Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Rajanya Haldar

রাজন্যার উত্থানের নেপথ্যে কে? ‘রাজনীতিহীন’ প্রচার বুভুক্ষা নিয়েও আলোচনা শাসক তৃণমূলের অন্দরে

ছবির পোস্টারে ‘আরজি কর ঘটনার পটভূমিকায়’ লেখা এবং রাজন্যার গলায় স্টেথোস্কোপ দেখানোকে অনেকে ‘সস্তার প্রচার’ বলে অভিহিত করেছেন। দলও ‘স্পর্শকাতর’ বিষয়ে এ হেন প্রচার অনুমোদন করেনি।

Who is behind the rise of Rajnya Haldar, Prantik Chakraborty in the TMC’s student organization

রাজন্যা হালদার। —ফাইল ছবি।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৬:০০
Share: Save:

মাথায় রাজনীতির বুনিয়াদি পাঠ না দিয়েই কি পদ এবং প্রচারের আলো ছড়িয়ে কাউকে কাউকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হচ্ছে? তার খেসারতই কি দিতে হল এই সঙ্কটের সময়ে? আরজি কর-কাণ্ডের পটভূমিকায় স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি নির্মাণের কারণে তৃণমূলের ছাত্র সংগঠন থেকে রাজন্যা হালদার এবং প্রান্তিক চক্রবর্তীকে সাসপেন্ড করার পর এই ময়নাতদন্ত শুরু হয়েছে শাসকদলের অন্দরে। পাশাপাশিই কৌতূহল তৈরি হয়েছে, তৃণমূলে রাজন্যার উত্থানের নেপথ্যে কে বা কারা?

তৃণমূলের প্রথম সারির অনেক নেতা তো বটেই, ছাত্র সংগঠনের নেতাদের একাংশও একান্ত আলোচনায় মানছেন, রাজন্যা (এবং তাঁর স্বামী প্রান্তিক) টিএমসিপি-র সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্যের ‘ঘনিষ্ঠ’। এক ধাপ এগিয়ে কারও কারও এমনও দাবি যে, তৃণাঙ্কুরের জন্যই তৃণমূলে রাজন্যার উল্কার গতিতে উত্থান। ২০২৩ সালের ২১ জুলাইয়ের মঞ্চে তৃণমূলের তরফে সবচেয়ে বড় ‘চমক’ ছিল রাজন্যার বক্তৃতা। তিনি মঞ্চে আবির্ভূতা হওয়ার আগে অনেক নেতাই জানতেন না, রাজন্যা বলবেন। দলের সিঁড়ির প্রথম ধাপে প্রেসিডেন্সির এই প্রাক্তনীর সেই প্রথম পদক্ষেপ। যদিও তার সলতে পাকানো হয়েছিল আগের দিন বিকালে। সভাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাত্র নেতৃত্বের কাছে জানতে চান, কোনও তরুণী ভাল বক্তা রয়েছেন কি না। তখন সেখানে রাজন্যারা গিটার হাতে গান গাইছিলেন। তৃণমূলের এক ছাত্রনেতার কথায়, ‘‘তৃণাঙ্কুরই দিদিকে সে দিন রাজন্যার কথা বলেছিলেন। রাজি হয়েছিলেন দিদিও।’’

২১ জুলাইয়ের মঞ্চে প্রথম বক্তৃতার পরে প্রচারের আলো গিয়ে পড়ে রাজন্যার উপর। পরবর্তী সময়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হস্টেলে ছাত্রের মৃত্যুর পরে সেখানকার সংগঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে। তৃণমূলের মতো একটি অ-বামপন্থী এবং ‘গণতান্ত্রিক’ এই সবই উত্থানের ‘সূচক’। দলে দ্রুত জল্পনা শুরু হয়, রাজন্যা কি লোকসভা ভোটে প্রার্থী হচ্ছেন? রাজন্যার ঘনিষ্ঠেরাও সে বিষয়ে ‘উৎসাহী’ হয়ে পড়েন। প্রান্তিক অবশ্য ততটা প্রচারে ছিলেন না। তবে তিনি টিএমসিপির রাজ্য সংগঠনে সহ-সভাপতিদের এক জন। ফলে সাংগঠনিক ভাবে তাঁরও ‘প্রতাপ’ তৈরি হয়েছিল বলেই দাবি অনেকের।

মাঝে কয়েক মাস অবশ্য রাজন্যাকে সে ভাবে ময়দানে দেখা যায়নি। গত ১০ মার্চ ব্রিগেডে তৃণমূলের ‘জনগর্জন’ সভায় মঞ্চে দেখা যায় তাঁকে। তবে ‘বক্তা’ নয়। ‘গায়িকা’ হিসেবে। যথারীতি তা নিয়েও তৃণমূলে আলোচনা শুরু হয়েছিল। রাজনীতিতে ‘বক্তা’ থেকে ‘গায়িকা’ হয়ে যাওয়া উত্তরণের সঙ্কেত নয়। লোকসভার প্রার্থিতালিকায় রাজন্যার নাম ছিল না। ভোটের প্রচারে ছিল।

তিনিই কি রাজন্যার উত্থানের নেপথ্যে? তৃণাঙ্কুরের জবাব, ‘‘আমাদের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং যুব আইকন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব দেওয়ার দিনই বলেছিলেন, ভাল ছেলেমেয়েদের খুঁজে আনতে। আমি ধারাবাহিক ভাবে সেই কাজ করেছি। রাজন্যা বা প্রান্তিক নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করেই এই জায়গায় এসেছেন। তাঁর মানে আবার এই নয় যে, তাঁদের সব কাজের দায় আমার বা দলের উপর বর্তায়!’’ ছাত্র সংগঠনের নেতার উদাহরণ, ‘‘আমি কাল কোনও ভুল করলে তার দায় আমারই। দলের নয়।’’ পাশাপাশিই তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, সংগঠনে যুক্ত হওয়ার আগে থেকেই প্রান্তিক ছবি নির্মাণের কাজ করেন। তবে একই সঙ্গে বলেছেন, সংগঠনের পদে থাকলে কিছু কিছু জিনিস করা যায় না।

রাজনৈতিক ‘অপরিপক্কতা’ই কি রাজন্যাকে এই বিপাকে ফেলল? তৃণাঙ্কুরের জবাব, ‘‘ছাত্র বয়সে ভুল হয় বেশি।’’ তৃণাঙ্কুর জানিয়েছেন, ছবির বিষয় নিয়ে পরিচালক প্রান্তিকের ‘ব্যাখ্যা’ চাওয়া হয়েছিল। তিনি তাঁর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এখন সাংগঠনিক ভাবে গোটা বিষয়টির তদন্ত করা হচ্ছে। পরবর্তী সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত প্রান্তিককে সংগঠনের পদ থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে।

প্রান্তিকের বক্তব্য, তিনি ছোট বয়স থেকেই ছবি নির্মাণ করেন। তাঁর অনেক ছবি দেশ-বিদেশের চলচ্চিত্র উৎসবেও প্রদর্শিত হয়েছে। ২০১৬ সালে একটি নামী ওটিটি-তে তাঁর পরিচালিত একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবিও মুক্তি পেয়েছিল। এখন কি পরিচালক এবং রাজনৈতিক সত্তার সংঘাত তৈরি হচ্ছে? হাজরা ল’ কলেজের প্রাক্তনী প্রান্তিকের কথায়, ‘‘আমার দিক থেকে কোনও সংঘাত হচ্ছে না।’’

গত বছরেই রাজন্যার সঙ্গে আইনি বিয়ে সেরেছেন প্রান্তিক। ছবির প্রসঙ্গে শুক্রবার রাতে রাজন্যা বলেছিলেন, ‘‘প্রচ্ছদ দেখে গোটা উপন্যাস কেমন তা নির্ধারণ করা ঠিক নয়।’’ শনিবার প্রান্তিক বলেন, ‘‘এই ছবিটি নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর প্রতিবাদ-প্রতিরোধের। আমি মনে করি, রোজ প্রতিবাদ হওয়া প্রয়োজন। তা হলে অনেক বড় অপরাধকে প্রতিহত করা যায়।’’ তবে ছবির পোস্টারে ‘আরজি কর ঘটনার পটভূমিকায়’ লেখাটাই যে ‘কাল’ হয়েছে, তা মানছেন প্রান্তিক। সেই সঙ্গে এ-ও বলছেন, ‘‘শিল্পীকে তো কোথাও থেকে একটা রসদ পেতে হয়। আরজি করের ঘটনার পর সেই রসদ পেয়েছিলাম।’’ ইতিমধ্যেই রাজন্যা জানিয়েছেন, মহালয়ার দিনেই ছবি মুক্তি পাবে। রাজন্যা-প্রান্তিকদের ঘনিষ্ঠদের আশা, ছবিটি দেখে দল এবং ছাত্র সংগঠন তার বিষয়বস্তু ‘বুঝবে’।

ছবির পোস্টারে ‘আরজি কর ঘটনার পটভূমিকায়’ লেখা এবং রাজন্যার গলায় স্টেথোস্কোপ দেখানোকে অনেকেই ‘সস্তার প্রচার’ বলে অভিহিত করেছেন। শাসকদলও ‘স্পর্শকাতর’ বিষয়ে এ হেন প্রচারকে অনুমোদন করেনি। তৃণমূলের প্রথম সারির একাধিক নেতা মনে করেন, ২০২৩ সালের ২১ জুলাইয়ের সভার পর রাজন্যা হঠাৎ করেই প্রচারের আলোয় চলে এসেছিলেন। জেলায় জেলায় সভা করার জন্য বক্তা হিসাবে চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। সেই বিষয়টি কোথাও গিয়ে সম্ভবত বাস্তব থেকে তাঁকে কিছুটা দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘বুনিয়াদি রাজনৈতিক পাঠ না দিয়ে কেবল প্রচার দেওয়া হলে যা হওয়ার, এ ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘ধারাবাহিক আন্দোলনে থাকলে যে রাজনৈতিক বোধ তৈরি হয়, সে ক্ষেত্রে নতুনদের অনেকের ঘাটতি রয়েছে।’’

এখন দেখার ‘রাজন্যা-কাণ্ড’ ঘটার পরে নবীনদের বুনিয়াদি রাজনৈতিক শিক্ষার ঘাটতি মেটে কি না। দেখার এ-ও যে, যাচাই না করেই নবীনদের একাংশকে প্রচারের আলোয় ঠেলে দেওয়ার যে প্রবণতা প্রবীণদের একাংশের মধ্যে রয়েছে, তাঁরাও শিক্ষা নেন কি না।

অন্য বিষয়গুলি:

Rajanya Haldar Tmc Leader R G kar Incident
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy