বিজেপি সূত্র বলছে, সংগঠনের আসন্ন রদবদলে বড়সড় উত্থান ঘটতে চলেছে প্রাক্তন আইপিএসের। গ্রাফিক: তিয়াসা দাস
লোকসভার ভোটে তিনি জিততে পারেননি। ধুন্ধুমার হিংসার ব্যূহ ভেদ করতে পারেননি। লক্ষাধিক ভোটে হেরেছেন। কিন্তু ভোট যা পেয়েছেন, তা অনেক জয়ী প্রার্থীর চেয়েও বেশি।
পুলিশের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে রাজনীতিতে আসা প্রাক্তন আইপিএস কতটা দৌড়তে পারবেন নতুন ট্র্যাকে, তার আভাস সে সময়েই মিলেছিল খানিকটা। কিন্তু ওই সব আভাস-ইঙ্গিত দিতে পারা বিজেপির মতো সংগঠনবাদী দলে শেষ কথা বলে না। শেষ কথা বলে সংগঠনের মস্তিষ্কে নিজের ছবিটাকে উজ্জ্বল করতে পারা। তাতেও বেশ সফল ভারতী ঘোষ। বিজেপি সূত্র বলছে, সংগঠনের আসন্ন রদবদলে বড়সড় উত্থান ঘটতে চলেছে প্রাক্তন আইপিএসের।
‘‘নিজের অতীতটাকে যদি ভুলিয়ে দিতে পারেন তিনি, তা হলে এ রাজ্যে বিজেপির সবচেয়ে উজ্জ্বল মহিলা মুখ তিনিই হয়ে উঠবেন,’’— ভারতী ঘোষ সম্পর্কে এমনই বলছিলেন রাজ্য বিজেপির এক শীর্ষনেতা। ‘অতীত’ বলতে ঠিক কী? ওই নেতার ব্যাখ্যা— অতীত হল পুলিশ অফিসার হিসেবে এক সময়ে জঙ্গলমহলে তাঁর ভূমিকা, অতীত হল বিরোধী দলগুলোর জন্য ত্রাস হয়ে ওঠা।
লোকসভা ভোটে লক্ষাধিক ভোটে হেরেছেন। কিন্তু ভোট যা পেয়েছেন, তা অনেক জয়ী প্রার্থীর চেয়েও বেশি। ফাইল চিত্র
ভারতী ঘোষের অতীতটা এই রকমই ছিল বলে যদি মনে করে বিজেপি, তা হলে দলে নিয়েছিল কেন? কেনই বা টিকিট দেওয়া হয়েছিল? রাজ্য স্তরের নেতার ব্যাখ্যা— পুলিশের চাকরি ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতী যোগ দেননি বিজেপিতে। রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে বেশ কিছু দিন লড়াই চালিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রক্ষাকবচ আদায় করার পরে উনি বিজেপিতে এসেছিলেন। ফলে তত দিনে কিছুটা হলেও প্রতিষ্ঠান বিরোধী ভাবমূর্তি তৈরি করে ফেলেছিলেন। তাই একটা সুযোগ দেওয়া হয়েছিল ভারতীকে এবং সেই সুযোগ ভারতী দারুণ ভাবে কাজে লাগিয়েছেন।
ঘাটালের মতো দুর্ভেদ্য ঘাসফুল দুর্গে লড়তে রাজি হয়ে যাওয়া, পুলিশ-প্রশাসনের তরফ থেকে প্রবল ‘সহযোগিতা’ সত্ত্বেও মাটি না ছাড়া, ভোটগ্রহণের দিনে রণক্ষেত্র হয়ে ওঠা কেশপুরেও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা— ভারতী ঘোষ নজর কেড়েছিলেন ভোটপর্বেই। ভোট গণনার পরে দেখা গেল তৃণমূলের সেলিব্রিটি প্রার্থীর কাছে তিনি হেরেছেন, কিন্তু ৬ লক্ষের বেশি ভোট পেয়েছেন। দেবের জয়ের ব্যবধান আগের বারের অর্ধেকেরও কমে নামিয়ে আনতে পেরেছেন। বিজেপি নেতৃত্বের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল ঘাটালের এই ফলাফল।
দেবের জয়ের ব্যবধান আগের বারের অর্ধেকেরও কমে নামিয়ে আনতে পেরেছেন। ফাইল চিত্র
কিন্তু বিজেপি সূত্রের খবর, ভারতী ঘোষ আরও বেশি করে নজর কাড়ছেন ভোটের ফল প্রকাশিত হওয়ার পরে। যে কেশপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে তিনি সবচেয়ে বেশি ভোটে পিছিয়ে পড়েছিলেন, ভোটগ্রহণের দিন যে কেশপুরে তাঁর প্রাণসংশয়ের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, ফলপ্রকাশের পর থেকে সেই কেশপুরেই সবচেয়ে বেশি নজর দিয়েছেন ভারতী ঘোষ। প্রাক্তন আইপিএসের এই ‘লড়াকু’ মানসিকতা এখন খুবই প্রশংসা কুড়োচ্ছে বিজেপির রাজ্য নেতাদের।
ভোটে জিতেছেন, অথচ কোনও একটা এলাকায় ফল খারাপ হয়েছে— এই রকম হলে জয়ী জনপ্রতিনিধি ওই দুর্বল এলাকায় নিজের সংগঠন সবল করে তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু ভোটে যিনি হেরে গিয়েছেন, তিনি জয়ীর দুর্গের সবচেয়ে দুর্ভেদ্য অংশটায় বার বার আঘাত হানছেন, এমনটা সচরাচর দেখা যায় না— মুরলীধর সেন লেনে ভারতী ঘোষকে নিয়ে চর্চাটা এখন এ রকমই। রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদকদের অধিকাংশ এ বিষয়েও একমত যে, ভারতী ঘোষ শুধু প্রতিপক্ষের দুর্গের সবচেয়ে দুর্ভেদ্য অংশে আঘাতই হানেনি, গত এক মাসে দুর্গ ধসিয়েও দিয়েছেন অনেকখানি।
ভোট মেটার পর থেকে কেশপুরে বার বার ছুটে যাচ্ছেন ভারতী। সপ্তাহ তিনেক আগে কেশপুরে ভারতীর তত্ত্বাবধানে বিজেপির জনসভা হয়েছে। দিলীপ ঘোষ, মুকুল রায়, সায়ন্তন বসুরা গিয়েছিলেন সে সভায়। যে কেশপুরে কয়েক মাস আগে প্রায় ৯১ হাজার ভোটে হার হয়েছে বিজেপির, সেই কেশপুরে ওই রকম জনসমাগম হতে পারে দলীয় সভায়, তা মুরলীধর লেনের কর্তারা অনেকেই আশা করেননি। ওই একটা সভাতেই থামেননি ভারতী ঘোষ। সন্ত্রাস এবং বিজেপি কর্মীদের হেনস্থার অভিযোগ তুলে গত মঙ্গলবার কেশপুরে প্রতিবাদ মিছিলের ডাকও দিয়েছিলেন তিনি। বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বকে চমকে যেতে হয়েছে সেই মিছিলের বহর দেখেও। পুলিশ যার, কেশপুর তার— এই ধারণা ভেঙে ভারতী ঘোষ যে ভাবে পর পর বড় বড় জনসমাগম ঘটাচ্ছেন কেশপুরে, তা বিজেপির রাজ্য দফতরে এখন রীতি মতো চর্চার বিষয়। গত মঙ্গলবার রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদকদের বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে চর্চা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
রাজ্য বিজেপির প্রায় সব কর্মসূচিতেই এখন ভারতী ঘোষকে সামনের সারিতে নিয়ে আসা হচ্ছে। ফাইল চিত্র
এই সব চর্চার সুবাদেই প্রাক্তন আইপিএসের দ্রুত উত্থান শুরু হয়েছে বিজেপিতে। ধর্না হোক, বড় মিছিল হোক, জনসভা হোক— রাজ্য বিজেপির প্রায় সব কর্মসূচিতেই এখন ভারতী ঘোষকে সামনের সারিতে নিয়ে আসা হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ বক্তাদের তালিকায় তাঁর নাম থাকছে। বিজেপি সূত্রের খবর, সংগঠনের আসন্ন রদবদলে ভারতীকে গুরুত্বপূর্ণ বা সম্মানজনক কোনও পদেও আনা হবে।
লোকসভা নির্বাচনের ফলপ্রকাশ তথা কেন্দ্রে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হওয়ার পরে রাজ্য বিজেপিতে রদবদল অবধারিত হয়ে পড়েছে। রাজ্য বিজেপির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক দেবশ্রী চৌধুরী রায়গঞ্জ থেকে জিতে সংসদে গিয়েছেন, মন্ত্রীও হয়ে গিয়েছেন। তাই ‘এক ব্যক্তি এক পদ’ নীতি অনুসারে সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে তাঁকে সরানো সময়ের অপেক্ষা। রাজ্য মহিলা মোর্চার সভানেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়ও হুগলি থেকে জিতে চলে গিয়েছেন সংসদে। তাই লকেটকে এখন অনেকটা সময় দিল্লিতে কাটাতে হচ্ছে। বাংলায় যখন থাকছেন, তখন নিজের নির্বাচনী এলাকায় সময় দিতে হচ্ছে। অতএব মহিলা মোর্চার জন্য আগের মতো সময় দেওয়া লকেটের পক্ষে এখন কঠিন। তাই রাজ্য মহিলা মোর্চার শীর্ষ পদেও বদল অবধারিত। অন্য কয়েকটি মোর্চা এবং সেলের শীর্ষ পদেও বদল হবে বলে বিজেপি সূত্রের খবর। সেই রদবদলেই ভারতী ঘোষের বর্ধিত গুরুত্বে বিজেপি নেতৃত্বের সিলমোহর পড়তে চলেছে বলে শোনা যাচ্ছে।
ঠিক কী ধরনের দায়িত্ব ভারতীকে দেওয়া হবে? বিজেপি সূত্রের খবর, মহিলা মোর্চার পরবর্তী রাজ্য সভানেত্রী হিসেবে ভাবনায় রয়েছে ভারতীর নাম। আবার রাজ্য বিজেপির অন্যতম সহ-সভানেত্রীও করা হতে পারে তাঁকে। মোটের উপর ভারতীকে রাজ্য স্তরের নেতৃত্বে তুলে আনার সিদ্ধান্ত প্রায় পাকা।
ভারতীর গুরুত্ব যে বাড়তে চলেছে, সে কথা জানাতে বিজেপি নেতারা এখন দ্বিধাও করছেন না। রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসুর কথায়, ‘‘ভারতী ঘোষ খুব পরিশ্রম করছেন, ইতিবাচক একটা ভঙ্গি নিয়ে কাজ করছেন। তিনি বেশ কয়েকটা জেলাকে খুব ভাল ভাবে চেনেন। দীর্ঘ প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাও রয়েছে। তাই তাঁর বিষয়ে দল খুব গুরুত্ব দিয়েই ভাবছে।’’
আরও পড়ুন : মেয়র পদ ছাড়লেন সব্যসাচী, বিধাননগরের নতুন মেয়র বাছতে ‘সময়’ নেবে তৃণমূল
আরও পড়ুন : বানতলায় পাঁচ লক্ষ কাজ হবে, দাবি মমতা
ভারতী নিজেও জানেন, নেতৃত্ব এখন কী চোখে দেখছেন তাঁকে। মুখে বলছেন না ঠিকই, কিন্তু এ-ও জানেন যে, বড় দায়িত্ব পেতে পারেন শীঘ্রই কিন্তু তার জন্য নিজের অতীতকে নেতিবাচক আলোয় দেখতে ভারতী চান না। তিনি বলছেন, ‘‘আমার অতীতকে আমি কিছুতেই অস্বীকার করব না, কারণ অতীতটা আমার সম্পদ এবং তার উপরে দাঁড়িয়েই আমি ভারতী ঘোষ। আমার অতীত যদি খারাপ হত, তা হলে আমি ৬ লাখেরও বেশি ভোট পেতাম না। ’’
কিন্তু রাজ্যের দাপুটে পুলিশকর্তা থাকাকালীন তাঁর যে ছবি জনমানসে তৈরি হয়েছিল, সেটা যদি বহাল থাকে, তা হলে কি রাজনীতির পথটা মসৃণ হবে? ফুঁসে ওঠেন প্রাক্তন আইপিএস। বলেন, ‘‘কোন ছবির কথা বলছেন? তৃণমূল নেতারা আমার যে ছবির কথা বলেন, সেই ছবি? শুভেন্দু অধিকারী আমার যে ভাবমূর্তির কথা লোক দিয়ে রটান, সেই ভাবমূর্তি? জঙ্গলমহলের সাধারণ মানুষের কাছে যান, কথা বলুন, আমার ভাবমূর্তিটা বুঝতে পারবেন।’’
পাল্টা প্রশ্নও তুলে দেন ভারতী ঘোষ। জঙ্গলমহল যদি হেসে থাকে, কয়েক হাজার মাওবাদী যদি আত্মসমর্পণ করে থাকে, জঙ্গলমহলে যদি শান্তি ফিরে থাকে, তা হলে সেটা কার কৃতিত্বে? প্রশ্ন ভারতী ঘোষের। তার পরে তাঁর নিজেরই উত্তর, ‘‘আমার কৃতিত্বে। গ্রামে গ্রামে গিয়েছি, রাত কাটিয়েছি, সাধারণ মানুষের সঙ্গে পুলিশের যোগাযোগ বাড়িয়েছি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জঙ্গলমহলে ঢুকতেই পারতেন না, যদি ভারতী ঘোষ না থাকতেন।’’ অতীত নিয়ে প্রশ্ন তোলা যে তাঁর মোটেই পছন্দের নয়, সে কথা মনে করিয়ে ভারতীর সদর্প মন্তব্য, ‘‘আমার অতীত হল লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স, আমার অতীত হল হার্ভার্ড, আমার অতীত হল ভারতীয় পুলিশ অফিসার হিসেবে রাষ্ট্রপুঞ্জের মিশনে অংশ নেওয়া, আমার অতীত হল হাজার মাওবাদীকে আত্মসমর্পণ করানো।’’
কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তা এনে প্রাক্তন পুলিশকর্তার মন্তব্য, ‘‘আমি যথেষ্ট মজবুত মানুষ। অপপ্রচার যতই তীব্র হোক, তার বিরুদ্ধে লড়ার ক্ষমতা আমার রয়েছে। আমি লড়বও।’’ এই কাঠিন্যই সম্ভবত ভারতীর স্কোর আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে গেরুয়া স্কোরবোর্ডটায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy