অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নরেন্দ্র মোদী। ফাইল চিত্র।
স্বাধীনতার যুদ্ধ, তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার, সুশীল ধাড়া, সতীশ সামন্ত— শনিবার থেকে রবিবার ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে বারংবার এই শব্দগুলো শুনল মেদিনীপুর। শুনল গোটা বাংলা। শনিবার শাসক তৃণমূলের অঘোষিত দু’নম্বর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তৃতায়। আর রবিবার দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভাষণে। আচমকাই ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে শিরোনামে চলে এল মেদিনীপুর। পূর্ব এবং পশ্চিম মিলিয়ে যে জেলার ঝুলিতে ৩৫ আসন। অবিভক্ত মেদিনীপুরের স্বাধীনতার যুদ্ধকে সামনে রেখে শাসক পক্ষ যখন বলছে, ‘‘এ হল দ্বিতীয় স্বাধীনতার লড়াই।’’ স্বাধীনতা একটি পরিবারের দখল থেকে মেদিনীপুর মুক্ত করার। যুযুধান বিরোধীও তখন বলছে, ‘‘এই লড়াই স্বাধীনতার লড়াই। শাসকের অপশাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার যুদ্ধ।’’
২০১১ সালের পরিবর্তনের যুদ্ধে আন্দোলনের ধাত্রীভূমি ছিল পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম। তার পরে যুক্ত হয়েছে পশ্চিমের জঙ্গলমহল। এক দিকে শাসক শিবিরের সেনাপতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন নন্দীগ্রাম থেকে নিজে ভোট লড়ার কথা ঘোষণা করেছেন তখন বিরোধী শিবিরের প্রথম সারির সেনানি শুভেন্দু অধিকারী বলছেন, ‘‘পূর্ব মেদিনীপুরের আমি আর পশ্চিমের দিলীপ ঘোষ দু’জনে মিলে বিজেপি-কে ৩৫টা আসনই দেব।’’
শনিবার শুভেন্দুর শহর কাঁথিতে দাড়িয়ে অভিষেক তাঁকে আক্রমণ করে বলেন, ‘‘মেদিনীপুরের মাটিকে কলুষিত করে বিজেপি-তে যোগ দিয়েছেন উনি।’’ মেদিনীপুর জেলার স্বাধীনতা সংগ্রামী বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, মাতঙ্গিনী হাজরা, সতীশ সামন্ত, সুশীল ধাড়াদের নামও শোনা যায় অভিষেকের বক্তৃতায়। এসেছে কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার প্রসঙ্গ। শুভেন্দুর উদ্দেশে অভিষেকের কটাক্ষ, ‘‘সে দিন যে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছিল, এখন তার পায়ে হাত দিয়েই প্রণাম করে।’’
তার ২৪ ঘণ্টার পরে রবিবার মোদীর বক্তব্যে বারবার এল মেদিনীপুরের কথা। দেখা গেল, ‘মেদিনীপুর আবেগ’ ছোঁয়ার চেষ্টা। রবিবার হলদিয়ার হেলিপ্যাড ময়দানে বক্তব্যের শুরুটা মোদী করেন অনভ্যস্ত বাংলা উচ্চারণে। আর সেই বাংলা বক্তব্যে বারবার মেদিনীপুরের কথা। সমাবেশকে ‘প্রিয় মা বোন ভাই ও বন্ধুরা’ সম্বোধন করে বললেন, ‘‘মেদিনীপুরের এই পবিত্র মাটিতে আসতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। শহিদ মাতঙ্গিনী, বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর রক্তে রক্তিম হয়েছে এই ভূমি। এই ভূমিতে তৈরি হয়েছে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। এই মাটির বীর সন্তান বিদ্যাসাগর মহাশয় বাঙালিকে বর্ণপরিচয় দিয়েছেন। সতীশচন্দ্র সামন্তর হাতে হলদিয়া বন্দর তৈরি হয়েছে। মেদিনীপুরের এমন মাটিতে এসে আমি মুগ্ধ।’’ শনিবার অভিষেক এবং রবিবার মোদীর উচ্চারণ করা মনীষীদের নাম ইদানীং শুভেন্দুর সব বক্তৃতাতেই শোনা যায়। তিনি নিজেকে সতীশ সামন্ত, সুশীল ধাড়াদের উত্তরাধিকারের বাহক হিসেবে পরিচয় দেন।
রাজ্য রাজনীতিতে মেদিনীপুরের গুরুত্ব বরাবরই ছিল। স্বাধীনতা পূর্ব বাংলাতেও ছিল অখণ্ড মেদিনীপুরে অনেক ভূমিকা। এখন তিন জেলায় ভাগ হয়ে যাওয়া অখণ্ড মেদিনীপুরের কথাও নতুন করে শোনা যাচ্ছে নীলবাড়ি দখলের লড়াইয়ের আগে আগে। আর সেটা তৃণমূল, বিজেপি দুই তরফেই। ফারাক শুধু একটা। বিজেপির বক্তব্য, স্বাধীনতা আন্দোলনের বড় ভূমিকা থাকা মেদিনীপুরই তৃণমূল-মুক্ত বাংলা গড়তে নতুন স্বাধীনতার লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে। এই ইস্যুতে এক বন্ধনীতে উচ্চারণ করা হচ্ছে দলের দুই নেতার নাম। কাঁথির শুভেন্দু এবং গোপীবল্লভপুরের দিলীপের নাম। অন্য দিকে, তৃণমূলের বক্তব্য— স্বাধীনতা আন্দোলনে বড় ভূমিকা থাকা মেদিনীপুরকে বিজেপি-র হাতে যেতে দেওয়া চলবে না। শনিবার কাঁথিতে অভিষেক বলেন, ‘‘দীর্ঘদিন ধরে বলা হয়েছে মেদিনীপুর নাকি অধিকারী পরিবারের গড়। মেদিনীপুর কোনও পরিবারের গড় নয়।’’ শুভেন্দু এবং তাঁর পরিবারের নাম না করে ‘মিরজাফর অ্যান্ড কোম্পানি’কে ‘মেদিনীপুর থেকে বিতাড়িত’ করারও আহ্বান জানান তিনি।
নন্দীগ্রাম আসনে মমতার প্রার্থী হতে চাওয়াটাও আগে থেকেই নীলবাড়ির লড়াইয়ে মেদিনীপুরকে নিঃসন্দেহে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। ওই আসনে মমতার বিরুদ্ধে কে লড়বেন তা নিয়েও শনিবার শুভেন্দুকে খোঁচা দিয়েছেন অভিষেক। বলেন, ‘‘আপনি তো নিজেকে জননেতা বলেন, দায়িত্ব নিয়ে বলছেন না কেন, নন্দীগ্রাম থেকে ভারতীয় জনতা পার্টির টিকিটে শুভেন্দু অধিকারীকে প্রার্থী করুন, আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব। প্রকাশ্যে ইচ্ছাটুকু তো প্রকাশ করুন।’’ রবিবার প্রার্থী প্রসঙ্গ না শোনা গেলেও নন্দীগ্রামের উল্লেখ শোনা গেল মোদীর বক্তব্যেও। তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূলকে প্রশ্ন করতে চাই, যারা নন্দীগ্রামে গুলি চালিয়েছিল, যারা গরিব মানুষকে খুন করেছিল কেন তাদের দলে শামিল করেছেন? বাংলার গরিব মানুষ কি শুধুই ভোট নেওয়ার জন্য?’’ প্রসঙ্গত, আগে এমন প্রশ্ন তুলেছেন শুভেন্দুও। মমতা নন্দীগ্রামে প্রার্থী হতে চান ঘোষণার দিনই দক্ষিণ কলকাতায় বিজেপি-র সমাবেশ থেকে তিনি বলেছিলেন, ‘‘নন্দীগ্রামের মানুষ ভোলেনি যে, সেখানে গুলি চালানো পুলিশকর্তা অরুণ গুপ্তের বয়স ৬০ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও তৃণমূল সরকার চার বার তাঁকে এক্সটেনশন (চাকরির মেয়াদবৃদ্ধি) দিয়েছে। অধিকারীপাড়ায় গুলি চালানো পুলিশ অফিসার সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কে আদর করে দলে নিয়ে এসেছেন তৃণমূলের মহাসচিব (পার্থ চট্টোপাধ্যায়)।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy