বিধানসভা নির্বাচনের বাকি মেরেকেটে এক বছর। যুদ্ধের জন্য ঘর গোছাতে শুরু করেছে সব রাজনৈতিক দল। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামের সভা থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনৈতিক পরামর্শদাতা সংস্থা আইপ্যাক-কে সঙ্গে নিয়ে চলার বার্তা দিয়েছেন দলের সর্ব স্তরের নেতাদের। পাশাপাশি, রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপিও ‘রাজনৈতিক বিশ্লেষক’ সংস্থার দ্বারস্থ হয়েছে। ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বঙ্গবিজয়ের লক্ষ্যে ওই সংস্থার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে চলবে পদ্মশিবির। বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির হয়ে ভোটের জমি চাষ করা হবে সেই পদ্ধতিতে। ইতিমধ্যেই বিশ্লেষক সংস্থাটির সঙ্গে কাজ করার জন্য দলের নিচুতলায় নির্দেশ দেওয়ার কাজ শুরু করেছেন নেতারা।
কাদের নিয়োগ, কী নিয়ম
রাজনৈতিক বিশ্লেষক দলে মূলত কাজ করবেন ‘হিন্দুত্ববাদী’ রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসীরা। তাঁদের বয়স ৩৫ বছরের নীচে হতে হবে। যাঁরা আবেদন করতে ইচ্ছুক, তাঁদের একটি নির্দিষ্ট ইমেল ঠিকানায় নিজেদের ‘বায়োডাটা’ পাঠাতে হবে। বেতন দেওয়া হবে মাসিক ৩৫ হাজার টাকা। আবেদনকারীর দু’চাকার বাহন (মোটরবাইক বা স্কুটার) অথবা যে কোনও ধরনের বাহন থাকা আবশ্যিক। শিক্ষাগত যোগ্যতা ‘স্নাতক’। স্মার্টফোন থাকতেই হবে। ল্যাপটপে কাজ করতে জানাও বাধ্যতামূলক। পাশাপাশিই, আবেদনকারীদের কম্পিউটার শিক্ষার ‘এমএস অফিস’ এবং ‘গুগ্ল’ সম্পর্কে জ্ঞান থাকাও জরুরি। বিজেপির পরিষদীয় দল সূত্রের খবর, ওই নিয়োগের ক্ষেত্রে মূলত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সদস্যদের আবেদন করতে বলা হয়েছে। বিজেপি ছাড়া অন্যান্য ‘হিন্দুত্ববাদী’ সংগঠনের সদস্যেরাও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সংস্থাটির হয়ে কাজ করার জন্য আবেদন করতে পারবেন। পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি লোকসভা কেন্দ্রে ভাগ করে কাজ করবে সংস্থাটি।
আরও পড়ুন:
নিয়োগের লক্ষ্য কী
সংশ্লিষ্ট সংস্থাটি মূলত মাঠে নেমে ‘প্রকৃত তথ্য’ সন্ধান থেকে শুরু করে রাজ্যের রাজনৈতিক ঘটনাক্রমের উপর নজর রেখে তার ‘সত্যতা’ যাচাই করবে। পাশাপাশি, স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবর সংগ্রহ এবং তাদের প্রভাবের বিষয়টিও নজরে রাখবে তারা। কোনও এলাকায় সমস্যা রয়েছে কি না, থাকলে তা কত দিন ধরে সমাধান করা হয়নি, কী ভাবে সেই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব, সংশ্লিষ্ট সমস্যার সঙ্গে কত মানুষের সরাসরি যোগ রয়েছে, ওই সমস্যার সঙ্গে ভোট রাজনীতির সরাসরি যোগসূত্র আছে কি না, সংশ্লিষ্ট এলাকায় বুথভিত্তিক রাজনীতিতে জাতপাতের সমীকরণ কী— মূলত এই বিষয়গুলি বিশ্লেষক সংস্থার নজরে থাকবে। বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রার্থী চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রেও ভূমিকা থাকবে ওই সংস্থার।
কেন প্রয়োজন
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ১৮টি আসন জিতেছিল বিজেপি। আর শাসক তৃণমূল ৩৪টি আসন থেকে কমে ২২ হয়ে যায়। মে মাসে লোকসভা ভোটের ফলাফল প্রকাশের পর জুন মাসে তৃণমূলের ‘রাজনৈতিক পরামর্শদাতা’র দায়িত্ব নেন প্রশান্ত কিশোর। তাঁর সংস্থা আইপ্যাকের দু’বছরের পরিশ্রমের ফল হিসেবে তৃতীয় বার রাজ্যের ক্ষমতায় ফেরেন মমতা। প্রশান্ত অবশ্য এখন আর আইপ্যাকে নেই। তাঁর জায়গায় ওই সংস্থার দায়িত্বে রয়েছেন প্রতীক জৈন। তাঁর অধীনস্থ আইপ্যাক তৃণমূলকে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনেও জিততে সাহায্য করেছে। আইপ্যাকের পাল্টা সংস্থা নিয়োগ করে সীমান্তবর্তী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে পদ্মফুল ফোটাতে চায় বিজেপি।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের নিরিখে বিজেপি রাজ্যের ১২১টি বিধানসভা কেন্দ্রে এগিয়ে থাকলেও ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তারা মাত্র ৭৭টি আসন জিততে পেরেছিল। তার পরে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটেও রাজ্যে বিজেপির বিপর্যয় হয়েছে। ২০১৯ সালে জেতা আটটি আসন হারাতে হয়েছে তাদের। যদিও পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কাঁথি এবং তমলুকের নতুন দু’টি আসনে পদ্মফুল ফুটিয়েছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। কিন্তু তাতেও রাজ্যে বিজেপির সাংসদসংখ্যা ১৮ থেকে নেমে ১২ হয়ে গিয়েছে। যদিও অনেকের বক্তব্য, সারা দেশেই বিজেপির ফল তুলনায় খারাপ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ তার ব্যতিক্রম হতে পারে না। কিন্তু বিধানসভা ভোট লোকসভার চেয়ে আলাদা। তাই বিধানসভা ভোটের এক বছর আগে থেকেই বিশেষজ্ঞ রাজনৈতিক বিশ্লেষক সংস্থাকে দায়িত্ব দিয়ে ভোটযুদ্ধের জমি তৈরি করতে উদ্যোগী হয়েছে বিজেপি। তবে বিজেপির কোনও নেতা প্রকাশ্যে ওই সংস্থা এবং সেই সংস্থায় কর্মী নিয়োগের কথা মানতে নারাজ। দলের এক তাত্ত্বিক নেতার দাবি, ‘‘এমন কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ২০২১ সালে বাংলায় শাসকদলের হয়ে একটি কর্পোরেট সংস্থা কাজ করেছিল। তারা তৃণমূলকে ভোটেও জিতিয়েছিল। কিন্তু ভোটের পর যে সন্ত্রাস হয়েছিল, তার দায় সেই সংস্থা নেয়নি। ফলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক সংস্থা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের অভিজ্ঞতা ভাল নয়।’’ তবে পাশাপাশিই ওই নেতা বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে চাকরিবাকরির যা অবস্থা, তাতে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাই কোনও সংস্থায় যদি বিজেপি বা অন্য কোনও সংগঠনের ছেলেরা কাজ করেন, তাতে আমাদের কোনও আপত্তি নেই, থাকতেও পারে না।’’