Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
North Dinajpur

নিয়োগে ‘না’! তবু ওই দুই শিক্ষককে কেন ডাকল স্কুল? রহস্য বাড়ছে ইসলামপুরে

কিন্তু কী এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, যাতে ছাত্ররা এতটা মারমুখী হয়ে উঠল? পড়ুয়ারা কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল যে, বিশাল পুলিশ বাহিনী পাঠিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা গেল না?

বৃহস্পতিবারের গন্ডগোলের পর এখনও পড়ে রয়েছে পোড়া বাইক ও ছাই। —নিজস্ব চিত্র

বৃহস্পতিবারের গন্ডগোলের পর এখনও পড়ে রয়েছে পোড়া বাইক ও ছাই। —নিজস্ব চিত্র

সিজার মণ্ডল
শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৭:২১
Share: Save:

সংঘর্ষটা একেবারেই অসম। পুলিশ বনাম পড়ুয়া।

আর ইসলামপুরের দাড়িভিট হাইস্কুলের সেই খণ্ডযুদ্ধেই গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ গেল দু’জনের। মৃতদের দু’জনই ওই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র। এখনও এক ছাত্র পায়ে গুলি নিয়ে ইসলামপুর মহকুমা হাসপাতালে সঙ্কটজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন।

কিন্তু কী এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, যাতে ছাত্ররা এতটা মারমুখী হয়ে উঠল? পড়ুয়ারা কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল যে, বিশাল পুলিশ বাহিনী পাঠিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা গেল না? স্কুল পড়ুয়াদের উপর রবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস, গুলি চালাতে হল কোন পরিস্থিতিতে? যদিও বৃহস্পতিবারের ওই ঘটনায় পুলিশ এখনও গুলি চালানোর কথা স্বীকার করেনি। আবার এটাও সুনির্দিষ্ট করে বলতেও পারেনি, কে বা কারা গুলি চালিয়েছিল!

বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ার একটা অংশে গোটা ঘটনার সঙ্গে সাম্প্রদায়িক যোগ ছড়ানোর চেষ্টা চলছে। অন্যদিকে, ইওরোপ সফররত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরএসএস-ইন্ধনের অভিযোগ তুলেছেন। কিন্তু বাস্তবে ঠিক কী ঘটেছিল?

নিয়োগ স্থগিত রাখার কথা জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি। —নিজস্ব চিত্র

উত্তর দিনাজপুরের মহকুমা শহর ইসলামপুর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে দাড়িভিট।প্রত্যন্ত কোনও গ্রাম নয়। মাঝারি মাপের গঞ্জ বলা যায়। সেখানকার ওই কোএড উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা সব মিলিয়ে প্রায় দু’হাজার। কিন্তু শিক্ষকের সংখ্যা সেই তুলনায় অপ্রতুল বলেই ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবকদের অভিযোগ। ঘটনার প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর শুক্রবার যখন ওই স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা হচ্ছে, তখনও তারা জানাল যে, দীর্ঘদিন ধরেই এই স্কুলে শিক্ষকের সংখ্যা নিয়ে একটা সমস্যা রয়েছে। পর্যাপ্ত পরিমাণে শিক্ষক নেই। বহুদিন ধরে শিক্ষক চেয়েও পাওয়া যায়নি বলেও অভিযোগ। সমস্যার কথা স্বীকার করলেন ওই স্কুলের এক শিক্ষিকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই শিক্ষিকা বলেন,“আমাদের স্কুলে পূর্ণ সময়ের শিক্ষক রয়েছেন ১৩ জন। ৫ জন পার্শ্ব শিক্ষক। কম্পিউটার প্রশিক্ষণের জন্য রয়েছেন ৪ জন।” এত কম সংখ্যক শিক্ষক নিয়েই দীর্ঘদিন ধরে কার্যত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল হাজার দুয়েক ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনা!

আরও পড়ুন: ইসলামপুরে গুলিবিদ্ধ আরও এক ছাত্রের মৃত্যু, বন‌্ধ ঘিরে অশান্তি

স্কুল সূত্রে খবর, চলতি বছর উত্তর দিনাজপুর থেকে প্রায় ১০০ জন স্কুল সার্ভিস কমিশন থেকে নিয়োগপত্র পেয়েছিলেন। জেলা স্কুল পরিদর্শক রবীন্দ্রকুমার মণ্ডল তখন আশ্বাস দিয়েছিলেন, দাড়িভিট স্কুলে অন্তত দু’জন শিক্ষক দেওয়া হবে। পড়ুয়ারাও তাই আশাবাদী ছিল। এ দিন স্কুলের নবম শ্রেণির এক ছাত্র বলে,“সপ্তাহখানেক আগে দু’জন নতুন শিক্ষক স্কুলে আসেন। কাজে যোগ দেওয়ার আগে তাঁরা স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন। তখনই আমরা জানতে পারি, ওঁদের একজন উর্দু এবং অন্য জন সংস্কৃতের শিক্ষক।” অন্য এক ছাত্র বলে, ‘‘তখনই আমরা বিরোধিতা করি। কারণ, আমাদের বলা হয় ওঁরা দু’জনেই উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের জন্য। অথচ আমাদের উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে উর্দু বা সংস্কৃত নেই।’’ ওই ছাত্রদের এই দাবি যে ঠিক, সে কথা মেনে নেন এক শিক্ষকও। তিনি বলেন, “উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ইতিহাস, এডুকেশন, ভূগোল, দর্শন এবংরাষ্ট্র বিজ্ঞানের মতো বিষয় রয়েছে। তার মধ্যে আমাদের স্কুলে মাধ্যমিক স্তর থেকেই ইতিহাসের কোনও শিক্ষক নেই। দর্শনের শিক্ষক থাকলেও,নেইরাষ্ট্র বিজ্ঞান, বাংলা এবংইংরেজির পর্যাপ্ত শিক্ষক।” ছাত্রদের দাবি, তারা স্কুলের প্রধান শিক্ষক অভিজিৎ কুণ্ডু এবং সহকারি প্রধান শিক্ষক নুরুল হুদাকে বার বার অনুরোধ করেছিল, ইতিহাস বা অন্য কোনও বিষয়ের শিক্ষকের জন্য। কিন্তু বাস্তবে ঘটনা ঘটে অন্য রকম।

বৃহস্পতিবারের সংঘর্ষের পর শুক্রবার শুনশান স্কুল চত্বর। —নিজস্ব চিত্র

পড়ুয়াদের দাবি, গত ১৮ সেপ্টেম্বর উর্দু এবং সংস্কৃতের দুই শিক্ষক সকালবেলা হাজির হন স্কুলে। তাঁরা সোজা চলে গিয়েছিলেন প্রধান শিক্ষকের ঘরে। সেখানে সহকারি প্রধান শিক্ষক ছাড়াও ছিলেন স্কুলের করণিক আসিফ ইকবাল। কিছুক্ষণের মধ্যেই খবরটা ছড়িয়ে যায় ছাত্রদের মধ্যে।এক শিক্ষক বলেন,“সেদিন বেলা ১টা নাগাদ ক্লাস সেরে বাইরে বেরিয়েই দেখি নবম-দশম শ্রেণি এবং উচ্চমাধ্যমিকের প্রায় শ’দুয়েক ছাত্রছাত্রী প্রধান শিক্ষকের ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে। তারা প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করার দাবি জানায়।”

কিন্তু ছাত্রদের অভিযোগ, প্রধান শিক্ষক তাদের সঙ্গে দেখা করতে চাননি। আর তার পরেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে ছাত্রছাত্রীরা। তারা স্কুলের মেন গেটে তালা দিয়ে দেয়। স্কুলের মধ্যে ভাঙচুরও করে বলে অভিযোগ। স্কুলের ভিতর আটকে পড়েন সমস্ত শিক্ষক। ওই স্কুলের এক শিক্ষক বলেন, ‘‘প্রধান শিক্ষক স্কুলের সভাপতি নিশাকুমার গণেশের মোবাইলে মেসেজ করে গোটা পরিস্থিতিরকথা জানান। তিনি পুলিশ ডাকেননি।’’তাঁর আরও সংযোজন,“ওই দিন অন্য এক শিক্ষক আসরাফুল হক ফোন করে স্থানীয় থানা, বিডিও, জেলা স্কুল পরিদর্শক সবাইকে খবর দেন। তারপর সাড়ে তিনটে নাগাদ ওঁরা সবাই আসেন।”

আরও পড়ুন: ছোটখাটো কিছু নয়, একেবারে বিমান ‘চুরি’ করতে গিয়েছিলেন এই ছাত্র, তার পর...

দাড়িভিট স্কুলের অন্য শিক্ষকরা জানান, ওই দিন পুলিশ, বিডিও এবং জেলা স্কুল পরিদর্শক দফায় দফায়, প্রধান শিক্ষক, সহকারি প্রধান শিক্ষক এবং নির্বাচিত দুই শিক্ষক প্রতিনিধি সুদীপ্ত সিংহ এবংআসরাফুল হক ছাত্রদের সঙ্গে বৈঠক করেন। শেষ পর্যন্ত ছাত্রদের বক্তব্যের গুরুত্ব বুঝে জেলা স্কুল পরিদর্শক রবীন্দ্রকুমার মণ্ডল প্রধান শিক্ষকের লেটারহেডে লিখে দেন যে, ওই দুই শিক্ষককে অন্য স্কুলে নিয়োগের ব্যবস্থা করা হবে। তার বদলে ইতিহাস ও বাংলার শিক্ষক নিয়োগ করা হবেদাড়িভিট হাইস্কুলে।ওই লিখিত প্রতিশ্রুতির প্রতিলিপি ছাত্রদের দেওয়া হয়। একটি করে প্রতিলিপি নিয়ে যান বিডিও এবং জেলা স্কুল পরিদর্শক। সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা নাগাদ সমস্ত মিটেও যায়। শান্তও হয়ে যায়পরিস্থিতি। ছাত্রদের মধ্যে অসন্তোষ মিটে যায়। পরের দিন স্কুলের মাঠেই মহকুমা স্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতা হয়। সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। গত কাল বৃহস্পতিবার কোনও রকম আশঙ্কা ছাড়াই সকল পড়ুয়াইস্কুলে পৌঁছয়। কিন্তু পরিস্থিতি বদলে যায় কিছুক্ষণের মধ্যেই।

এক শিক্ষক বলেন, ‘‘বেলা ১২টা নাগাদ দেখি উর্দু এবং সংস্কৃতের ওই দুই শিক্ষক আবার স্কুলে হাজির। জানতে পারি, ওঁদের কাজে যোগ দিতে ডাকা হয়েছে। মূহূর্তের মধ্যে সেই খবর পৌঁছয় বাকি ছাত্রদের কাছে। আমরাও জানতে পারি, প্রধান শিক্ষকের ঘরে তাঁরা কাজে যোগ দেওয়ার জন্য গিয়েছেন। তখনই ছাত্রছাত্রীরা কিছু শিক্ষককে বলে,আমরাযেন স্কুল ছেড়ে চলে যাই। কারণ, ততক্ষণে তারা ফের তৈরি হয়ে গিয়েছে স্কুলে তালা দিতে।’’ স্কুলের এক ছাত্র স্বীকারও করে নেয়, তাদের পরিকল্পনা ছিল ওই দুই শিক্ষক এবং প্রধান শিক্ষক, সহকারি প্রধান শিক্ষক-সহ কয়েকজনকে আটকে রাখার। আর তারপরেই বিশাল পুলিশ বাহিনী পৌঁছয় ঘটনাস্থলে। শুরু হয়ে যায় খণ্ডযুদ্ধ।

আর এখানেই শিক্ষকদের প্রশ্ন, ছাত্রদের কথা দেওয়া সত্ত্বেও কী কারণে ওই দুই শিক্ষককে ফের ডেকে আনা হল? আর কারাই বা পুলিশকে ‘পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর’ বলে জানালযে, বিশাল পুলিশ বাহিনী পৌঁছে গেল? শিক্ষকদের অভিযোগ, ছাত্রদের ন্যায্য দাবিকে কেউ কেউ অন্য রং দিয়ে পরিস্থিতির ফায়দা তুলতে চাইছে।

অন্য বিষয়গুলি:

Crime Violence Islampur Student Death
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy