দেবকে প্রশিক্ষণ দিলেও সানির আসল কাজ অটো চালানো। নিজস্ব চিত্র
স্বপ্ন ছিল, চেয়ারে বসে চাকরি করবেন। পূরণ হয়নি। বেছে নিতে হয়েছে অটোচালকের আসন। স্বপ্ন ছিল, দেশের হয়ে কুস্তি লড়বেন আন্তর্জাতিক আসরে। পূরণ হয়নি। হবেও না। জাতীয় স্তরে গিয়েই থামাতে হয়েছে লড়াই। স্বপ্ন ছিল,এরিনার চারপাশে থাকা সমর্থকদের উল্লাসের মধ্যে কুস্তি লড়বেন। কিন্তু কলকাতার রাস্তায় গাড়ির হর্ন, ধোঁয়া-ধুলো, যাত্রীর সঙ্গে খুচরো নিয়ে খিটিমিটিই হয়ে গিয়েছে রোজকারের এবং রোজগারের জীবন। তবে বিখ্যাত হওয়ার স্বপ্নটা একটু হলেও সফল হল ৩০ বছরের সানির। টালিগঞ্জ-যাদবপুর রুটের অটোচালক সানি মুক্তির অপেক্ষায় থাকা ‘গোলন্দাজ’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য নায়ক দেবকে কুস্তির প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। ওই ছবিতে কিছুটা অংশে অভিনয়েরও সুযোগ পেয়েছেন।
সানির ভাল নাম শুভদীপ ভৌমিক। সানির কথায়, ‘‘সেটা ওই আধার কার্ড কিংবা ব্যাঙ্কের পাশ বইতে আছে। টালিগঞ্জ অটোস্ট্যান্ডে সবাই আমায় ‘সানি’ নামেই চেনে। সকাল আটটায় চলে আসি। সারাদিন চালাই। রাতে যতক্ষণ শরীর চলে, আমার অটোও চলে।’’ হারিয়ে যেতে বসা ভাল নামটা শেষবার কুস্তির সার্টিফিকেটে লেখা হয়েছিল ২০১৮ সালে। করোনাকালের আগে সেটাই ছিল শেষ রাজ্য স্তরের প্রতিযোগিতা। সে বার প্রথম হয়েছিলেন সানি। রাজ্য সেরা সানি একবার জাতীয় স্তরে লড়েছেন বাংলার হয়ে। তবে মেডেল আসেনি। পঞ্চম হয়েছিলেন। এখন সানির আশা ‘গোলন্দাজ’ মুক্তি পেলে নায়ক-নায়িকা, কলাকুশলীদের সঙ্গে তাঁর ভাল নামটাও ভেসে উঠবে বড় পর্দায়।
সানি বললেন, ‘‘কুস্তি আমি ভুলতে পারিনি। আসলে এই খেলা এমনই যে শরীর আর মন তার সঙ্গে মিশে যায়। ছেড়ে থাকা যায় না। এখন কয়েকটা জায়গায় কোচিং করাই। সেই সব দিন অটো অন্য কাউকে চালাতে দিয়ে চলে যাই। আর সেই প্রশিক্ষণ দিতে গিয়েই ‘গোলন্দাজ’ ছবির প্রযোজকদের সঙ্গে যোগাযোগ আর দেব-সহ অন্যদের প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়ে গেলাম।’’ পুজোর আগেই মুক্তি পেতে চলা ‘গোলন্দাজ’ ছবি ১৮৭৯-এর কলকাতার গল্প। ব্রিটিশ রাজত্বে প্রথমবার হাতে ছুঁয়ে ফুটবল দেখেছিলেন ‘নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বধিকারী’। পরিচালক ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবিতে ভারতীয় ফুটবলের আদিপুরুষ নগেন্দ্রপ্রসাদের চরিত্রে অভিনয় করছেন দেব। স্বদেশ প্রেম আর ফুটবলের সেই ছবিতে অভিনয়ের জন্য দেবকে কুস্তি শিখতে হল কেন?
উত্তরটা জানা গেল ছবির কাহিনিকার দুলাল দে-র কথায়। সাংবাদিক দুলাল বলেন, ‘‘এই ছবির মূল চরিত্র নগেন্দ্রপ্রসাদ ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের ভক্ত। তাঁর থেকে মাত্র ছ’বছরের বড় নরেন্দ্রনাথের মতো নগেন্দ্রপ্রসাদও কুস্তির চর্চা করতেন। তাঁর জীবননির্ভর কাহিনিতে তাই কুস্তি খুবই জরুরি অঙ্গ। আর নগেন্দ্রপ্রসাদ ছিলেন কুস্তির ‘ধোবি পছাড়ে’ ওস্তাদ। মানে ধোপা কাপড় কাচার সময়ে যে ভাবে দু’হাতে আছাড় মারেন সে ভাবে প্রতিপক্ষকে মাটিতে ফেলতে হয়। সে সব শিখতে হয়েছে দেব-সহ অন্যদের।’’
কেমন লাগল দেবের মতো একজন তারকাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে? বছর ৩০-এর সানির কথায়, ‘‘অনেকটা সময় ধরেই প্রশিক্ষণ চলেছে। তবে তাতেও তো আর কুস্তি শেখা যায় না। তবে দেব খুব কম সময়েই ছবিতে প্রয়োজনীয় কায়দাকানুন আয়ত্ত করে নিয়েছেন। ওঁকে ছাড়াও আরও অনেককে প্রশিক্ষণ দিতে হয়েছে। ভিলেন থেকে নায়কের সঙ্গীসাথিদেরও শেখাতে হয়েছে। তবে আমি এটা বলতে পারি, বাকিদের তুলনায় দেব অনেক দ্রুত শিখে নিয়েছেন।’’
সানি কুস্তি ছেড়ে অটোচালকের আসনে না বসলে যে তাঁদের সংসার একেবারে চলত না, তা অবশ্য নয়। বেসরকারি চাকরি করা বাবা অবসর নিয়েছেন। তবে পেনশন নেই। দাদা ব্যাঙ্কে চাকরি করেন। বাবা এবং মায়ের দেখাশোনা দাদাই করেন। কিন্তু দাদার আয়ে ঘরে বসে খাওয়া একটা সময় তাঁর আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগে বলে জানান সানি। তাঁর কথায়, ‘‘দাদার নিজের পরিবার রয়েছে। তবে দাদা কোনও দিন কিছু বলেননি। কিন্তু আমার এক সময় মনে হল, এ বার আমাকেও কিছু একটা করে রোজগার করতে হবে। কোনও কাজই ছোট নয়। বন্ধুদের পরামর্শে বাড়ির সবার সঙ্গে কথা বলেই অটো চালাতে শুরু করি। কষ্ট আছে। কিন্তু বেশ আছি। সারাদিন টালিগঞ্জ টু যাদবপুর আর যাদবপুর টু টালিগঞ্জ। সঙ্গে কুস্তি তো আছেই।’’
মুখে ‘বেশ আছি’ বললেও কুস্তিতে সাফল্য দেখিয়েও সরকারি চাকরির সুযোগ না মেলা নিয়ে কিছুটা হলেও ক্ষোভ রয়েছে সানির। টালিগঞ্জের কাছেই নেতাজিনগর কলেজ থেকে ২০১৫ সালে বিকম পাশ করার পরে চাকরির চেষ্টাও ছিল। কিন্তু অল্প দিনেই বুঝতে পারেন সেটা সম্ভব নয়। যদিও কুস্তিতে এসেছিলেন চাকরি পাওয়ার লক্ষ্য নিয়েই। সানি বলেন, ‘‘আমার দাদা দেহ সৌষ্ঠবের অভ্যাস করতেন ছোট থেকে। কিন্তু তাতে চাকরির সুযোগ কম বলে আমায় কুস্তিতে যেতে বলেন। কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম,কুস্তি খেলে চাকরির সুযোগ একেবারে কম। কুস্তিতে এখন সুযোগই নেই বলা যায়। রেলেও এখন আর সে ভাবে নিয়োগ হয় না। ও দিকে ছোট থেকে খেলাধুলোয় বেশি মন থাকায় রেজাল্টও খুব ভাল নয়। তাই চাকরির আশা কম বুঝেই অটোচালকের কাজ বেছে নিই।’’ একই সঙ্গে সানি বলেন, ‘‘আমি কিন্তু শুধুই পয়সা রোজগারের জন্য চাকরির স্বপ্ন দেখিনি। আসলে কুস্তি চালিয়ে যেতে অনেক খরচ। ঘি, মাখন, ডিম থেকে ফল, ফুড সাপ্লিমেন্ট লাগে নিয়মিত। কোচিং নেওয়ারও খরচ অনেক। সেই সব টানার জন্যই চাকরিটা আমি সাপোর্ট হিসেবে চেয়েছিলাম। হয়নি। এখন অটো চালিয়ে যে রোজগার হয় তাতে কুস্তি নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখা আর সম্ভব নয়।’’
নিজের অটো নেই। কিছুটা দাদার থেকে নেওয়া আর বাকিটা জমানো পয়সায় একটা অটো লিজ নেন। কেমন আয় হয়?সানি বললেন, ‘‘দৈনিক আয়ের একটা অংশ অটোর মালিককে দিতে হয়। করোনাকালের আগে সে সব দিয়েও হাতে কোনও কোনও দিন সাতশো টাকাও থাকত। কিন্তু এখন যাত্রী কম। তাই গড়ে এক একদিন আয় খুব বেশি হলে দুশো টাকা। তবে এটাই রক্ষা যে, অটো মালিকও এখন দৈনিক ভাড়া কম নেন।’’
ধোবি পছাড়। ধোপার মতো করে প্রতিপক্ষকে আছাড় মারা। মন দিয়ে শিখেছিলেন সানি। সেটাই তাঁর বিখ্যাত হওয়ার স্বপ্ন খানিক সত্যি করে দিল। দেবকে ‘নগেন্দ্রপ্রসাদ’-এর মতো না হলেও ধোবি পছাড় শিখিয়েছেন। নায়কের সঙ্গে ক্যামেরার সামনে কুস্তিও লড়েছেন। কিন্তু বারবার স্বপ্ন দেখে ধাক্কা খাওয়া সানি এখন খুবই সতর্ক। যানজটের অলিগলি দিয়ে অটো বার করা সতর্ক সানি বললেন, ‘‘সিনেমাটা মুক্তি পাক। তারপর বুঝতে পারব, আমার লড়াইয়ের অংশটা আদৌ আছে কি নেই! এখনই তাই কাউকে কিছু বলছি না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy