ফোনের বিবর্তনেই কি মনের বিবর্তন? মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপনে দুনিয়া মুঠোয় ধরার স্বপ্ন ফেরি দেখা গিয়েছিল চলতি শতাব্দীর গোড়ায়। আড়াই দশকে সেই মোবাইল ফোন অত্যাবশ্যকীয় পণ্য। একদা থান ইটের মতো মোবাইল এখন ছিপছিপে হয়ে ‘স্মার্ট’। ইন্টারনেটের দুরন্ত গতিতে আক্ষরিক অর্থেই দুনিয়া মুঠোয়। সেই দুনিয়ায় অনেক কিছুর মতো বদলে গিয়েছে রাজনীতির ধারাপাতও। যে রাজনীতিতে ‘নেশাদার’দের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছেন ‘পেশাদার’রা।
রাজনীতির নেশায় পেশা ছেড়ে সর্ব ক্ষণের কর্মী হওয়া বাংলায় নতুন নয়। বাম রাজনীতিতে এমন উদাহরণ অনেক। কংগ্রেস, বিজেপিতেও রয়েছে। তৃণমূলে যদিও ‘হোলটাইমার মডেল’ খুব একটা দেখা যায় না। একটা সময় পর্যন্ত সেই নেশাদারেরা ছিলেন নিয়ন্ত্রক। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতি সেই নেশাদারদের কার্যত পার্শ্বরেখার পাশে সরিয়ে পেশাদারদের অন্তর্ভুক্ত করে দিচ্ছে। উল্লেখ্য, এই পেশাদার গোষ্ঠী বা সংস্থার প্রাথমিক কাজ হচ্ছে সমীক্ষা করা। এলাকা ধরে সমীক্ষার মাধ্যমে ভোটারদের মন বোঝার চেষ্টা চালায় তারা। তার পরে মন বুঝে ফোন মারফত পৌঁছে দিতে থাকে চাহিদামতো উপাদান। প্রায় সব দলকেই রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাখতে হচ্ছে। যার অর্থ, দলের কর্মীদের মাধ্যমে নিচুতলা থেকে আসা তথ্যের ভিত্তিতে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করার দিন ফুরিয়েছে। দক্ষিণ ভারতে জগনের হয়ে কাজ করা এক বাঙালি তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞের যেমন বক্তব্য, ‘‘একটা ব্লেড বা রেজ়ার প্রস্তুতকারক সংস্থা যেমন বাজার বিশ্লেষণ করে তার বিপণনের উপাদান তৈরি করে, এখানেও কৌশল সেই একই। সব সময় যে তা ফল দেয়, তা নয়। কিন্তু প্রক্রিয়াটা অভিন্ন।’’
সর্বভারতীয় স্তরের রাজনীতিতে পেশাদার সংস্থা বা বিভিন্ন ক্ষেত্রের পেশাদারদের নিয়োগ করা শুরু হয়েছিল এক দশক আগে। এখন বাংলার রাজনীতিতেও সেই প্রবণতা চোখের পড়ার মতো করে বাড়ছে। তৃণমূলের পাশাপাশি বিজেপি, এমনকি, বামেরাও পেশাদার নিয়োগ করে ২০২৬ সালের ভোটের প্রস্তুতি শুরু করেছে পশ্চিমবঙ্গে।
২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে বাংলায় বিজেপির কাছে ধাক্কা খাওয়ার পরে প্রশান্ত কিশোরকে নিয়োগ করেছিল তৃণমূল। তাঁর সংস্থা আইপ্যাক তৃণমূলের হয়ে তখন থেকেই কাজ করছে। প্রশান্ত পেশা থেকে চলে গেলেও পেশাদার সংস্থাটি রয়ে গিয়েছে তৃণমূলের সঙ্গে। বঙ্গ বিজেপি-ও পেশাদার সংস্থা নিয়োগ করেছে। কমবয়সি, আদর্শগত ভাবে হিন্দুত্ববাদী, প্রযুক্তি সম্পর্কে সম্যক ধারণা রয়েছে— এমন সব মাপকাঠিতে কর্মী নিয়োগ করছে পদ্মশিবিরের বরাত পাওয়া সংস্থা। আবার সিপিএমও নিয়োগ করেছে পেশাদারদের। রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমই সমাজমাধ্যমে ‘লোক খুঁজছি’ মর্মে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। হাজার দেড়েক আবেদনপত্রও পড়েছিল। তার মধ্যে ছেঁকে ২০-২২ জনকে নিয়েছে সিপিএম। রিপন স্ট্রিটের একটি বাড়িতে সিপিএমের হয়ে কাজ করার জন্য সেই পেশাদারেরা গৃহপ্রবেশও সেরে ফেলেছেন।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর (পিকে) এবং তাঁর ‘টিম’ কাজ করেছিল নরেন্দ্র মোদী তথা বিজেপির হয়ে। সেই ভোটেই দেশ প্রথম দেখেছিল, সমাজমাধ্যমকে নির্বাচনী রাজনীতিতে কী ভাবে ব্যবহার করা যায়। রাজনীতিক দলে যে ‘আইটি সেল’ বলে একটা বিষয় থাকতে পারে, তা প্রথম দেখিয়েছিল পদ্মশিবিরই। সর্বভারতীয় স্তরে কংগ্রেসও তার পর পেশাদার নিয়োগ করেছে। প্রশান্তের টিমে থাকা সুনীল কানুগুলু এখন রাহুল গান্ধীর দলের কাজকর্ম দেখেন। কর্নাটক এবং তেলঙ্গনায় কংগ্রেসের সরকার গঠন, প্রচারের রূপরেখা তৈরি করার নেপথ্যে কানুগুলুর মস্তিষ্ক কাজ করেছে বলেই অভিমত কংগ্রেসের অনেকের। যদিও দিল্লির রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহালদের অনেকের বক্তব্য, তার আগেও পেশাদার মস্তিষ্ক কাজ করেছিল অণ্ণা হাজারের আন্দোলনে। যে আন্দোলন কেন্দ্রে কংগ্রেসের সরকার পতনে অন্যতম অনুঘটকের কাজ করেছিল। দিল্লিতে অরবিন্দ কেজরীওয়াল, অন্ধ্রে জগনমোহন রেড্ডিরাও পেশাদার সংস্থার সাহায্য নিয়েছেন। কখনও জিতেছেন, কখনও হেরেছেন। কিন্তু পেশাদারদের পাশে নিয়ে চলেছেন তাঁরা।
বাংলার রাজনীতিতে একটা সময়ে বুথ কমিটি, পাড়া বৈঠক, স্ট্রিট কর্নার, জাঠা ছিল ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতি’। কিন্তু তা আমূল বদলে গিয়েছে গত কয়েক বছরে। পুরনো পন্থা একেবারে উঠে গিয়েছে তা নয়। কিন্তু তাতে মরচে ধরছে। তৈরি হচ্ছে নতুন পথ। যার আধার হয়ে উঠছে মোবাইল ফোন। একটা সময়ে সমস্ত রাজনৈতিক দলের কাজ ছিল দুয়ারে পৌঁছে মানুষের মন বোঝা। কিন্তু এখন সেই প্রবণতা কমছে। ফোন থেকে মন বোঝার কাজে নিয়োগ করতে হচ্ছে পেশাদারদের।
আরও পড়ুন:
কেন, তা নিয়ে বিবিধ ব্যাখ্যা রয়েছে। বামমনস্ক অনেকের বক্তব্য, এই প্রবণতাকে বিচ্ছিন্ন ভাবে দেখলে হবে না। এটি সার্বিক প্রবণতা। সব কিছুর মতো মানুষের মনও এখন পণ্য। ফলে তা কেনার জন্য পেশাদার লাগছে। আবার কংগ্রেসি ঘরানার পুরনো নেতারা বলছেন, সময় দিয়ে দলের কাজ করার লোক কমছে। ফলে পেশাদার নিয়োগ করে বিকল্প উপায়ে তা করতে হচ্ছে। আনুষ্ঠানিক ভাবে না মানলেও উত্তর-পূর্ব ভারতের বিজেপির এক সাংসদ একান্ত আলোচনায় বলেছেন, পেশাদার লোক না হলে ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রোপাগান্ডা’ বাস্তবায়িত করা যাবে না।
পশ্চিমবঙ্গ সিপিএমের প্রবীণ নেতা তথা ভোট সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা রবীন দেব নতুন পন্থাকে মেনে নেওয়ার পক্ষে। তাঁর কথায়, ‘‘প্রযুক্তির অগ্রগতি ঘটছে। সেই বাস্তবতাকে আমাদের মানতেই হবে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাই কাম্য। আক্ষেপ করে লাভ নেই।’’ তৃণমূলের প্রবীণ নেতা নির্বেদ রায় আবার ভিন্ন মত পোষণ করছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এজেন্সি আজ আছে, কাল না-ও থাকতে পারে। এটা পরীক্ষামূলক পদ্ধতিতে চলছে। কিন্তু শেষ কথা হল মানুষ।’’ রাজ্যসভার বিজেপি সাংসদ শমীক ভট্টাচার্যও মানছেন, বদলে যাওয়া সময়ের কারণেই পেশাদারদের হয়তো প্রয়োজন হচ্ছে। তবে তৃণমূলের উদ্দেশে খোঁচা দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘‘পেশাদার সংস্থা যদি দলের রাজনৈতিক সব কাজ করে দেয়, তা হলে তৃণমূলের মতো অবস্থা হবে।’’
তৃণমূলের এক তরুণ নেতার কথায়, ‘‘২০২১ সালের ভোটে আইপ্যাক যে ভাষ্য তৈরি করেছিল প্রচারে, তা আমাদের জন্য ইতিবাচক হয়েছিল। ২০২৪ সালের ভোটেও তাই। সেই কারণেই হয়তো সর্বোচ্চ স্তরের একটি অংশ থেকে পেশাদার সংস্থার সঙ্গে ‘সাময়িক দূরত্ব’ তৈরি হলেও পরে তা মিটে গিয়েছে। কারণ, পরিস্থিতি এমনই।’’
একটা সময়ে বামেরা স্লোগান দিয়েছিল ‘লাঙল যার, জমি তার’। সেই বামেরাই ২০০৬ সালের ভোটের আগে স্লোগান দিয়েছিল ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’। দু’টি স্লোগানের নেপথ্যে কোনও পেশাদারের মস্তিষ্ক ছিল না। যেমন ছিল না ২০১১-র প্রাক্পর্বে তৃণমূলের দেওয়া ‘পরিবর্তন চাই’ বা ‘চলো পাল্টাই’ স্লোগানে। কিন্তু ‘হর হর মোদী, ঘর ঘর মোদী’ বা ‘বাংলা নিজের মেয়েকে চায়’ ছিল পেশাদার সংস্থার তৈরি করা স্লোগান। সেই ধারাতেই বামেরাও ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে পেশাদারদের তৈরি তেমন কিছু প্রকাশ্যে আনতে পারে। বিজেপি যে ভাষ্য তৈরি করেছে ইতিমধ্যেই, তা আরও ধারালো করতে তৈরি হবে নতুন স্লোগান। তাতেও থাকবে পেশাদার মস্তিষ্ক।
এক দিকে স্মার্ট ফোনে ইন্টারনেট সংযোগের ফলে পাল্টে যাওয়া সময়। অন্য দিকে, কোভিড-পরবর্তী সময়ের সঙ্কট। উভয়ই প্রভাব ফেলেছে সমাজ এবং অর্থনীতিতে। রাজনীতি সেই অভিঘাতের বাইরে থাকবে কী করে! ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত হচ্ছে সব ভোট রাজনীতির ময়দানে নামা সমস্ত দলকে। নেশাদারদের জায়গা নিয়েছেন পেশাদারেরা। এক পিকে ময়দান ছেড়ে গিয়েছেন। তাঁর জায়গায় আসছেন শয়ে শয়ে পিকে।