গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সন্দেশখালিকাণ্ডে অবশেষে গ্রেফতার হলেন শাহজাহান শেখের ‘শাগরেদ’ তথা তৃণমূল নেতা শিবপ্রসাদ হাজরা। গত সপ্তাহে দফায় দফায় হিংসার ঘটনার পরে সঙ্গী উত্তম সর্দার গ্রেফতার হলেও শিবুকে কেন ধরা হচ্ছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছিল। একই সঙ্গে প্রশন্ উঠেছিল, সংবাদমাধ্যমের সামনে শিবুকে দেখা গেলেও পুলিশ কেন খুঁজে পাচ্ছে না তাঁকে? শনিবার উত্তম ও শিবু— দু’জনের বিরুদ্ধেই দায়ের হওয়া মামলায় গণধর্ষণ ও খুনের চেষ্টার ধারা যোগ করে পুলিশ। ঘটনাচক্রে, তার পরেই গ্রেফতার করা হয় শিবুকে। রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার বিবৃতি দেন, সন্দেশখালিতে আইনশৃঙ্খলা ও শান্তি ফেরাতে পুলিশ প্রশাসন বদ্ধপরিকর। যাঁকে কেন্দ্র করে এই সন্দেশখালি পর্বের সূত্রপাত, সেই শাহজাহান কেন এখনও গ্রেফতার হননি, তা নিয়েও মুখ খুলেছেন রাজীব। এর দায় ডিজি চাপিয়েছেন ইডির ঘাড়ে। অন্য দিকে, সন্দেশখালিতে এক শিশুর উপর অত্যাচারের যে অভিযোগ উঠেছে, সেই বিষয়টি নিয়ে শনিবার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশের কাছ থেকে রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে রাজ্যের শিশু সুরক্ষা কমিশন।
স্থানীয় মহিলাদের উপর যৌন নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে এখনও উত্তাল সন্দেশখালি। সেই সব অভিযোগ ঘিরে রাজ্য রাজনীতিতে শোরগোল শুরু হওয়ার পর এ বার গণধর্ষণের ধারায় মামলা হল অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে। শনিবার সন্ধ্যায় ভবানী ভবনে সাংবাদিক বৈঠক করে রাজীব জানান, এক মহিলার গোপন জবানবন্দির ভিত্তিতে উত্তম ও শিবুর বিরুদ্ধে গণধর্ষণের ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে। যুক্ত হয়েছে খুনের চেষ্টার ধারাও। ঠিক তার পরেই খবর আসে, ন্যাজাট থানা এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে শিবুকে। রবিবার তাঁকে বসিরহাট আদালতে হাজির করিয়ে নিজেদের হেফাজতে নেওয়ার আবেদন করবে পুলিশ। বস্তুত, সন্দেশখালি-২ ব্লকের সভাপতি শিবুর নাম উঠে আসে শাহজাহানের সূত্র ধরে। গত ৭ ফেব্রুয়ারি তাঁদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগে উত্তাল হয়েছিল সন্দেশখালি। ভাঙচুর চলে জেলা পরিষদের সদস্য তথা তৃণমূলের বহিষ্কৃত অঞ্চল সভাপতি উত্তমের বাড়িতে। পর দিন ভাঙচুর করা হয় শিবুর বাগানবাড়ি এবং মুরগির খামার। আগুনও ধরিয়ে দেওয়া হয় ওই খামারে। তখন থেকেই তাঁকে গ্রেফতারের দাবি জানাচ্ছিলেন স্থানীয়েরা। তাঁদের প্রশ্ন ছিল, যেখানে এত অভিযোগ জমা পড়েছে শিবুর বিরুদ্ধে, সংবাদমাধ্যমে তাঁকে দেখা গেলেও পুলিশ কেন তাঁকে গ্রেফতার করছে না। স্থানীয়দের বক্তব্য, শিবুদের বিরুদ্ধে শুধু গণধর্ষণের ধারায় মামলা দিলেই চলবে না, তাঁদের শাস্তির ব্যবস্থাও করতে হবে।
সন্দেশখালির বাসিন্দাদের উদ্দেশে শনিবার বার্তা দিয়েছেন ডিজি। তিনি বলেন, ‘‘৮ ফেব্রুয়ারির আগে আমাদের কাছে সন্দেশখালি থেকে কোনও অভিযোগ জমা পড়েনি। তার পর থেকে আমাদের কাছে যা যা অভিযোগ এসেছে, সব কিছুই তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। সন্দেশখালির মহিলারা নির্ভয়ে পুলিশে কাছে গিয়ে নিজেদের বক্তব্য জানাতে পারেন।’’ পাশাপাশি সন্দেশখালিতে ১৪৪ ধারা কবের মধ্যে উঠতে পারে, তা নিয়ে পুলিশ প্রশাসনের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন রাজীব। গত সপ্তাহে গোটা সন্দেশখালি জুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করেছিল পুলিশ। তা নিয়ে কলকাতা হাই কোর্টে মামলাও হয়। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশ মেনে এলাকাভিত্তিক ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। তার পরেই সেই ১৪৪ ধারার কারণ দেখিয়ে তাঁদের এলাকায় ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ তুলেছেন বিরোধীরা। বিষয়টিতে হাই কোর্টেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ডিজি জানান, এলাকাভিত্তিক পর্যালোচনা করেই যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তাঁর কথায়, ‘‘এলাকাভিত্তিক রিভিউ করা হবে। আমরা চাইছি স্বাভাবিক জীবন ফিরে আসুক। তাই যে সব এলাকায় ১৪৪-এর দরকার নেই, সেই সব জায়গায় এক-দু’দিনের মধ্যে ১৪৪ ধারা তোলার প্রক্রিয়া শুরু হবে।’’ কেন এখনও ১৪৪ ধারা প্রয়োগ করা হয়েছে, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ডিজি বলেন, ‘‘কেউ কেউ সাম্প্রদায়িক রং দেওয়ার চেষ্টা করছিল। বিভিন্ন লোক আইন ভাঙার চেষ্টা করছিল। তাই বাধ্য হয়ে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।’’
সাংবাদিক সম্মেলনে শাহজাহানের প্রসঙ্গও ওঠে। তাতে রাজীব প্রশ্ন তোলেন, ইডিই তো শাহজাহানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তারা কেন তাঁকে গ্রেফতার করছে না? ডিজির বক্তব্য, রাজ্য পুলিশ যখন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে, ইডিই সেই তদন্ত বন্ধ করিয়ে দিয়েছে।
সন্দেশখালিতে হিংসার ঘটনার আবহে শাহজাহান শেখ ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের জমিজমা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তার প্রেক্ষিতে ডিজি বলেন, ‘‘কাল থেকে ভূমি সংক্রান্ত দফতর সন্দেশখালিতে শিবির করবে। তাদের কাছে অভিযোগ জানানো যাবে। একই সঙ্গে পুলিশের কাছেও অভিযোগ জানানো যাবে। আমরা সত্যের সামনে দাঁড়াতে রাজি আছি। যার বিরুদ্ধে যে রকম প্রমাণ পাওয়া যাবে, সেই অনুয়াযী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
সন্দেশখালিতে রাজ্যের শিশু কমিশন
সন্দেশখালিতে শিশুর উপর অত্যাচারের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে শনিবার সন্দেশখালি গিয়েছিল রাজ্যের শিশু সুরক্ষা কমিশন। ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ঘুরে ঘুরে গ্রামগুলির পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেন। যে শিশুটিকে মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলার অভিযোগ উঠেছিল, তার বাড়িতে গিয়ে দেখা করেন প্রতিনিধিরা। শিশুটির চিকিৎসার বন্দোবস্তও করা হয়েছে বলে তাঁরা জানান। কমিশনের হস্তক্ষেপের পর শনিবার ওই বাড়িতে জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিককে মেডিক্যাল দল পাঠানোর ব্যবস্থা করতে বলা হয়। গত ১০ ফেব্রুয়ারি সন্দেশখালিতে শিশুর উপর অত্যাচারের অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছিল। এক শিশুকে তার মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলা হয়েছিল বলে অভিযোগ। সন্দেশখালির বাসিন্দা ভুজঙ্গ দাসের স্ত্রী সংবাদমাধ্যমে বলেছিলেন, ‘‘মুখে কালো কাপড় বেঁধে পুলিশ এসেছিল। ওদের কারও কারও পায়ে জুতো ছিল না। কেউ আবার চপ্পল পরে এসেছিল। বাইরে থেকে আমার স্বামীকে ডাকছিল। দরজা না খোলায় গালাগালি করে। সন্দেশখালি থানার এক জন ছিল। ওরা আমার কোল থেকে বাচ্চা ফেলে দিয়েছিল। আমার চুলের মুটি ধরে টানে। এমনকি পুরুষ পুলিশ নাইটি টেনেছিল।’’ বিজেপির দাবি, ভুজঙ্গ তাদের দলের কর্মী। সেই কারণেই তাঁর বাড়িতে হামলা হয়েছে। শিশুটির বাড়ি থেকে বেরিয়ে কমিশনের চেয়ারপার্সন তুলিকা দাস সংবাদমাধ্যমকে জানান, বাড়িতে কেবল মা এবং সেই শিশু রয়েছে। তাঁরা বাড়ি থেকে বেরোতেই ভয় পাচ্ছেন। ফলে চিকিৎসা পরিষেবা মিলছে না। তুলিকা বলেন, ‘‘ওঁরা খুব ভয় পেয়ে আছেন। বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন না। আমরা গিয়েই প্রথমে জিজ্ঞাসা করেছি, আপনারা কী চান? শিশুর মা জানান, সে দিনের পর থেকে শিশুটিকে তিনি চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে পারেননি। চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা হোক। আমরা সঙ্গে সঙ্গে সেই ব্যবস্থা করে দিয়েছি। শনিবারই বাড়িতে পৌঁছে যাবে মেডিক্যাল দল। এ ছাড়া, ওঁরা যে হেতু বাড়ি থেকে বেরোতে পারছেন না, তাই খাবারের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি দেখতে বলেছি।’’ পরিবারের নিরাপত্তার বন্দোবসও করা হয়েছে বলে জানান তুলিকা। কমিশন স্থানীয় থানায় ওই পরিবারকে নিরাপত্তা দেওয়ার কথা জানিয়েছে। তাঁদের বাড়ির সামনে এক জন পুরুষ এবং এক জন মহিলা পুলিশ কর্মী বহাল থাকবেন। কমিশনের চেয়ারপার্সনের কথায়, ‘‘ওঁরা ভয়ে আছেন। আমরা আমাদের ব্যক্তিগত ফোন নম্বর ওঁদের দিয়ে এসেছি। প্রতি দিন সকালে ফোন করে খবর নেব বলে জানিয়েছি। ওঁদের আশ্বস্ত করার যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি।’’
সন্দেশখালি বিতর্কে পুলিশে বদল
সন্দেশখালি নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই রাজ্য পুলিশের এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) পদে বদল। বদলি করা হল বারাসতের ডিআইজি-কেও। ঘটনাচক্রে, এই দুই পুলিশকর্তার নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই সন্দেশখালি এলাকা পড়ে। এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) পদ থেকে গত ৩১ জানুয়ারি বদলি হন সিদ্ধনাথ গুপ্ত। তবে সন্দেশখালিতে অশান্তি শুরু হতেই তাঁকে সেখানে পাঠানো হয়। এ বার সেই পদে নিয়ে আসা হল সুপ্রতিম সরকারকে। বছর দুয়েক আগে উত্তর ২৪ পরগনার বাগুইআটিতে দুই স্কুলপড়ুয়া খুনের ঘটনার মধ্যে বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের কমিশনার পদ থেকে সরানো হয়েছিল সুপ্রতিমকে। তখন থেকেই রাজ্য পুলিশের ট্র্যাফিক ও রোড সেফটির এডিজি ও আইজিপি পদে ছিলেন সুপ্রতিম। সন্দেশখালি এবং ন্যাজাট থানা বারাসতের ডিআইজির নিয়ন্ত্রণাধীন। বারাসতের ডিআইজি সুমিত কুমারকে সরিয়ে শনিবার সেই জায়গায় নিয়ে আসা হচ্ছে ভাস্কর মুখোপাধ্যায়কে। সুমিতকে ডিআইজি (নিরাপত্তা) পদে পাঠানো হয়েছে। ভাস্করকে বারাসত পুলিশ জেলার সুপার থেকে গত ৩১ জানুয়ারি মালদহ রেঞ্জের ডিআইজি হিসাবে পাঠানো হয়।
রবিতে বাতিল তৃণমূলের সভা
সন্দেশখালিতে রবিবার তৃণমূলের সভা হচ্ছে না। বদলে ওই দিন সন্দেশখালি যাবেন রাজ্যের দুই মন্ত্রী পার্থ ভৌমিক এবং সুজিত বসু। তাঁরা গিয়ে সন্দেশখালির স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলবেন এবং একই সঙ্গে ঘোষণা করবেন সন্দেশখালির ঘটনা নিয়ে তৃণমূলের সভা কবে হতে চলেছে। রাজ্যে চলতে থাকা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্যই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে তৃণমূল সূত্রে খবর। তবে দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, আগামী ২৯ ফেব্রুয়ারি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ৩ মার্চ ওই সভা হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy