Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Junior Doctor’s Protest

কী কী বিষয়ে টানা আট ঘণ্টা আলোচনা জুনিয়র ডাক্তারদের জিবি-তে? কেন হল পূর্ণ কর্মবিরতির সিদ্ধান্ত?

বৈঠকে নানা মত উঠে আসে। একটি অংশ পূর্ণ কর্মবিরতিতে ফেরার বিপক্ষে ছিলেন। একটি অংশ জোরালো ভাবেই মনে করেন, দাবি আদায় করতে গেলে পূর্ণ কর্মবিরতিতেই ফিরতে হবে। এঁদের বড় অংশ মহিলা।

What topics are discussed in GB meeting of junior doctors

জুনিয়র ডাক্তারদের পূর্ণ কর্মবিরতি ঘোষণা। —ফাইল চিত্র।

সারমিন বেগম
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২৪ ১৭:০৬
Share: Save:

আবার পূর্ণ কর্মবিরতি। রাতভর জেনারেল বডি (জিবি) বৈঠকের পর মঙ্গলবার ভোরে জুনিয়র ডাক্তারেরা একযোগে ঘোষণা করলেন, ১০ দফা দাবি না-মেটা পর্যন্ত তাঁরা আবার সব কাজ থেকে সরে থাকবেন। তবে প্রায় আট ঘণ্টা ধরে চলা বৈঠকে পূর্ণ কর্মবিরতিতে ফেরার সিদ্ধান্ত সমর্থন করেননি অনেকেই। উল্টো দিকে একটা বড় অংশ বলেছেন, চূড়ান্ত আন্দোলনে ফিরে সরকারকে চাপে না-ফেললে এই লড়াই জেতা সম্ভব নয়। পূর্ণ কর্মবিরতিতে ফেরার চাপ তৈরি করতে বৈঠকে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন মহিলা জুনিয়র ডাক্তারেরা। নিজেদের আতঙ্ক, নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন এই চিকিৎসক পড়ুয়ারা। সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত চলা বৈঠকে উঠে এসেছে এমনই নানা ধরনের মতামত।

• আদালত নিয়ে চিন্তা

সোমবার বিকেলে সুপ্রিম কোর্টের শুনানিতে জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে জানানো হয়, প্রয়োজনীয় পরিষেবা দিচ্ছেন তাঁরা। সেই দাবির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যদি আবার তাঁরা পূর্ণ কর্মবিরতি শুরু করেন, তবে কি আদালত অবমাননা হবে? জিবি বৈঠকে ওঠে এই প্রশ্ন। জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশের মতে, পরবর্তী শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টে এই বিষয়টি উঠতে পারে। সে ক্ষেত্রে তাঁদের কী যুক্তি হবে তা-ও ভাবা উচিত। অতীতে আরজি কর মামলার শুনানিতে সুপ্রিম কোর্ট জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে ফেরার ‘ডেডলাইন বেঁধে দিয়েছিল’ বলে অনেকের মত। কিন্তু তার পরেও নিজেদের অবস্থানে অনড় ছিলেন তাঁরা। রাজ্য সরকারের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে আংশিক কর্মবিরতি তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সে কথাই সোমবার শুনানিতে জানানো হয়। তার পর ফের পূর্ণ কর্মবিরতিতে যাওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত হবে, এই প্রশ্ন রয়েছে আন্দোলনকারীদের একটি অংশের মনে।

• কর্মবিরতির বিকল্প পথ

পূর্ণ কর্মবিরতিতে না গিয়ে বিকল্প কোনও পথে কি আন্দোলন জিইয়ে রাখা যায় না? তাঁদের দাবি পূরণের একমাত্র পথ কি শুধুই কর্মবিরতি, না কি যে পথে আপাতত আন্দোলন চলছিল, সেই পথেও এগোনো যায়? জিবিতে জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশের মত ছিল, মুখ্যমন্ত্রী এবং মুখ্যসচিবের সঙ্গে আলোচনার পর পূর্ণ কর্মবিরতি তুলে তাঁরা যে ভাবে আন্দোলন চালাচ্ছেন, সেই পথেই চলা যেতে পারে। বৃদ্ধি করা যেতে পারে আন্দোলনের ঝাঁজ। মিছিল, অভিযান, গণ কনভেনশন, কলেজে কলেজে আলোচনা ইত্যাদি কর্মসূচির সংখ্যা বাড়িয়ে সরকারকে ‘চাপে’ ফেলার কৌশলের পক্ষে সওয়াল ছিল অনেকেরই।

• সাধারণ মানুষের অসুবিধা

আরজি কর আন্দোলনে প্রথম থেকেই সাধারণ মানুষকে পাশে পেয়েছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচিতে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যোগ দিয়েছেন সাধারণ নাগরিক। হেঁটেছেন মাইলের পর মাইল পথ। জুনিয়র ডাক্তারদের হয়ে আওয়াজ তুলেছেন। স্বাস্থ্য ভবনের সামনে জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্নামঞ্চে সাহায্য নিয়ে পৌঁছে গিয়েছেন সাধারণ মানুষই। পূর্ণ কর্মবিরতিতে গেলে সাধারণ মানুষকে কি অসুবিধার মুখে ঠেলে দেওয়া হবে না? পরিষেবা থেকে কি এ ভাবে সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করা ঠিক হবে? জিবি বৈঠকে একটা বড় অংশে আলোচনা হয় এই বিষয় নিয়েই। জুনিয়র ডাক্তারেরা ‘অভয়া ক্লিনিক’ চালু করেছিলেন সাধারণ মানুষের জন্য। কিন্তু একটা হাসপাতালে যে পরিষেবা দেওয়া সম্ভব, তা কি ওই ক্লিনিকে দেওয়া যায়, এই প্রশ্নও ওঠে জিবি বৈঠকে।

• ভয় করছে মেয়েদের

সরকারি হাসপাতালের ভিতরে এক মহিলা চিকিৎসক পড়ুয়াকে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা থেকেই বর্তমান আন্দোলনের সূত্রপাত। আন্দোলনের একটা বড় অংশও মেয়েরা। হাসপাতালে নিরাপত্তা নিয়ে সবচেয়ে উদ্বিগ্ন তাঁরাই। রাজ্য সরকারের প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর কাজে ফিরলেও জুনিয়র ডাক্তারেরা কী রকম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছেন, সে বিষয়টি উঠে আসে নানা জনের মতামতে। পূর্ণ কর্মবিরতির পক্ষে মেয়েদের গলার জোর বেশি ছিল। কাজে ফিরলেও সঙ্গে করে ‘পেপার নাইফ’, ‘পিপার স্প্রে’ নিয়ে ঘুরতেন বলে জিবি বৈঠকে জানান মহিলা ডাক্তারদের অনেকে। জানিয়েছেন, শৌচাগারে গেলেও ভয়ে থাকছেন, কর্মক্ষেত্রে একা থাকা যেন বিভীষিকা হয়ে উঠেছে তাঁদের কাছে। কলকাতার এক পিজিটি পড়ুয়া বলেন, ‘‘আমরা যখন আবার কাজে ফিরলাম তখন হাসপাতালে আতঙ্কে থাকতাম। এখনও থাকি। শৌচাগারে গেলেও দু’-তিন বার করে দরজার লক্ চেক করি। একা থাকলে ভয় হয়।’’

• ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা

পূর্ণ কর্মবিরতি কি ভবিষ্যতে ক্ষতির মুখে ঠেলে দেবে তাঁদের, জিবি বৈঠকে সেই প্রশ্ন তোলেন কেউ কেউ। রাজ্যের এক মেডিক্যাল কলেজের ইন্টার্নের কথায়, ‘‘আমাদের শেখার জন্য এটাই সেরা সময়। হাতেকলমে শেখার জন্য আমাদের কাজ চালিয়ে যাওয়া উচিত। সেই সঙ্গে আন্দোলন চলুক।’’ ভবিষ্যৎ কর্মজীবনে এমন কর্মবিরতি বড় প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকেই।

• বিশ্বাসঘাতকতা না কি বিশ্বাসভঙ্গ

স্বাস্থ্য ভবনের সামনে ডাক্তারদের অবস্থান মঞ্চে নিজে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে গিয়েই তিনি আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়ে আসেন। কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে বৈঠকের আয়োজনও হয়। তবে ‘সরাসরি সম্প্রচারণে’র দাবিতে জুনিয়র ডাক্তারেরা অনড় থাকায় প্রথম বৈঠক ভেস্তে যায়। পরে সরকারের সঙ্গে ইমেল, পাল্টা ইমেলে চলে ‘দর কষাকষি’। শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী এবং মুখ্যসচিবের সঙ্গে বৈঠকের পর জুনিয়র ডাক্তারেরা অবস্থান তুলে নেন, কাজেও ফেরেন। সরকার জানায়, জুনিয়র ডাক্তারদের অনেক দাবি মেনে নিয়েছে প্রশাসন। হাসপাতালগুলিতে নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারের রূপরেখাও জানানো হয় জুনিয়র ডাক্তারদের। তার পর ১০-১২ দিন কেটে গিয়েছে। জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি, সরকারের কথায় বিশ্বাস করে তাঁরা কাজে ফিরেছিলেন। তবে তাঁদের যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা অনেকাংশেই পূর্ণ করতে ব্যর্থ প্রশাসন। তাঁরা মনে করছেন, তাঁদের ‘বিশ্বাসভঙ্গ’ করেছে সরকার।

• ‘এখনই করো, নয় তো কখনই নয়’

জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশের মতে, তারা এখন ‘ডু অর ডাই’ পরিস্থিতির মুখোমুখি। এই অবস্থায় পিছু হটার কোনও উপায় নেই। পূর্ণ কর্মবিরতির মতো পদক্ষেপ সরকারকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাধ্য করতে পারে। আন্দোলনকারীদের মনোবল বজায় রাখার জন্য পিছনে তাকানোর কোনও জায়গা নেই বলেই মত জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশের। যদি নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার আগেই তাঁরা কর্মবিরতির সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন তবে ভবিষ্যতে তা চিন্তার কারণ হতে পারে। মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ফিরতে পারে ‘থ্রেট কালচার’। সুপ্রিম কোর্টে সোমবারের শুনানিতে যে ‘প্রভাবশালী’ তত্ত্ব উত্থাপিত হয়, সে কথাও বৈঠকে আলোচনায় উঠে আসে।

এমনই নানা মতামত উঠে এসেছে সোম-মঙ্গলের জিবি বৈঠকে। তবে পূর্ণ কর্মবিরতিতে ফেরার পক্ষে অন্যতম বড় যুক্তি হিসেবে কাজ করেছে সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজের ঘটনা। জুনিয়র ডাক্তার বা নার্সদের মারধর করা ওই ঘটনার পরই জুনিয়র ডাক্তারদের হুঁশিয়ারি ছিল, দরকারে তাঁরা আবারও পূর্ণ কর্মবিরতিতে যাবেন। তবে সোমবার সুপ্রিম কোর্টে আরজি কর মামলায় কী হয়, সে দিকে নজর ছিল তাঁদের। সুপ্রিম-শুনানি শেষেই জুনিয়র ডাক্তারেরা নিজেদের মধ্যে জেনারেল বডি (জিবি) বৈঠকে বসেন। ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস’ ফ্রন্ট’ বৈঠকে বসেছিল সোমবার রাত সাড়ে ৮টায়। বৈঠক চলে ভোর ৪টে পর্যন্ত। সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য যে ভাবে বার বার জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের দিকে আঙুল তুলছে, তা নিয়ে বৈঠকে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে একটি বড় অংশই। তবে দীর্ঘ আলোচনায় বার বার পূর্ণ কর্মবিরতির যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। বিকল্প পথে আন্দোলন চালানোর পক্ষে সওয়াল করেন অনেকেই। কিন্তু তার পরেও নিরাপত্তা-সহ দাবিগুলিই কর্মবিরতির পক্ষে মত নিতে সাহায্য করে জুনিয়র ডাক্তারদের। মহিলা চিকিৎসকদের একটি বড় অংশের দাবি বেশি প্রাধান্য পায়। তবে এ-ও প্রশ্ন ওঠে, এই কর্মবিরতির ভবিষ্যৎ কী? তাঁদের কর্মবিরতির শেষ কী ভাবে হবে? সেই সব প্রশ্নকে পাশে রেখেই মঙ্গলবার থেকে আবার পূর্ণ কর্মবিরতি শুরু করলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। ১০ দফা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কর্মবিরতি চলছে, আপাতত এমনটাই বলছেন আন্দোলনকারীরা। তাঁরা জানাচ্ছেন, নানা মতামত অবশ্যই ছিল, থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যে সিদ্ধান্ত হয়েছে তা ঐক্যবদ্ধ ভাবেই হয়েছে। ঐক্যবদ্ধ ভাবেই আন্দোলন চলবে।

অন্য বিষয়গুলি:

Junior Doctor Protest R G kar Incident
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy