(বাঁ দিকে) রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। রাজীব সিংহ (ডান দিকে)। — ফাইল চিত্র।
রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিংহের যোগদান রিপোর্টে (জয়েনিং রিপোর্ট) সই না-করে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। যার প্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে রাজীবের ওই পদে থাকা নিয়ে এবং রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
কিন্তু বৃহস্পতিবার বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে যা বোঝা যাচ্ছে, নির্বাচন কমিশনারের যোগদান রিপোর্টে সই না-করে ফিরিয়ে দিয়ে রাজ্যপাল তাঁর ‘ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ’ ঘটালেও রাজীবকে (বা অন্য কাউকে) নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে সরানোর কোনও এক্তিয়ার তাঁর নেই। রাজীবকে ওই পদ থেকে সরালে গেলে ‘ইমপিচমেন্ট’ করতে হবে। তাঁর বিরুদ্ধে সংসদে ‘ইমপিচমেন্ট’ প্রস্তাব আনতে হবে। তা-ও স্বয়ং রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে! অতএব, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ইস্তফা না দিলে রাজীবের পরিচালনাতেই হবে রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোট।
রাজ্যপাল বোসকে বৃহস্পতিবার রাজীবের যোগদান রিপোর্ট ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি শুধু বলেন, ‘‘সুষ্ঠু ভাবে ভোট পরিচালনার জন্য আমি তাঁকে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার হিসাবে নিয়োগ করেছিলাম। কিন্তু তিনি বাংলার মানুষকে হতাশ করেছেন।’’ অর্থাৎ, তিনি রাজীবকে ‘নিয়োগ’ করেছেন। রাজীব রাজ্যের মানুষকে ‘হতাশ’ করেছেন। এই পর্যন্তই! রাজীবকে তিনি সরিয়ে দেবেন, এমন কিছু রাজ্যপাল বলেননি। কারণ, সম্ভবত তিনি নিজেও জানেন, তা সম্ভব নয়। রাজ্যপালের পদক্ষেপের জেরে তিনি কি ইস্তফা দেবেন? রাজীবের জবাব, ‘‘এমন কোনও তথ্য পাইনি।” যা থেকে মনে করা যেতে পারে, তাঁর পদত্যাগ সংক্রান্ত জল্পনায় আপাতত জলই ঢেলে দিলেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার।
সূত্রের খবর, রাজ্যপাল রাজীবকে রাজভবনে তলব করা সত্ত্বেও কাজে ব্যস্ততার কথা বলে তিনি হাজির না-হওয়ায় চটেছেন রাজ্যপাল। তাই তিনি রাজীবের যোগদান রিপোর্টটি গ্রহণ না করে নবান্নে পাঠিয়ে দিয়েছেন। অনেকে বলছেন, রাজীব ৭ তারিখ থেকে ২১ তারিখ পর্যন্ত যা যা করেছেন, সবই রাজ্যপাল লক্ষ করেছেন বলে ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু ওই দু’সপ্তাহে তিনি যোগদান রিপোর্ট সই না-করে ফেরত পাঠানোর মতো সিদ্ধান্ত নেননি। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ঘটনাচক্রে রাজীব তাঁর ‘তলব’ অগ্রাহ্য করার পর। সেই কারণেই সেটিকে নেহাতই ক্ষোভের ‘প্রতীকী’ বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করা হচ্ছে। তার সঙ্গে রাজীবকে পদ থেকে অপসারণের কোনও সম্পর্কই নেই। থাকার কথাও নয়। এক আধিকারিক যেমন বলছেন, ‘‘নিয়োগ তো হয়েই গিয়েছে! তার পরে যদি নিযুক্ত আধিকারিকের জয়েনিং রিপোর্ট (যা নেহাতই ঔপচারিক) তাঁর নিয়োগকর্তা না-ও নেন, তাতে তো আর নিয়োগ বাতিল হয় না! নিয়োগকর্তা তো তাঁকে বরখাস্ত করছেন না। আর যোগদানের রিপোর্ট না গ্রহণ করা মানে তো কাউকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা নয়।’’
ঘটনাচক্রে, বৃহস্পতিবার পটনা যাওয়ার আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘আমাদের কাছে এমন কোনও তথ্য নেই (জয়েনিং রিপোর্ট ফেরত আসার)। জীবনে এ রকম হয়নি। উনি (রাজ্যপাল) শপথবাক্য পাঠ করিয়েছিলেন। সবটাই পদ্ধতি মেনে হয়েছে। এমন নয় যে, জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে সরাতে হলে বিচারপতিদের মতো করতে হবে। ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে সরাতে হবে। এটা এত সহজ নয়।’’
সহজ যে নয়, তা বিলক্ষণ জানেন রাজ্যপাল বোসও। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের একাংশ জানাচ্ছেন, যোগদান রিপোর্টে রাজ্যপাল সই না করায় বা কলকাতা হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণ (আদালতের কেন্দ্রীয় বাহিনী সংক্রান্ত নির্দেশ পালন করতে না চাইলে রাজ্যপালের কাছে গিয়ে ইস্তফা দিতে পারেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার) সত্ত্বেও রাজ্য নির্বাচন কমিশনার পদে বহাল থাকতে রাজীবের কোনও অসুবিধা নেই। কারণ, রাজ্যপালের অনুমোদন নিয়েই ওই পদে রাজীবকে নিয়োগ করা হয়েছিল। রাজ্যের পাঠানো তিন আমলার তালিকা থেকে রাজীবের নাম বেছে নিয়েছিলেন রাজ্যপাল বোস স্বয়ং। অবসরপ্রাপ্ত আইএএস তথা রাজ্যের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রসচিব প্রসাদরঞ্জন রায় যেমন বলেছেন, ‘‘বর্তমান পরিস্থিতিতে আইন মেনে রাজীব সিংহকে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে সরাতে হলে ‘বরখাস্ত’ (ইমপিচ) করতে হবে।’’
‘ইমপিচমেন্ট’-এর কথা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ও বলেছেন। তবে পাশাপাশিই তিনি বলেছেন, ‘‘নিয়োগ প্রক্রিয়ার একটা অংশ হল কাজে যোগদান। রাজ্যপাল সেই যোগদান রিপোর্টটি সই না-করে ফেরত পাঠালে নিয়োগ প্রক্রিয়াটাই অসম্পূর্ণ কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে। এ নিয়ে আইনি জটিলতাও তৈরি হতে পারে।’’
কী সেই ‘ইমপিচমেন্ট’ পদ্ধতি? নবান্ন সূত্রের দাবি, আনুষ্ঠানিক শপথগ্রহণ করে সুপ্রিম কোর্ট বা কোনও রাজ্যের হাই কোর্টের বিচারপতিকে ‘পদ থেকে সরানোর’ জন্য যে সাংবিধানিক রীতি অনুসরণ করতে হয়, শপথ নিয়ে পদে বসা রাজীবের ক্ষেত্রেও সেটাই অনুসরণ করতে হবে। সেই সাংবিধানিক পদ্ধতিতে রাজ্যপাল, রাজ্য সরকার বা রাজ্য বিধানসভার কার্যত কোনও ভূমিকাই নেই। এ ক্ষেত্রে স্বয়ং রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে সংসদে রাজীবের বিরুদ্ধে ‘ইমপিচমেন্ট’ প্রস্তাব আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে ‘ইমপিচমেন্ট’ নোটিস দিতে হবে লোকসভার স্পিকার বা রাজ্যসভার চেয়ারম্যানকে। সেই প্রস্তাবে লোকসভার ক্ষেত্রে ১০০ জন এবং রাজ্যসভার ক্ষেত্রে ৫০ জন সাংসদের সই প্রয়োজন।
ইমপিচমেন্ট পদ্ধতির পরের ধাপে দুই কক্ষেই প্রস্তাব পাশের জন্য মোট সাংসদসংখ্যার অর্ধেকের বেশির সমর্থন বা অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটদান এবং তার মধ্যে অর্ধেকের বেশি সাংসদের সমর্থন প্রয়োজন। লোকসভা এবং রাজ্যসভায় ‘ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব’ পাশ হলে তা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে। রাষ্ট্রপতি অপসারণের নির্দেশ জারি করবেন। পুরো প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ। এর মধ্যে পদে থেকে কমিশনের কাজ পরিচালনা করতে রাজীবকে সাংবিধানিক ভাবে কোনও সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে না বলেই সরকারি সূত্রের খবর। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট সময়ে পঞ্চায়েত ভোট হতে কোনও বাধা নেই।
চলতি জুন মাসের ৭ তারিখে আনুষ্ঠানিক ভাবে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার পদে যোগ দিয়েছিলেন রাজীব। তার পর দিনই রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণা করেন তিনি। রাজীব তাঁর পদে যোগ দেওয়ার দু’সপ্তাহের মধ্যেই পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে কলকাতা হাই কোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টে। যার প্রতিটিতেই হারতে হয়েছে কমিশন এবং তাদের ‘সহযোগী’ রাজ্য সরকারকে। এমনকি, রাজ্যপাল তাঁর জয়েনিং রিপোর্ট ফিরিয়ে দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম তাঁর পর্যবেক্ষণে জানিয়েছিলেন, আদালতের কেন্দ্রীয় বাহিনী সংক্রান্ত নির্দেশ পালন করতে না চাইলে রাজ্যপালের কাছে গিয়ে ইস্তফা দিতে পারেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব!
রাজ্যপালের অনুমোদনের পরে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার হিসাবে রাজীব কাজ শুরু করে দিয়েছিলেনন। পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে কমিশন একাধিক বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে রাজীবের নামে। একই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট ও হাই কোর্টে নির্বাচন কমিশনকে ঘিরে যে সমস্ত মামলা হচ্ছে, তাতেও রয়েছে কমিশনার রাজীবের নাম। ফলে বিচার বিভাগীয় স্তরেও রাজ্য নির্বাচন কমিশনার হিসাবে রাজীবের নাম ‘মান্যতা’ পেয়ে গিয়েছে।
রাজ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ নিয়ে রাজ্যপাল-নবান্ন দ্বন্দ্বের ইঙ্গিত আগেই মিলেছিল। রাজীবের পূর্ববর্তী কমিশনার সৌরভ দাসের কার্যকাল শেষ হয় মে মাসের শেষে। নতুন কমিশনার হিসাবে রাজীবের নাম প্রস্তাব করে তার আগে ১৮ মে রাজ্যপালের অনুমোদনের জন্য ফাইল পাঠিয়েছিল নবান্ন। একক নামে ছাড়পত্র দিতে আপত্তি তুলে নবান্নের কাছে আরও একটি নাম চেয়ে পাঠায় রাজভবন। দ্বিতীয় নাম হিসাবে রাজ্যে কর্মরত অতিরিক্ত মুখ্যসচিব অজিতরঞ্জন বর্ধনের নাম পাঠায় সরকার। কিন্তু রাজভবন তার পরেও কমিশনার হিসাবে কারও নামে ছাড়পত্র দিচ্ছিল না। সূত্রের খবর, কমিশনার পদে তৃতীয় নামও চাওয়া হয়েছিল নবান্নের কাছে। দীর্ঘ টালবাহানার পরে শেষ পর্যন্ত ৭ জুন রাজীবের নামেই ছাড়পত্র দিয়েছিলেন রাজ্যপাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy