রামকৃষ্ণ মিশনের এই বাড়িতেই হামলা হয়েছে বলে অভিযোগ। —নিজস্ব চিত্র।
রামকৃষ্ণ মিশনের উপর হামলার ঘটনায় শিলিগুড়িতে আবারও জমি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হুঁশিয়ারি এবং পুলিশি ধরপাকড়ের জেরে কয়েক বছর জমিজমার অবৈধ কারবার অপেক্ষাকৃত কম থাকলেও, কিছু দিন ধরে শিলিগুড়ি ঘিরে নতুন করে জমি মাফিয়াদের সক্রিয়তা বেড়েছে বলে অভিযোগ। স্থানীয়দের একাংশের দাবি, গত কয়েক বছরে শিলিগুড়ি ও লাগোয়া এলাকায় জমির দাম অতি দ্রুত বাড়ছে বলে বেআইনি ভাবে জমি হাতানোর প্রবণতাও বাড়ছে। তাঁদের অভিযোগ, সেই ‘পদ্ধতি’তেই রামকৃষ্ণ মিশনের জমি দখলের চেষ্টা হচ্ছে। পুলিশের একাংশের বিরুদ্ধে উদাসীনতার অভিযোগও তুলছেন কেউ কেউ। শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটের অবশ্য বক্তব্য, জমির অবৈধ কারবার রুখতে তারা সদা তৎপর।
পুলিশ জানিয়েছে, রামকৃষ্ণ মিশনের ঘটনায় ইতিমধ্যেই পাঁচ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধৃতদের মধ্যে শম্ভু দাস, দেবাশিস সরকার, শম্ভু মাহাতো এবং শ্যামল বৈদ্য ভক্তিনগর এলাকার বাসিন্দা। অন্য এক ধৃত মাটিগাড়া থানার অন্তর্গত শিবমন্দির এলাকার বাসিন্দা রাজীব বসাক। বুধবার সাংবাদিক বৈঠক করেন ডিসিপি (পূর্ব) দীপক সরকার। তিনি বলেন, ‘‘রামকৃষ্ণ মিশনের অভিযোগ ছিল, গত ১৯ মে রাতে প্রদীপ রায়-সহ আরও ১০-১২ জন তাদের আশ্রমে ঢোকে। মিশনের লোকজনকে মারধর করে। মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। সিসিটিভি ফুটেজ নষ্ট করে। এই অভিযোগ পেয়ে আমরা তদন্তে নামি। পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছে ভক্তিনগর থানা। মূল অভিযুক্ত প্রদীপ রায় এখনও পলাতক। আমরা খোঁজ চালাচ্ছি। ধৃতদের বিরুদ্ধে ৪৫৭, ৪২৭, ৩২৫, ৩৭৯, ৫০৬, ১২০বি ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে।’’
একটা সময়ে শিলিগুড়িতে গেলেই শহর ও সংলগ্ন এলাকায় জমির অবৈধ কারবার নিয়ে পুলিশ-প্রশাসনকে সতর্ক করতে দেখা যেত মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে। বিভিন্ন সময়ে জমি দখলের অভিযোগে শাসক তৃণমূলের নেতাদের নাম জড়ানোয় একাধিক বার প্রকাশ্য সভা থেকে হুঁশিয়ারি দিতে দেখা গিয়েছে রাজ্যের তৎকালীন মন্ত্রী তথা বর্তমানে শিলিগুড়ির মেয়র গৌতম দেবকে। এর পরেই শহর জুড়ে পুলিশি ধরপাকড় শুরু হয়। প্রশাসন কঠোর হওয়ায় তা নিয়ন্ত্রণেও আসে। পুলিশের এক কর্তার কথায়, ‘‘এনজেপি এলাকায় একটা সময়ে এক জমি মাফিয়ার রাজত্ব ছিল। তাঁর হঠাৎ মৃত্যুর পরে এলাকায় দু’টি দল তৈরি হয়। এলাকার দখল নিয়ে নিত্য সংঘর্ষ চলত। ধীরে ধীরে সেই সব এলাকা শান্ত হয়।’’ কিন্তু পুলিশ সূত্রে খবর, জমি দখল সংক্রান্ত অভিযোগ আসা কখনওই পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। শুধু এনজেপিই নয়, কমিশনারেটের নানা থানায় জমি দখল সংক্রান্ত অভিযোগ জমা পড়ে প্রতি মাসে গড়ে অন্তত ২০টি। ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দফতর সূত্রে খবর, রোজই মালিকানা নিয়ে বিতর্কের চিঠি আসে। জমি মাফিয়ারা প্রথমে ফাঁকা জমিতে কাউকে বসিয়ে দেন। সে জন্য মোটা টাকা আদায় করেন। ভুয়ো নথি বানিয়ে নেন। পরে তা দেখিয়ে পাল্টা অভিযোগ নিয়ে মামলা করেন। এরই মধ্যে চলে লেনদেন।
স্থানীয়দের দাবি, রামকৃষ্ণ মিশনের ঘটনাতে এই প্রবণতাই দেখা গিয়েছে। তাঁদের বক্তব্য, দুষ্কৃতী হামলা হয়েছে শিলিগুড়ির ‘সেবক হাউস’ নামে একটি বাড়িতে। সেবক রোডের চার মাইলে প্রায় দুই একর জমি-সহ ওই দোতলা বাড়িটি জলপাইগুড়ি রামকৃষ্ণ মিশনকে দান করেছিলেন জলপাইগুড়ি শহরের জনৈক সুনীলকুমার রায়। পরে সেই জমির মালিকানা নিয়ে জলপাইগুড়ি রামকৃষ্ণ মিশনের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। আদালতের রায়ে সেই সম্পত্তি এখন মিশনের হাতেই রয়েছে। সেখানে স্কুল তৈরির পরিকল্পনা করেছেন মিশন কর্তৃপক্ষ। মিশনের কয়েক জন সন্ন্যাসী ওই বাড়িতেই থাকতেন। হামলা হয় সেখানেই।
এই ঘটনার পর জমি দখল নিয়ে অনেকেই মুখ খুলতে শুরু করেছেন। স্থানীয় বাসিন্দা সুশীলা রায়ের অভিযোগ, সেবক রোডের উপর তাঁর জমিও দখল হয়ে গিয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি। সেবক রোডের প্রধান সড়কের উপর বিঘের পর বিঘে জমি শহরের নামী-দামি ব্যবসায়ীরা মাফিয়াদের মাধ্যমে দখল করে নিয়েছে। দখল হওয়া জমি সংক্রান্ত মামলা আজও জলপাইগুড়ির সার্কিট বেঞ্জে বিচারাধীন। সেখানে বহুতল তৈরি হয়েছে। হামলারও শিকার হয়েছি। প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েও লাভ হয়নি। রামকৃষ্ণ মিশন বড় সংস্থা। তাই তারা লড়াই করে তাদের জমি ফিরে পেয়েছে। কিন্তু আমরা কি আর সেটা পারব? আমাদের জমি তো দখল হয়ে গিয়েছে।’’
অনেকেরই অভিযোগ, জমির বেআইনি কারবারে পুলিশ-প্রশাসনেরও মদত রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা সন্তোষ সিংহ বলেন, ‘‘বংশপরম্পরায় আমরা এই এলাকার বাসিন্দা। এই এলাকা শহরের আওতায় এসেছে অনেক পরে। শহর বাড়ছে, জমির দাম বাড়ছে। নির্মাণ সংস্থাগুলো জমি দখল করতে বড় বড় মাফিয়াদের কাজে লাগাচ্ছে। এই চক্রান্তে পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের হাত রয়েছে। এটা এখন কারওরই অজানা নয়।’’
রামকৃষ্ণ মিশনের ঘটনাতেও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পুলিশ সূত্রে খবর, ঘটনার পর মূল অভিযুক্ত প্রদীপ রায় রামকৃষ্ণ মিশনের বিরুদ্ধে ভক্তিনগর থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন। তাঁর অভিযোগপত্রে মহারাজ অক্ষদানন্দ-সহ একাধিক ব্যক্তির নাম রয়েছে। কিন্তু মিশন সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই মহারাজ ১৫ বছর আগেই মিশন ছেড়েছেন। বর্তমানে তিনি প্রয়াগরাজে রয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে কোন যুক্তিতে অভিযোগ জমা নিল পুলিশ, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে ডিসি বলেন, ‘‘গোটাটাই তদন্তের বিষয়। এখনই সবটা বলা সম্ভব নয়।’’ ওই পুলিশকর্তার সংযোজন, ‘‘প্রদীপ রায়ের বক্তব্য, জমির মালিক টুকরা সিংহ নামের এক ব্যক্তি। টুকরা নিঃসন্তান ছিলেন। টুকরার বাড়িতে বিদ্যেশ্বরী রায় নামে এক মহিলা থাকতেন। তারই ছেলে প্রদীপ। যে হেতু টুকরার কোনও সন্তান ছিল না, তাই হিন্দু মতে সেই জমির মালিকানা দাবি করছেন প্রদীপ। তবে আমরা তদন্ত করে জেনেছি, টুকরা এই জমি বহু বছর আগেই হরদয়াল সিংহ গিল নামে এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেছেন। তিনি আবার সেই জমি সুনীলকুমার রায় নামে এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেন। পরে সুনীল সেই জমি রামকৃষ্ণ মিশনকে দান করেন। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী এই জমির বর্তমান মালিকানা রামকৃষ্ণ মিশনের কাছে রয়েছে। প্রদীপের দাবি কোনও ভাবেই ঠিক নয়। মিউটেশন না হওয়ার জন্য এই জমি এখনও টুকরার নামে রয়েছে। তবে রামকৃষ্ণ মিশন মিউটেশনের কাজ করছে।’’ রামকৃষ্ণ মিশনের দায়ের করা অভিযোগে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ভয় দেখানোর অভিযোগ তোলা হয়েছে। তার ভিত্তিতে ধৃতদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে কেন মামলা হল না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ডিসি বলেন, ‘‘আর্মস অ্যাক্ট নেই। রামকৃষ্ণ মিশনের অভিযোগে আগ্নেয়াস্ত্রের উল্লেখ আছে। আমরা স্ক্রুটিনি করছি।’’
ধৃত রাজীব অবশ্য দাবি করেছেন, তিনি রামকৃষ্ণ মিশনের হামলার ঘটনার সঙ্গে কোনও ভাবেই জড়িত নন। বুধবার তাঁকে আদালতে নিয়ে যাওয়ার সময় রাজীব বলেন, ‘‘আমি এই ঘটনার সঙ্গে কোনও ভাবেই জড়িত নই। যারা দোষ করল, তাদের কেন ধরা হচ্ছে না? যে রাতের কথা বলছে, সে দিন আমি শিবমন্দিরের বাড়িতে ছিলাম। তার সিসিটিভি ফুটেজ রয়েছে। আমার আইনজীবী সেটা আদালতে প্রমাণ করে দেবে। আমাদের কেন ফাঁসিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেটা বুঝতে পারছি না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy