বিষয়গুলি:

Weather Report
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy