ডিসেম্বর ২০২৪: তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছিল, পরিষদীয় দলের বৈঠকে পরামর্শদাতা সংস্থা আইপ্যাক নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘অসন্তোষ’ প্রকাশ করেছেন। শাসকদলের একাধিক সূত্র দাবি করেছিল, বৈঠকে মমতা বলেছিলেন, ও সব ‘প্যাক-ফ্যাক’ তিনি বোঝেন না। এ সব করে তাঁর কাছে অনেক ভুল তথ্য পৌঁছেছে।
ফেব্রুয়ারি ২০২৫: সেই মমতাই গত বৃহস্পতিবার নেতাজি ইন্ডোরের সভায় পরামর্শদাতা সংস্থাকে ‘আমার আইপ্যাক’ বলে সম্বোধন করছেন। তার পর এ-ও বললেন, “এটা পিকের (প্রশান্ত কিশোর) আইপ্যাক নয়। ওরা (পিকে) একটা রাজনৈতিক দল গঠন করেছে। এরা একটা নতুন টিম। এদের সহযোগিতা করতে হবে। এদের নামে উল্টোপাল্টা বলা বন্ধ করুন। কাজটা সবাইকে মিলে করতে হবে।”
ব্যবধান মেরেকেটে দু’মাসের। মমতার মনবদলের নেপথ্য-কারণ কী? তৃণমূলের অন্দরে নানা যুক্তি-পাল্টা যুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। এক এক জন এক এক ভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করছেন। তবে প্রায় সকলেই মানছেন, ২০২১ এবং ২০২৪ সালের ভোটে আইপ্যাক যে ভাবে কাজ করেছিল, এখনই সেই পদ্ধতি থেকে দলের পক্ষে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। মমতার মতো পোড়খাওয়া রাজনীতিকও তা বুঝতে পেরেছেন। সে কারণেই দলের যে অংশ আইপ্যাক নিয়ে ক্ষুব্ধ বা বিরক্ত, তাঁদের সরাসরি ‘বার্তা’ দিয়েছেন তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী।
আরও পড়ুন:
তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আইপ্যাকের ছোঁয়ায় থাকা তৃণমূলের একটি অংশের বক্তব্য, দু’মাস আগে পরিষদীয় বৈঠকে মমতা অতটাই কড়া ভাবে আইপ্যাকের সমালোচনা করেছিলেন কি না, তা নিয়ে তাঁরা সন্দিহান। কোন প্রেক্ষাপটে মমতা ওই কথা বলেছিলেন, তা নির্দিষ্ট ভাবে জানা যায়নি। ফলে আইপ্যাককে পছন্দ করেন না, দলের এমন অংশ যে নিজেদের মনের মাধুরী মিশিয়ে ওই কথা ছড়িয়ে দেননি, তারও নিশ্চয়তা নেই।
পাল্টা যুক্তি হিসাবে অন্য অংশের অভিমত, মমতার ‘প্যাক-ফ্যাক’ বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। তার পরে মমতা একাধিক প্রকাশ্য সভা করেছেন। কিন্তু কখনও বলেননি তাঁর বক্তব্য ‘বিকৃত’ করা হচ্ছে। ফলে দু’মাস আগে তিনি যে আইপ্যাক নিয়ে ‘অসন্তুষ্ট’ ছিলেন, তা স্পষ্ট। আবার এ-ও ঠিক যে, সতত পরিবর্তনশীল রাজনীতিতে দু’মাস লম্বা সময়। ফলে এই মনবদল বা মতবদল আশ্চর্যের নয়।
তৃণমূলের প্রবীণদের একটি অংশের বক্তব্য, মমতা ইন্ডোরের বৈঠকে উল্লেখযোগ্য ভাবে বলেছেন, বিজেপির ৫০টা এজেন্সি থাকলে আমাদেরও একটা-দুটো রয়েছে। অর্থাৎ, পদ্মশিবিরের কৌশল বুঝেই মমতা আইপ্যাকের ভূমিকাকে গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন। ভোটার তালিকার ‘ভূত’ তাড়ানোর অভিযানে দলের পাশাপাশি পেশাদার সংস্থার ‘গ্রাউন্ড সার্ভে’ যে গুরুত্বপূর্ণ, তা-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন মমতা। তৃণমূলের এক নেতার কথায়, ‘‘এই কর্মসূচিতে যতটা বুথস্তরের সাংগঠনিক শক্তির ব্যবহার প্রয়োজন, ততটাই দরকার টেকনিক্যাল দিকটা বোঝা এবং সেই অনুযায়ী এগোনো। ‘ভূত’ চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে তা গুরুত্বপূর্ণ।’’
আইপ্যাকের সঙ্গে ‘সমন্বয়ে’ থাকা নেতাদের বক্তব্য, ওই পরামর্শদাতা সংস্থার কাজের ধারায় গত কয়েক মাসে কোনও বদল হয়নি। শেষ ছ’টি উপনির্বাচনেও আইপ্যাক নিজেদের মতো করেই কাজ করেছিল। ফলে বিজেপি এজেন্সি ব্যবহার করছে বলে আইপ্যাকের ‘গুরুত্ব’ বেড়ে গিয়েছে, বিষয়টা তেমন নয়।
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং বুঝতে পেরেছেন, ভোট লড়তে গেলে পেশাদার সংস্থার প্রয়োজন। সে আইপ্যাকই হোক বা অন্য কোনও সংস্থা। সে দিক থেকে দেখতে গেলে পশ্চিমবঙ্গে আইপ্যাক ‘পরীক্ষিত’। ভোটের বাকি আর এক বছর। তখন নতুন কোনও সংস্থাকে রাজ্যে এনে কাজ করাতে গেলে তাদের রাজ্য চিনতে চিনতেই সময় চলে যাবে। সেই সূত্রেই অনেকে দিল্লির ভোটে আপের উদাহরণ দিয়ে বলছেন, নির্বাচনের মাস তিনেক আগে আপ আইপ্যাককে নিয়োগ করেছিল। কিন্তু ভোটের ফলাফল তাদের অনুকূলে যায়নি। যা থেকে স্পষ্ট যে, সময় একটা বড় ‘ফ্যাক্টর’। মমতা বড় রাজনীতিক বলে সেটাও সম্যক অনুধাবন করেছেন। পাশাপাশিই বুঝতে পেরেছেন, আগামী বিধানসভা ভোটে তৃণমূল স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত আইপ্যাকের সঙ্গে সমন্বয় না-রাখলে ঈপ্সিত ফল পাওয়া যাবে না। সেই কারণেই তাঁর ‘মনবদল’।
শাসকদলের অনেক নেতারই অভিমত, মমতার ‘প্যাক-ফ্যাক’ মন্তব্যের রেশ ধরেই মদন মিত্র, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়েরা পেশাদার সংস্থার উদ্দেশে ‘তোলাবাজি’, ‘অসততা’র অভিযোগ তুলেছিলেন। মদন দলের বার্তা পেয়ে দ্রুত ক্ষমা চেয়ে নেন। কল্যাণের উদ্দেশে সরাসরি কোনও পদক্ষেপ না করলেও তৃণমূলনেত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন, আইপ্যাক সম্পর্কে কোনও ‘উল্টোপাল্টা’ কথা বলা যাবে না। এর মধ্যে আইপ্যাকের কর্ণধার প্রতীক জৈনের সঙ্গে মমতার বার দুয়েক বৈঠক হয়েছে বলেও খবর। তৃণমূলের অনেকের বক্তব্য, দলের সর্বোচ্চ স্তরে যে ‘দূরত্ব’ তৈরি হয়েছিল, তা যে কাটার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে তার উদাহরণ আইপ্যাকের ‘গুরুত্ব’ দলের সামনে উপস্থাপিত করা। এবং তা করেছেন মমতা নিজেই। ফলে ডিসেম্বর এবং ফেব্রুয়ারির মধ্যে ফারাক পরখ করা যাচ্ছে। আবার অনেকের বক্তব্য, আইপ্যাক সাংগঠনিক বিষয়ে যাতে মাথা না গলায়, সেটাই দলনেত্রী নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। ‘গ্রাউন্ড সার্ভে’র কথা বলে মমতা আসলে পেশাদার সংস্থার সামনে ‘লক্ষ্মণরেখা’ টেনে দিয়েছেন।
অনেকে পাল্টা যুক্তি দিচ্ছেন এই বলে যে, মমতার ‘প্যাক-মন্তব্য’ ছিল অভ্যন্তরীণ বৈঠকে। তার কোনও রেকর্ড নেই। কিন্তু নেতাজি ইন্ডোরে প্রকাশ্যে মমতা আইপ্যাকের সঙ্গে সমন্বয় রেখে দলকে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। যার ফলে পেশাদার ধাঁচে কাজ করতে অভ্যস্ত নেতারাও খানিকটা বল পেয়েছেন। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট, ২০২১ এবং ২০২৪ সালের মতো আইপ্যাকের সাহায্য নিয়েই ২০২৬-এর ভোটের দিকে যাবে তৃণমূল, যা তাদের চতুর্থ বার ক্ষমতায় ফেরার লড়াই।