বদল: লকডাউনের জেরে বন্ধ যাত্রী পরিবহণ। তাই টোটোয় করে আনাজ নিয়েই চলছে বিক্রি। হাওড়ার মন্দিরতলায়। ছবি: রণজিৎ নন্দী
দাদা-ভাই ট্রেনে হকারি করতেন। লকডাউন শুরুর পরে ট্রেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁদের কাজ নেই কয়েক সপ্তাহ। প্রথম কয়েক দিন বাড়িতেই ছিলেন। কিন্তু জমানো টাকা শেষ হয়ে যাওয়ায় আর সংসার চালাতে পারছিলেন না। বাধ্য হয়ে এক দিন একটি ভ্যানে আনাজ নিয়ে বিক্রি করতে বেরিয়ে পড়েন দু’জন। কোন্নগরের সেই দুই ভাই, সঞ্জীব ও সুব্রত রায় এখন এলাকার ‘মুখ’ হয়ে উঠেছেন।
উত্তরপাড়ার কলোনি বাজারের কাছে ঘুপচি দু’টি ঘরে থাকেন সঞ্জীব ও সুব্রত। সঞ্জীবের কথায়, ‘‘কঠিন পরিস্থিতিতে পেশা বদল করতে হয়েছে ঠিকই। কিন্তু লকডাউন আমাদের আরও কাছাকাছি নিয়ে এল।’’ বলতে বলতে চোখ চিকচিক করে ওঠে ওই যুবকের। পাশে থাকা সুব্রত তখন দাদার পিঠে হাত বোলাচ্ছেন।
আদতে বিহারের বাসিন্দা হলেও কাজের খোঁজে কবে কলকাতায় এসেছিলেন, আজ মনে করতে পারেন না বছর সত্তরের আনন্দ লাল। নিউ আলিপুরের ভাটিখানায় থাকেন বৃদ্ধ। চার দশকের উপর হরিদেবপুর ফাঁড়িতে সন্ধ্যায় ফুচকা নিয়ে বসেন। রয়েছে শরবতের দোকানও। কিন্তু লকডাউন এক ধাক্কায় বদলে দিয়েছে তাঁর রোজকার রুটিন। দোকান বন্ধ। তাই ভ্যানে গাজর, সজনে ডাঁটা, আলু-পেঁয়াজ, কাঁচা আম নিয়ে বসছেন আনন্দ। বিহারে দেশের বাড়িতে রয়েছেন স্ত্রী, বড় ছেলে আর দুই নাতি। এখানে দুই ছেলে আর এক বৌমাকে নিয়ে থাকেন। বৃদ্ধ জানালেন, এত জনের পেট চালাতে হবে তো। তাই আনাজ নিয়ে বসেছেন।
আরও পড়ুন: বিজেপি সাংসদদের পক্ষে সরব ধনখড়, ক্ষুব্ধ তৃণমূল
নাকতলার বাসিন্দা বিকাশ সিংহ পেশায় অ্যাপ-ক্যাব চালক। কিন্তু এখন কাজ না থাকায় স্থানীয় বাজারে ফল নিয়ে বসছেন। তালিকায় রয়েছেন হরিদেবপুরের অনুপ দাসও। একটি ফাস্ট ফুডের দোকানের মালিক অনুপ লকডাউন ঘোষণা হতেই কর্মচারীদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। দোকান বন্ধ। কিন্তু কলকাতায় থাকতে গেলে তো টাকার দরকার। অগত্যা আলু, পেঁয়াজ নিয়ে বসছেন ইদানীং।
শুধু সঞ্জীব, সুব্রত, আনন্দ লাল, বিকাশ বা অনুপ নন। লকডাউনের জেরে সর্বত্র দিশাহারা অসংগঠিত ক্ষেত্রের এমন বহু শ্রমিক। সংসার চালাতে, কেউ কলকাতায় থাকার বাড়ি ভাড়া গুনতে, কেউ গাড়ির ঋণের কিস্তি শোধ করতে বদলে ফেলেছেন পেশাই।
আরও পড়ুন: মানতে হবে লকডাউন, বন্ধ হল রাস্তা
এই তালিকায় রয়েছেন শহর ও শহরতলির টোটো এবং অটোচালকেরাও। কোন্নগরের টোটোচালক শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও কমল নাথ টোটো করেই বাড়ি বাড়ি মাছ বিক্রি করছেন। শুভঙ্কর বলেন, ‘‘দু’জনে মিলে টোটো চালিয়ে মাছ বেচছি। বিক্রির টাকা ভাগ করে নিচ্ছি।’’ টালিগঞ্জ-হাজরা রুটের অটোচালক বিশু ঘোষ আবার টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোর এক হকার এবং পাড়ার আরও এক জনকে নিয়ে রোজ ভোরে বারুইপুর, কেওড়াপুকুর থেকে কিনে আনছেন আনাজ, ডিম। দুপুর পর্যন্ত যা বিক্রি হচ্ছে, সেই টাকা ভাগ করে নিচ্ছেন তিন জন। বিশু জানালেন, এক-এক জনের হাতে কোনও দিন আসছে ১০০ টাকা, কোনও দিন ২০০ টাকা।
সালকিয়ার বাসিন্দা কমল নাথ কাজ করেন কলকাতার এক বেসরকারি সংস্থায়। লকডাউনের পর থেকে অফিস বন্ধ। হাতে পাননি মার্চের বেতনও। তাঁর কথায়, ‘‘এই পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে মুড়ি বিক্রি করতে শুরু করেছি। কিন্তু এ ভাবে কত দিন সংসার চালাতে পারব জানি না।’’
দেশ জুড়ে থাকা অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকেরা শঙ্কিত তাঁদের রুটিরুজি নিয়ে। শহর এবং শহরতলিতে বেশির ভাগ শ্রমিক পেশা বদলে আনাজ, মাছ, দুধ বিক্রি শুরু করেছেন। কিন্তু নিজেরাও বুঝছেন, সবাই যদি আনাজ, মাছ বিক্রি করতে বসেন, তা হলে কিনবে কে? ওঁদের কথায়, ‘‘শুধু বেঁচে থাকতেই এই চেষ্টা। জানি না, কত দিন এ ভাবে চলবে।’’ কেউ কেউ আবার বলছেন, ‘‘এই তো ক’টা দিন। লকডাউন উঠলে ঠিক সামলে নেব।’’ যদিও তালাবন্দি দশা আরও দীর্ঘায়িত হলে কী ভাবে দিন চলবে, সেই চোরা আশঙ্কাও ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকের মনে।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy