Advertisement
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
Buddhadeb Bhattacharjee Death

বলেছিলাম, পার্টিকে বোঝান বিজেপির বিপদটা

বুদ্ধবাবু আমার রাজনৈতিক বিরোধী ছিলেন। তীব্র আক্রমণ করেছেন আমাকে। আমিও রাজনীতির মঞ্চে তাঁকে বিদ্ধ করেছি। কিন্তু সরকারে বসার পরে আমি চেষ্টা করে গিয়েছি তাঁর সঙ্গে সামাজিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক রক্ষার।

মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রথম বার শপথ নেওয়ার আগে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-সহ বিরোধী নেতাদের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রথম বার শপথ নেওয়ার আগে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-সহ বিরোধী নেতাদের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। —ফাইল ছবি।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০২৪ ০৭:৫১
Share: Save:

সাল ২০০৮। সিঙ্গুর আন্দোলন তখন তুঙ্গে। জোর করে চাষের জমি আমরা কিছুতেই নিতে দেব না। সেই নিয়েই তাঁর সঙ্গে বিবাদ। সেই বিষয়েই আমাদের সামনাসামনি দেখা হল রাজভবনে।

যত দূর মনে পড়ছে, তার আগে মাত্র এক বারই ওঁর মুখোমুখি হয়েছিলাম। সেটা ছিল বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর দিন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সেই সময় পুলিশমন্ত্রী। আমি কংগ্রেসে। শান্তিরক্ষার জন্য রাস্তায় নামা আমাদের ছেলেদের পুলিশ নির্বিচারে গ্রেফতার ও মারধর করছিল। লালবাজারকে বার বার বলেও লাভ হচ্ছিল না। প্রতিবাদ জানাতে তাই সোজা চলে গিয়েছিলাম পুলিশমন্ত্রীর ঘরে।

দ্বিতীয় সাক্ষাৎ হল ওই সিঙ্গুর আন্দোলনের পর্বে। তখন তিনি মুখ্যমন্ত্রী। তার আগেই কলকাতায় ২৬ দিন অনশন করেছিলাম আমি। পরে আবার ফিরে গিয়েছি সিঙ্গুরে। ধর্নায় বসেছি সেখানে। তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী মধ্যস্থতা করে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমার মুখোমুখি বৈঠকের ব্যবস্থা করলেন।

সেখানে বুদ্ধবাবুর সঙ্গে ওই প্রসঙ্গে সরাসরি কিছু কথা হল। তিনি এবং আমি যে সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থানে দাঁড়িয়েছিলাম, সেটা তো অজানা কিছু নয়। তা-ই সেই বিশদে যাচ্ছি না।

তবে সেখানে গোপাল গান্ধী অদ্ভুত ঘটনা ঘটালেন। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বললেন, ‘‘যে পথে যেতে হবে, সে পথে তুমি একা….। পরের পংক্তিটি কী? কে বলবেন?’’ কেন তিনি ওই লাইনটি বললেন, জানি না। কিন্তু তার ভিতর থেকে সেই সময়ে কেমন যেন অর্থ খুঁজে পাচ্ছিলাম।

বুদ্ধবাবু সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ে চর্চা করতেন। তবু দেখলাম, সেই মুহূর্তে তিনি চুপ! কেন, বুঝলাম না। এ বার আমি বলতে লাগলাম, ‘‘নয়নে আঁধার রবে, ধেয়ানে আলোকরেখা…।’’ গোপাল গান্ধী হেসে উঠলেন। বুদ্ধবাবু চোখ তুলে দেখলেন।

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে গিয়ে শ্রদ্ধা জানালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে গিয়ে শ্রদ্ধা জানালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

পরের দফায় নন্দনে আর এক বার তাঁর সঙ্গে একই কারণে বৈঠক করতে হয়েছিল। আমাদের তৃণমূল কংগ্রেসের কয়েক জন সহকর্মী নেতাও আমার সঙ্গে ছিলেন। ভরা থাক স্মৃতিসুধায়।

২০১১ সালে ভোটে জিতে আমাদের সরকার শপথ নিল রাজভবনের প্রশস্ত লনে। বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেববাবু, বিমান বসু প্রমুখ অনুষ্ঠানে ছিলেন। শপথের মঞ্চে যাওয়ার আগে সৌজন্য অনুযায়ী তাঁদের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। নমস্কার বিনিময় হয়েছিল। কথা নয়।

বুদ্ধবাবু আমার রাজনৈতিক বিরোধী ছিলেন। তীব্র আক্রমণ করেছেন আমাকে। আমিও রাজনীতির মঞ্চে তাঁকে বিদ্ধ করেছি। কিন্তু সরকারে বসার পরে আমি চেষ্টা করে গিয়েছি তাঁর সঙ্গে সামাজিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক রক্ষার। ক্রমশঃ তা অনেকটা সহজও হয়েছে। তাঁর স্ত্রী অর্থাৎ মীরা বৌদির সঙ্গেও ব্যক্তিগত যোগাযোগের পরিসর তৈরি হয়। রাজনীতিকে একেবারে দূরে রেখে এই যোগাযোগ আমার খুব ভাল লেগেছে।

প্রথম যে দিন বুদ্ধবাবুর পাম অ্যাভিনিউয়ের সরকারি আবাসনের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম, সেটা ছিল কিছুটা না-জানিয়েই। তিনি অসুস্থ ছিলেন শুনেছিলাম। বিভিন্ন সূত্রে এটাও জেনেছিলাম, তাঁদের ওই ফ্ল্যাটের ভিতরে বসবাস করার সমস্যা হচ্ছে। এক দিন অফিস থেকে ফেরার পথে সটান চলে গেলাম ওই বাড়ি। সঙ্গে তখনকার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার।

সে দিন কি একটু আড়ষ্ট ছিলেন শয্যাশায়ী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য! হতে পারে, অসুস্থতার জন্য হয়তো ভাল করে কথা বলতে পারেননি। বৌদির সঙ্গেই বেশি কথা হয়েছিল। প্রস্তাব দিয়েছিলাম, ওই ছোট ফ্ল্যাট ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার। বিনীত অনুরোধ জানিয়েছিলাম, বুদ্ধদা-র স্বাস্থ্য এবং বাসস্থান সংক্রান্ত যে কোনও প্রয়োজনে পাশে থাকতে চাই। বৌদি চা না-খাইয়ে ছাড়েননি।

পরে আরও কয়েক বার গিয়েছি। বৌদির সঙ্গে গল্প করেছি। বুদ্ধদা-র শারীরিক খোঁজখবর নিয়েছি। এক বার তাঁকে হাসপাতালে পাঠানোর খবর পেয়ে রাতেই গিয়েছিলাম আলিপুরের ওই চিকিৎসাকেন্দ্রে। পরেও যখনই তাঁকে হাসপাতালে যেতে হয়েছে, তাঁর খবর রেখেছি।

রাজনীতির প্রসঙ্গ তুলেছিলাম একবারই। বিজেপি-র বাড়াবাড়ি সম্পর্কে কথা উঠেছিল। বুদ্ধবাবুকে বলেছিলাম, ‘আপনার দলকে একটু সক্রিয় হতে বলুন না! বিজেপি-কে আটকানো খুব জরুরি। বিপদটা একটু বোঝান। আপনি বললে গুরুত্ব পাবে।’ তিনি শুনেছিলেন এবং এ-টুকু বলেছিলেন যে, বিজেপি-র বিপদ সম্পর্কে তিনিও ওয়াকিবহাল।

আজ তিনি নেই। তাই এই দিনে তাঁর রাজনৈতিক ভাবনা ও কাজের মূল্যায়ন করতে চাই না। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর কোন কোন সিদ্ধান্ত আমার বিচারে সঠিক ছিল না, সে সব কথাও আজ নয়। ইতিহাস সব কিছুর সাক্ষ্য দেবে। তবে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন তাঁর। সেই সম্মান তাঁর প্রাপ্য।

জীবন জীবনকে আলিঙ্গন করে। তাতে বন্ধন গড়ে ওঠে। মৃত্যু তৈরি করে শূন্যতা। আজ সেই শূন্যতার ক্ষণ। তাই আমাদের রাজনৈতিক মত-পথ-লক্ষ্য আলাদা হলেও কোথাও একটু ফাঁকা বোধ করছি। রাজনীতির ঊর্ধ্বে ব্যক্তি বুদ্ধদার জন্য আমার মনে যে শূন্যতার অনুভব, আজ সেটাই আমার কাছে বড়।

(অনুলিখন: দেবাশিস ভট্টাচার্য)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE