সোজা আঙুলে ঘি ওঠানো হবে না, তাই সচেতন ভাবেই আঙুল বাঁকিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা। রাজ্য সরকারের নতুন নগরোন্নয়ন নীতি সম্পর্কে এমনই ব্যাখ্যা শোনা যাচ্ছে প্রশাসন এবং নগর-স্থপতিদের একাংশের কাছ থেকে।
মঙ্গলবার নগরায়ণ সংক্রান্ত নতুন নীতি ঘোষণা করে পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন বহুতল তৈরির ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ এফএআর (ফ্লোর এরিয়া রেশিও) ছাড় দেওয়ার কথা বলেছে সরকার। জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন প্রত্যাহার না করার সিদ্ধান্তে অনড় থাকার খেসারত দিতেই ঘুরপথে আবাসন নির্মাণে এই ছাড় দিতে হচ্ছে বলে মানছেন পুরকর্তাদের অনেকেই।
প্রশাসনের একাংশ স্বীকার করছেন কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন পুর এলাকায় জমির ঊর্ধ্বসীমা বজায় রাখাই যে পরিকল্পিত নগরায়ণের মূল সমস্যা, সেটা সরকার ভালই বোঝে। এ থেকে বেরোনোর সোজা পথটি ছিল ১৯৭৬ সালের শহরে জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন প্রত্যাহার করা। কিন্তু বাম সরকারের মতো বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কোনও ভাবেই সেই আইন প্রত্যাহার করতে নারাজ। ক্ষেত্র বিশেষে সরকারি ক্ষমতা প্রয়োগ করে বাড়তি জমিতে নির্মাণ কাজের অনুমোদন দেওয়ার প্রথাই বহাল রেখেছে তাঁর সরকার। যার ফলে ধাক্কা খাচ্ছে নগরায়ণের স্বাভাবিক গতি। বাড়ছে আবাসন সমস্যা। এই অবস্থায় তাই সোজা পথের বদলে অমিত মিত্রের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিগোষ্ঠী শহরাঞ্চলে নগরোন্নয়ন নীতিতে পুরনো ও নতুন নির্মাণে অতিরিক্ত ফ্লোর-এরিয়া দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। যার ফলে শহরে আড়াআড়ির বদলে খাড়াখাড়ি নির্মাণেরই ব্যাপক রমরমা হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
জমির ঊর্ধ্বসীমা আইনে কলকাতা ও আশপাশের এলাকায় কোনও ব্যক্তি সাড়ে সাত কাঠার বেশি জমি রাখতে পারেন না। কারও মালিকানায় অতিরিক্ত জমি থাকলে ভূমি দফতর খাস ঘোষণা করে তা দখলে নিতে পারে। বাড়তি জমি নিয়ে কোনও প্রকল্প গড়তে হলে সরকারের বিশেষ অনুমতি নিতে হয়। তাতে এক দিকে যেমন দীর্ঘসূত্রিতার সমস্যা হয়, অন্য দিকে দুর্নীতিরও খবর মেলে। সরকারি কর্তারা জানাচ্ছেন, ১৯৭৬ সালে এই আইন তৈরি হয়। শহরের জমি জোতদার-জমিদারদের মতো অর্থবানদের হাতে যেন চলে না যায়, সেটাই ছিল তখনকার প্রেক্ষিত।
কিন্তু সেই পরিস্থিতি এখন অনেকটাই বদলেছে। সে সময় সব ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণই ছিল মূল কথা। কিন্তু আধুনিক প্রশাসনের মূল ভিত্তি ‘মিনিমাম গর্ভমেন্ট, ম্যাক্সিমাম গভর্ন্যান্স’। সেই সূত্রেই উন্নয়ন প্রকল্পে এখন সরকারি-বেসরকারি ভেদাভেদ কমে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মতো ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। সে কথা মাথায় রেখেই বিশ্ব ব্যাঙ্কের পরামর্শে বছর দশেক আগে প্রথম ইউপিএ সরকার পরিকল্পিত নগরায়ণ ও শহরে জমির যথাযথ ব্যবহার (ল্যান্ড ইউজ প্যাটার্ন) শুরু করার জন্য আরবান রিনিউয়াল মিশন নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। এই প্রকল্পে বিভিন্ন রাজ্যকে নগরায়ণ ও পুর পরিষেবার ক্ষেত্রে ২৩ দফা সংস্কার কর্মসূচি পালন করতে বলা হয়। প্রকল্পের শর্তই ছিল, যে রাজ্য দ্রুত সংস্কার কর্মসূচি রূপায়ণ করবে, তারা তত বেশি পরিকাঠামো উন্নয়নে (রাস্তা, ফ্লাইওভার, পানীয় জলের প্রকল্প, নিকাশি ব্যবস্থা) আর্থিক সাহায্য পাবে। সংস্কার কর্মসূচিগুলির অন্যতম ছিল সার্ভিস চার্জ নিয়ে পরিষেবা চালু করা, জলকর নেওয়া, ইউনিট এরিয়া সম্পত্তি কর চালু করা, স্ট্যাম্প ডিউটির বহর কমানো এবং সর্বোপরি শহরাঞ্চলে জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন প্রত্যাহার করে নেওয়া।
রাজ্য নগরোন্নয়ন দফতর সূত্রের খবর, এই ২৩ দফার কর্মসূচির মধ্যে রাজ্য এখনও ৭টি মানতে রাজি নয়। তার অন্যতম হল, শহরে জমি-বাড়ির ক্রয়-বিক্রয়ে স্ট্যাম্প ডিউটি ৫%-এ নামিয়ে আনা এবং জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন প্রত্যাহার। এক সরকারি কর্তার কথায়, পরিকল্পিত নগরায়ণের ক্ষেত্রে এই দু’টি বিষয় প্রধান অন্তরায় বলে কেন্দ্রীয় সরকার মনে করে। রাজ্যকে তারা সেটা বারবার জানিয়েওছে। “উন্নত দেশগুলি তো বটেই, এ দেশেও অন্য সমস্ত রাজ্য জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন প্রত্যাহার করে নিয়েছে। কিন্তু এ রাজ্য এখনও এই পথে যেতে রাজি নয়। এগিয়ে চলার উল্টো পথেই থাকতে চায় সরকার,” মন্তব্য এক পুর কর্তার। নীতি রূপায়ণের সঙ্গে জড়িত এক কর্তার কথায়, দেশে যেখানে গত কয়েক বছরে ২৭% হারে নগরায়ণ হয়েছে। সেখানে এ রাজ্যে নগরায়ণে বৃদ্ধির হার ৩১%। অর্থাৎ এ রাজ্যে গ্রাম থেকে শহরে এসে থিতু হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। তাই মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্তদের শহরাঞ্চলে মাথা গোঁজার ঠাঁই জোগাড় করা এখন বেশ সমস্যার। কলকাতা পুর কর্তৃপক্ষেরই দেওয়া হিসেব অনুযায়ী, মহানগরে ৬ লক্ষ করদাতার মধ্যে দুই-তৃৃতীয়াংশই ভাড়াটিয়া। যাদের সিংহভাগ বহু বছর ধরেই জরাজীর্ণ বাড়িতে বসবাস করছেন। যদি জমির ঊর্ধ্বসীমা আইনে ছাড় দিয়ে প্রকৃত নগরায়ণ করা হতো, তা হলে বহু ভাড়াটিয়ার মাথা গোঁজার নিজস্ব ঠাঁই হতো। আবাসন সঙ্কট দূর হয়ে শহরের চেহারা বদলাতে পারত বলে মনে করছেন ওই পুর কর্তারা।
কিন্তু এ রাজ্যে কয়েক দশক ধরেই অনিয়ন্ত্রিত ও পরিকল্পনাহীন নগরায়ণ হয়ে চলেছে। তবু সাহস করে জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন প্রত্যাহার করতে না পারায় এখন ঘুরপথে নতুন নীতি নিচ্ছে সরকার। যার পরিণতিতে শহর দৃষ্টিনন্দন হওয়ার বদলে আরও ঘিঞ্জি হবে, চাপ পড়বে পরিবেশের উপর।
প্রশাসনের অন্দরমহলে শোনা যায়, পরিকল্পিত নগরায়ণের ক্ষেত্রেও এখন আর সরকারি উদ্যোগে বৃহৎ প্রকল্প আসা সম্ভব নয়। বেসরকারি বিনিয়োগের হাত ধরেই তা আসতে বাধ্য। এমন ব্যবস্থায় জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন বহাল রাখা কার্যত মধ্যযুগীয় প্রথার মতো। কিন্তু সরকার যে হেতু আইন বদলের পথে হাঁটতে রাজি নয়, তাই পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন নির্মাণে উৎসাহ দিতে এবং বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের (পড়ুন প্রোমোটার) আকর্ষণ করতে নির্মাণে ছাড় দেওয়া ছাড়া আপাতত উপায় নেই।
পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এর মধ্যেও সংবাদমাধ্যমের ষড়যন্ত্র দেখছেন। তাঁর দাবি, নতুন নগরোন্নয়ন নীতির ফলে রাজ্যে গুন্ডারাজ, সিন্ডিকেট রাজ বন্ধ হয়ে যাবে। পরিকল্পিত নগরায়ণ হবে বলে ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়ার প্রকোপও কমবে। তবে তিনি এও জানিয়েছেন, যেখানে পুর-পরিষেবা যথেষ্ট নেই সেখানে নতুন ঘোষিত নীতির রূপায়ণের সুযোগ থাকবে না।
মন্ত্রীর কথায়, কলকাতা শহরে যত মানুষ থাকেন তার দুই-তৃতীয়াংশ ভাড়াটিয়া। ফলে সরকার ভাড়াটিয়াদের স্বার্থরক্ষার জন্যই ৫০ বছরের পুরনো বাড়ি নতুন করে নির্মাণে বাড়তি ১০০ শতাংশ ফ্লোর এরিয়া দেওয়ার কথা বলেছে। তবে জমির ঊর্ধ্বসীমা বহাল রাখার প্রশ্নে যথারীতি কোনও কথা বলতে চাননি মন্ত্রী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy