Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

ধারের জেরে ঘোর দুর্দিন আর দূরে নয়

ঋণের সুদ-আসল মেটাতে এখনই নাভিশ্বাস উঠছে। কিন্তু বছর দু’য়েকের মধ্যেই বোঝাটা এমনই ভারী হবে, যে শ্বাসটুকু নেওয়ার ক্ষমতাও প্রায় থাকবে না। আর সেই আশঙ্কার জেরেই ত্রাহি ত্রাহি রব নবান্নে।

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:৪১
Share: Save:

ঋণের সুদ-আসল মেটাতে এখনই নাভিশ্বাস উঠছে। কিন্তু বছর দু’য়েকের মধ্যেই বোঝাটা এমনই ভারী হবে, যে শ্বাসটুকু নেওয়ার ক্ষমতাও প্রায় থাকবে না। আর সেই আশঙ্কার জেরেই ত্রাহি ত্রাহি রব নবান্নে।

ব্যাপারটা কী?

অর্থ দফতরের হিসাব বলছে, বছর দুই পর থেকে বাজার থেকে নেওয়া ঋণের উপর সুদ আর আসল শোধের পরিমাণ এতটাই বেড়ে যাবে, যে রাজ্যের নিজস্ব আয় দিয়ে তা সামলানো যাবে না। তখন উন্নয়নের টাকা জোগাড় দূরের কথা, সরকারি কর্মচারীদের বেতন-পেনশনের টাকা কোথা থেকে আসবে তা নিয়েই উদ্বেগে অর্থ দফতরের কর্তারা। রাজ্যের নিজস্ব আয়ের পাশাপাশি, দিল্লির অনুদান আর কেন্দ্রীয় করের অংশ হিসেবে প্রাপ্য টাকা দিয়েই রাজ্য সচল থাকে। কিন্তু আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় প্রতি মাসেই বাজার থেকে ধার করে রাজ্য। দেদার এই ধারের ফাঁসেই এখন হাঁসফাঁস অবস্থা অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের।

দফতর সূত্রের খবর, ২০১৮-’১৯ আর্থিক বছরে রাজ্যের মোট ঋণের পরিমাণ সাড়ে তিন লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। আর সেই ঋণের সুদ-আসল মেটাতে পরের বছর কোষাগার থেকে বেরিয়ে যেতে পারে কম-বেশি ৫০ হাজার কোটি টাকা। অথচ এই পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনা বেশ কম বলেই মনে করছেন অর্থ দফতরের কর্তাদের একাংশ। এক কর্তার ব্যাখ্যা, ‘‘এত দিন অভাবের সংসারে বেতনের টাকায় সংসার চলতো এবং ইএমআই মেটানো হতো। কিন্তু অবস্থা যা দাঁড়াচ্ছে, তাতে এ বার ইএমআই মেটাতেই মাইনের টাকা শেষ হয়ে যাবে। ফলে সংসার চলবে কী করে, সেই ভাবনাতেই ঘুম নেই গৃহস্থের।’’

কেন এমন হল?

অর্থ দফতরের কর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, বামফ্রন্ট সরকারের ধার করে ঘি খাওয়ার নীতির ফলেই রাজ্যের আজ ভয়াবহ অবস্থা। ধারের উপর ধার, তার উপর আবার ধার নিয়ে ২০০০ সাল থেকে মাত্র দশ বছরেই রাজ্যকে ঋণগ্রস্ত করে ছেড়েছে বামেরা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সেই ঋণের জাল কেটে বেরনোর কোনও চেষ্টা তো করেইনি, উল্টে বাজার থেকে আরও ঋণ নিয়ে পরিস্থিতি ঘোরালো করে তুলেছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য বলছে, ১৯৯৮-’৯৯ সালে রাজ্যের ঋণের পরিমাণ ছিল ৩২ হাজার কোটির কাছাকাছি। ২০১১ সালে বাম সরকার বিদায় নেওয়ার সময় তা গিয়ে দাঁড়ায় ১ লক্ষ ৮৬ হাজার কোটি টাকায়। রাজ্যে পঞ্চম বেতন কমিশন তৈরি হয়েছিল ২০০৬-’০৭ সালে। ২০০৮-’০৯ সাল তার সুপারিশ কার্যকর করেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত। তাতে কর্মচারীদের বেতন-পেনশনের খরচ এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়ে যায়। সেই খরচ তুলতে থেকে বাজার থেকে ব্যাপক হারে ঋণ নেওয়া শুরু করে রাজ্য।

তৃণমূলও কম যায় না। তাদের আমলে বাজার থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকা। চলতি বছরের বাজেট প্রস্তাব বলছে, ২০১৫-’১৬ আর্থিক বছরের শেষে ঋণের পরিমাণ হবে ২ লক্ষ ৯৯ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা।

বাম আমলে নেওয়া দীর্ঘমেয়াদি ঋণপত্রের আসল শোধ করা শুরু হবে ২০১৭-’১৮ সাল থেকে। সেই সঙ্গে থাকছে নতুন করে নেওয়া ঋণের সুদ। ফলে আগামী পাঁচ বছরে সুদ-আসল মেটানোর পরিমাণ এক ধাক্কায় অনেকটাই বেড়ে যাবে। তার জেরে ২০১৭-’১৮ সাল থেকে কী ভাবে বেতন জোগানো হবে, তা ভেবে কুল পাচ্ছেন না অর্থ কর্তাদের কেউ কেউ।

অসম্ভব কেন?

এ বারও সেই অভাবী গৃহস্থের গল্প শুনিয়েছেন অর্থ দফতরের কর্তারা। তাঁর বেতনের পুরোটাই যখন ধার শোধে চলে যাচ্ছে, তখন সংসার চালাতে হলে পাল্লা দিয়ে বেতন বাড়া দরকার। সেটা যদি না-বাড়ে তা হলে তাঁর সমূহ বিপদ। রাজ্য সরকারের ঠিক সেই দশা। বাম আমলের তুলনায় অমিত মিত্র রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়েছেন ঠিকই, কিন্তু খরচের বহরও বেড়েছে কয়েক গুণ। খেলা-মেলা, উৎসব-দান খয়রাতির বহর প্রতি বছরই বেড়ে চলেছে। ফলে উদ্বৃত্ত বলতে প্রায় কিছুই থাকছে না। অর্থাভাবে উন্নয়নের কাজ তো ব্যাহত হচ্ছেই, এমনকী সরকারি কর্মচারীদের প্রাপ্য মহার্ঘ ভাতা পর্যন্ত দেওয়া যাচ্ছে না। কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতার ফারাক এখন প্রায় ৫০%। আগামী কয়েক বছরে রাজস্বের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির আশা করছেন না অর্থ দফতরের কর্তারা। এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘বর্তমানে রাজ্যের নিজস্ব রোজগারের ৬০% সুদ-আসল শোধ করতেই চলে যায়। বছর দুই পরে যখন পুরনো ঋণপত্রের আসল শোধের পর্ব আসবে তখন নিজস্ব রোজগারের ১০০% খরচ করেও আর তা সঙ্কুলান হবে না। সেটাই চিন্তা বাড়াচ্ছে।’’

তা হলে উপায়?

সঙ্কট যে ভয়াবহ, তা বিলক্ষণ জানেন অমিত মিত্র। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘বাম জমানার পাপ আমাদের বইতে হচ্ছে। গত সাড়ে চার বছরে আমাদের ৯১ হাজার কোটি টাকা ঋণ করতে হয়েছে। যার ৯০% অর্থাৎ ৮২ হাজার কোটি টাকা বকেয়া ঋণের সুদ-আসল মেটাতেই চলে গিয়েছে। সিপিএম সরকার যে বোঝা আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে গিয়েছে সেই চক্র থেকে বেরনোর উপায় নেই। ফলে রাজ্যকে নতুন করে ঋণ নিয়েই ফের পুরনো ঋণের দায় মেটাতে হচ্ছে।’’

যদিও এ কথা মানেন না বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। তিনি বলেন, ‘‘বামফ্রন্টের ৩৪ বছরে ঋণ ছিল ১ লক্ষ ৮৬ হাজার কোটি। আর এরা পাঁচ বছরেই প্রায় এক লক্ষ কোটি ঋণ নিয়েছে। বাম জমানায় ক্ষুদ্র সঞ্চয় বা কেন্দ্রীয় সরকার থেকে ঋণ ছিল বেশি, তৃণমূল তো বাজার থেকে ঋণ করে সরকারটাকে বাজারের হাতে তুলে দিয়েছে।’’ সূর্যবাবুর মতে, মূল বিষয় হলো খরচে রাশ টানা। কিন্তু গত পাঁচ বছরে আহারে আর বিহারেই কোটি কোটি বেরিয়ে গিয়েছে। খরচে শৃঙ্খলা আনলে এখনও ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খোলা আছে। অর্থমন্ত্রীর অবশ্য পাল্টা বক্তব্য, সুদ-আসল শোধের উপর তিন বছরের স্থগিতাদেশ, আর কেন্দ্রীয় সরকারি ঋণ মকুবের সুবিধাটুকু পাওয়া গেলেই রাজ্য ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু মনমোহন সিংহ থেকে নরেন্দ্র মোদী, বারবার দরবার সত্ত্বেও কোনও প্রধানমন্ত্রীই কিছু করছেন না।

অর্থ দফতরের কর্তারা আবার বলছেন, শুধু খরচ কমিয়ে বা ঋণ শোধের উপরে স্থগিতাদেশ পেলেই সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা যাবে, এমনটা নয়। দরকার আরও নতুন নতুন ক্ষেত্রে কর বসানো। বর্তমান করের হারও বাড়াতে হবে। কিন্তু এই দুটোর কোনওটিই মুখ্যমন্ত্রী চান না। এক কর্তা বলেন, ‘‘কালের নিয়মে রাজ্যের অর্থনীতির বহর (মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন) বাড়লে বাজার থেকে ঋণ করার ক্ষমতাও বাড়বে। সেই ঋণ নিয়েই পরিস্থিতি সামলাতে হবে।’’

আনন্দবাজার কী বলছে?

ঋণ নিয়ে রাজ্য চালানো কোনও স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। আনন্দবাজার মনে করে, রাজ্যে ২০১০-’১১ সালে বাজেট নিয়ন্ত্রণ আইন চালু হলেও আয়-ব্যয়ের উপরে নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট কার্যকর হয়নি। সরকারকে প্রথমেই যা করতে হবে তা হল, যাবতীয় অপ্রয়োজনীয় খরচ বন্ধ করা। রাশ টানতে হবে সরকারি কর্মচারী নিয়োগের উপরেও। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কোনও নিয়োগ করা যাবে না অন্তত ৫ থেকে ৭ বছর। তার পরেও দরকার পড়লে ছাঁটতে হবে উন্নয়ন খাতে খরচ। এ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের তালিকা তৈরি করতে হবে পক্ষপাতহীন ভাবে।

পাশাপাশি আয় বাড়ানোর নানা পথ খুঁজতে হবে অর্থ-সহ প্রায় সব দফতরকে। যাতে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের অন্তত ১০% রাজস্ব হিসাবে রাজ্য আয় করতে পারে। এই হার এখন ৫%-র কাছাকাছি। অথচ অন্ধ্রপ্রদেশের মতো রাজ্য তাদের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের প্রায় ১০% নিজস্ব কর থেকে সংগ্রহ করে। এই পথেই তারা ঘাটতি শূন্য রাজ্য হয়েছে। খরচ কমাতে প্রয়োজনে সরকারি কর্মচারীদের স্বেচ্ছাবসর প্রকল্প এনে বেতন-পেনশনের চাপ কমাতে হবে রাজ্যকে। তবেই রাজ্য ঋণের ফাঁস থেকে বেরোতে পারবে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE