Advertisement
০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
West Bengal Panchayat Election 2023

পঞ্চায়েত মামলা কি সুপ্রিম কোর্টে সোমবার উঠবে? না-উঠলে কি আইনি চাপে পড়বে রাজ্য ও কমিশন?

কমিশন সূত্রের খবর, সোমবার শীর্ষ আদালতের অবকাশকালীন বেঞ্চে মামলাটির দ্রুত শুনানির আর্জি জানানো হতে পারে। যদিও ওই দিন মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে উঠবে কি না, তা নিয়ে ধন্দ রয়েই গিয়েছে।

An image of Supreme Court and Rajiv Sinha

(বাঁ দিকে) সুপ্রিম কোর্ট। (ডান দিকে) রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিংহ। —ফাইল চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০২৩ ০০:৫৪
Share: Save:

পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন নিয়ে কলকাতা হাই কোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে শনিবার সুপ্রিম কোর্টে মামলা (স্পেশাল লিভ পিটিশন) দায়ের করেছে রাজ্য এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশন। কমিশন সূত্রের খবর, সোমবার শীর্ষ আদালতের অবকাশকালীন বেঞ্চে মামলাটির দ্রুত শুনানির আর্জি জানানো হতে পারে। যদিও ওই দিন মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে উঠবে কি না, তা নিয়ে ধন্দ রয়েই গিয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার মোটামুটি রাত ৮টা নাগাদ হাই কোর্ট কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছে, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কাছে বাহিনী চেয়ে আবেদন করতে হবে। এই নির্দেশের পর ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে শনিবারই। এখনও কমিশনের তরফে বাহিনীর ‘রিক্যুইজিশন’ কেন্দ্রের কাছে পৌঁছয়নি। তার প্রেক্ষিতে বিরোধীদের একটি অংশ আবার দাবি করছে, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কেন্দ্রের কাছে বাহিনী-আর্জি না জানিয়ে আদালত অবমাননা করেছে কমিশন। সোমবার সেই বিষয়টিতেও যে হাই কোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হতে পারে, সেই সম্ভাবনা রয়েছে। সোমবার মামলাটি যদি সুপ্রিম কোর্টে গৃহীত না হয়, সে ক্ষেত্রে কমিশন ‘আইনি চাপে’ পড়তে পারে বলে মনে করছে আইনজীবী মহলের একাংশ। তাঁদের মতে, আদালতে মামলাটি ওঠে কি না, এখন তার উপরেই নির্ভর করছে কমিশনের ‘ভাগ্য’।

পঞ্চায়েতের মনোনয়ন পর্বে হিংসা দেখেছে রাজ্য। কয়েক জনের মৃত্যুও হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানমের ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশ ছিল, কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়েই পঞ্চায়েত ভোট করাতে হবে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বাহিনী চেয়ে কেন্দ্রের কাছে ‘রিক্যুইজিশন’ পাঠানোর কথা রাজ্য নির্বাচন কমিশনের। নবান্ন সূত্রে খবর, এতেই আপত্তি ছিল রাজ্য সরকারের। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, নবান্নের বক্তব্য, কোথায় কত পুলিশ লাগবে, নির্বিঘ্নে ভোট করাতে নিরাপত্তা সংক্রান্ত কী কী পদক্ষেপ করা দরকার, তা রাজ্যের কাছে জানতে চাইবে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। রাজ্য সেই তথ্য দেবে কমিশনকে। রাজ্যের দেওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে নির্বাচনী নিরাপত্তার কাজ করবে কমিশন। অর্থাৎ, নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমস্ত খুঁটিনাটি রাজ্য সরকারই কমিশনকে অবহিত করবে। এ ক্ষেত্রে হাই কোর্ট সরাসরি রাজ্য নির্বাচন কমিশনকেই বাহিনী চাইতে বলেছে কেন্দ্রের কাছে। আদালতের এই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে শীর্ষ আদালতে গিয়েছে রাজ্য সরকার।

অন্য দিকে, পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন পর্ব শেষ হয়ে গিয়েছে গত শুক্রবার। কিন্তু থামল না রক্তপাত! আগামী ২০ জুন অর্থাৎ মঙ্গলবার পর্যন্ত মনোনয়ন প্রত্যাহার পর্ব চলবে। এই সময়েও হিংসার ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক চাপান-উতোর অব্যাহত বাংলায়। কোচবিহারে বিজেপি প্রার্থীর দেওরকে কুপিয়ে খুনের অভিযোগ উঠেছে শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রবিবার উত্তাল হল দিনহাটা। নিহতের বাড়িতে যান নিশীথ প্রামাণিক। সেখান থেকে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিশানা করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। বলেছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে বারুদের পাহাড়ের উপরে বসে পিকনিক করছেন, যে দিন এই বারুদের পাহাড়ে বিস্ফোরণ ঘটবে, সে দিন বাংলা তছনছ হয়ে যাবে!’’ পাল্টা নিশীথকে বিঁধেছেন রাজ্যের উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী উদয়ন গুহ। তিনি বলেন, ‘‘নিশীথ যেখানে যাচ্ছেন, সেখানেই এই ধরনের ঘটনা ঘটছে!’’ দলের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগও অস্বীকার করেছেন দিনহাটার বিধায়ক উদয়ন।

সুপ্রিম কোর্টে বাহিনী-মামলা

মনোনয়ন জমার প্রথম পাঁচ দিনে হিংসার ঘটনাক্রম দেখে গত বৃহস্পতিবার সকালেই কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের ‘হুঁশিয়ারি’ দিয়েছিল হাই কোর্ট। তার পরেও মনোনয়ন দাখিলের শেষ দিনে ভোটজনিত গোলমালেই দুষ্কৃতীদের হামলায় রাজ্যে কয়েক জনের মৃত্যু হয়। বেশ কয়েক জন গুরুতর জখমও হন। রাজ্য রক্ত ঝরার এই খবর আসার পরেই বিকেলে কেন্দ্রীয় বাহিনী আনা নিয়ে আদালতের ‘হুঁশিয়ারি’ নির্দেশে বদলে যায়। উচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, এ বার পঞ্চায়েত ভোটে সারা রাজ্যেই কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতে হবে। তবে বাহিনীর খরচ বহন করবে কেন্দ্র। উচ্চ আদালতের এই নির্দেশের ৪৮ ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর জানা যায়, রাজ্য ও কমিশন শীর্ষ আদালতে এসএলপি দায়ের করেছে। কিন্তু তার ভিত্তিতে কোনও এসএলপি নম্বর দেওয়া হয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়। ফলে, মামলাটি গৃহীত হয়েছে, সে কথাও জোর দিয়ে বলা যায় না। কমিশন সূত্রে খবর, সোমবার এই বিষয়টি নিয়ে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হতে পারে। আর্জি জানানো হতে পারে দ্রুত শুনানির। তার পরেই আদালত সিদ্ধান্ত নেবে, মামলার শুনানি হবে কি না এবং হলে তা সোমবারই হবে না কি অন্য কোনও দিন।

আইনি চাপে রাজ্য-কমিশন?

হাই কোর্টের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে রাজ্য যে সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারে তা আঁচ করেই আগেভাগে ক্যাভিয়েট দাখিল করে রেখেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং কংগ্রেস সাংসদ আবু হাসেম খান চৌধুরী। রবিবার ক্যাভিয়েট দাখিল করেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও। শনিবার শুভেন্দুর আইনজীবী সূর্যনীল দাস বলেছেন, ‘‘রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে কলকাতা রায়ের প্রতিলিপি পাঠিয়েছিলাম। বৃহস্পতিবার রাত ৮:১৭ মিনিটে কমিশনকে রায়ের বিষয়ে জানানো হয়েছিল। সময়ের ওই হিসাব ধরলে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে। এই অবস্থায় নির্দেশ কার্যকর না হলে আদালত অবমাননা হওয়া উচিত। আর সুপ্রিম কোর্টে আমরা আগাম ক্যাভিয়েট দাখিল করে রেখেছি। ফলে রাজ্য বা রাজ্য নির্বাচন কমিশন শীর্ষ আদালতে এসএলপি করেছে কি না জানা নেই। আমরা এখন পরিস্থিতির উপর নজর রাখছি।’’ আইনজীবীদের একাংশের বক্তব্য, রাজ্য ও কমিশন যে এসএলপি দায়ের করেছে, তার ভিত্তিতে তারা যদি এসএলপি নম্বর পেয়ে থাকে, তা হলে মামলাটি গৃহীত হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে। যার অর্থ, মামলাটি এখন বিচারাধীন। সে ক্ষেত্রে আদালত অবমাননার মুখে পড়বে না রাজ্য। কিন্তু যদি মামলাটি সোমবার না ওঠে, সে ক্ষেত্রে আইনি চাপে পড়ার প্রভূত সম্ভাবনা রয়েছে রাজ্যের। কারণ, হাই কোর্ট যা নির্দেশ দিয়েছে, তা বাস্তবায়িত করার জন্য কমিশনের তরফে কোনও পদক্ষেপ এখনও চোখে পড়েনি। যা আদালত অবমাননারই শামিল বলে মনে করেন তারা।

কোচবিহারে খুন

বিজেপি প্রার্থীর দেওরকে কুপিয়ে খুন করার অভিযোগ তৃণমূলের বিরুদ্ধে। দিনহাটা ২ নম্বর ব্লকের কিসামত দশগ্রাম এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছে। শনিবার রাত ১টা নাগাদ ওই বিজেপি কর্মীকে পুলিশ রক্তাক্ত অবস্থায় দিনহাটা মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে এলে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। বিজেপি সূত্রে খবর, মৃত বিজেপি কর্মীর নাম শম্ভু দাস। বৌদি বিশাখা দাস পঞ্চায়েত ভোটে বিজেপির প্রার্থী হয়েছেন। রবিবার তাঁর বাড়িতে যান নিশীথ। সেখানে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘গতকাল সাহেবগঞ্জ বিডিও অফিসে আমাদের বহু প্রার্থীকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছিল তৃণমূল। দিনহাটার কিছু কুখ্যাত নেতা রয়েছেন, যাঁরা শম্ভু দাসের মৃত্যুকে নিয়ে কুকথা বলছেন। দিনহাটার এখন অরাজকতা চলছে। বারবার আইনশৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে। পর পর দু’বার আমার গাড়িতে আক্রমণ হয়েছে। এক মাসের মধ্যে দিনহাটা বিধানসভায় দুটো হত্যালীলা চলল। তৃণমূলের পায়ের তলার মাটি সরে গিয়েছে। যখন দেখছে আর লড়াই করে পেরে উঠছে না, তখন আমাদের কর্মীদের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে।’’ পাল্টা উদয়ন বলেন, ‘‘স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা নেই নিশীথ প্রামাণিকের। উনি যেখানে যেখানে যাচ্ছেন, সেখানেই সমস্যা তৈরি হচ্ছে। গোলমাল পাকাচ্ছে নিজের ব্যর্থতা নিজের অপদার্থতা ঢাকার জন্য। শম্ভু দাসের মৃত্যু অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। কিন্তু সেটা ত্রিমুখী প্রেমের ঘটনা। আমরা সেটা এলাকার মানুষদের থেকে খবর পেয়েছি। প্রত্যেকটা খুনের পিছনে একটা কারণ থাকে। শম্ভু দাস কোনও রাজনৈতিক দল করতেন না। শম্ভুর দাদা-বৌদি খুন হলে তাও বোঝা যেত যে এই কারণে খুন হয়েছে! কিন্তু আমার প্রশ্ন শম্ভুকে কী কারণে তৃণমূল খুন করতে যাবে।’’

মনোনয়ন প্রত্যাহারে চাপ

মনোনয়ন প্রত্যাহারে চাপ সৃষ্টির অভিযোগ উঠল শাসকদলের বিরুদ্ধে। সিপিআইএম প্রার্থীকে মনোনয়ন তোলার জন্য ক্রমাগত চাপ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। শাসকদলের চাপের কাছে নতিস্বীকার না করায় প্রার্থীর স্বামীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে মারধরের অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। অন্য দিকে, পাল্টা সিপিএমের বিরুদ্ধে বুথ কমিটির সভাপতি ও তাঁর অনুগামীদের উপর রড, লাঠি ও শাবল নিয়ে হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনায় পূর্ব বর্ধমানের ক্ষেতিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের বারাসতি গ্রামে উত্তেজনা ছড়ায় শনিবার রাতে। ক্ষেতিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৮ নম্বর সংসদের তৃণমূল সভাপতি কিশোর সাঁতারার মেরে হাত ভেঙে দেওয়া হয়েছে বলে সিপিএমের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে তৃণমূল। সিপিএম ও তৃণমূল উভয় পক্ষই দেওয়ানদিঘী থানায় অভিযোগ দায়ের করেছে। পুলিশ এই ঘটনায় ১৮ নম্বর বুথের সিপিএম প্রার্থী অম্বিকা ঘোষের স্বামী বিপ্লব ঘোষকে গ্রেফতার করেছে। ধৃতকে রবিবার বর্ধমান আদালতে হাজির করানো হয়। সিপিএমের বর্ধমান সদর ১ নম্বর এরিয়া কমিটির সম্পাদক মৃণাল কর্মকার বলেন, ‘‘তৃণমূল ও পুলিশ যৌথ ভাবে সন্ত্রাস চালাচ্ছে। আমাদের প্রার্থীকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, মারধর করা হচ্ছে। অথচ আমাদের কর্মীকে পুলিশ গ্রেফতার করছে।’’ বর্ধমান ১ নম্বর ব্লকের তৃণমূল সভাপতি কাকলি তা বলেন, ‘‘আমাদের বুথ সভাপতিকে মারধর তো সিপিএম করেছে। এখন মিথ্যা অভিযোগ করছে সিপিএম। তৃণমূল কেন খামোখা সিপিএমের প্রার্থীদের হুমকি দিতে যাবে?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE