আলিপুর জেল সংগ্রহশালার ইন্ডিপেন্ডেন্স কিচেনের মেনুকার্ড। সমাজমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত।
নিন্দার সুর শোনা যাচ্ছিল সমাজমাধ্যমে। মঙ্গলবার বিষয়টি শুনেই আলিপুর জেল মিউজ়িয়াম পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হিডকোর কর্তা দেবাশিস সেন ভুল স্বীকার করে নিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমি নিজে বিষয়টি খতিয়ে দেখব। কাউকে আঘাত দেওয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়। অবিলম্বে মেনুকার্ড পাল্টে ফেলব।’’
তার আগেই অবশ্য জেল সংগ্রহশালার খাদ্য বিপণি ‘একান্তে ইন্ডিপেন্ডেন্স কিচেন’-এর মেনুকার্ড ভাইরাল। তাতে স্পষ্ট লেখা চার ধরনের ভোজসম্ভার বা প্ল্যাটারের কথা। চার গোত্রের ভোজথালি সিপাহি বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, বিবিডি (যাকে বিনয়-বাদল-দীনেশ প্ল্যাটার বলছেন কর্মীরা) এবং আইএনএ বলে নামাঙ্কিত। ফেসবুকের একটি খাদ্য বিষয়ক গ্রুপে সিপাহি বিদ্রোহ এবং বিবিডি প্ল্যাটারের ‘রিভিউ’ পড়ে অনেকে বিষয়টি জানতে পারেন। নিজেদের গরিমার ইতিহাসকে হজম করা বাঙালির পাকযন্ত্র নিয়ে তখন থেকেই কটাক্ষের সুর ভাসতে থাকে।
এ দিন বিষয়টি শুনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন নুরুল হাসান চেয়ার অধ্যাপক অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এ তো পরিষ্কার ইতিহাসের জনমোহিনী বিকৃতি। অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এ সব খাবারের সঙ্গে ইতিহাসের ছিটেফোঁটা সম্পর্কও নেই। মিউজ়িয়ামে ঘুরতে ঘুরতে খিদে পেলে খাবারের বন্দোবস্ত থাকতেই পারে। তার সঙ্গে খামোখা ইতিহাসকে মেশানোর চেষ্টা কেন?’’
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ সুগত বসু মনে করিয়েছেন, ‘‘আগে ব্রিটিশ রেজিমেন্টে বিভিন্ন জাতিধর্মের আলাদা মেস ছিল। আজ়াদ হিন্দ ফৌজে নেতাজিই প্রথম সবার এক সঙ্গে খাওয়া চালু করেন। খাবারের সঙ্গে আইএনএ-র সম্পর্ক তাই গুরুত্বপূর্ণ। মেনুকার্ডের এ সব নামকরণে তাই বিষয়টা খেলো করা হয়েছে। আশা করি, ওঁরা দ্রুত শুধরে নেবেন।’’
বছর দুয়েক আগে দিল্লির ন্যাশনাল মিউজ়িয়ামে সিন্ধু সভ্যতার স্বাদগন্ধ মেলে ধরার একটি প্রয়াস দেখা যায়। তাতেও দেশের বর্তমান শাসকদের ভাবাবেগ মেনে চলতে গিয়ে আমিষ পদগুলি বর্জন করা নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়েছিল। এ বার স্বাধীনতার নায়কদের নামাঙ্কিত থালি চাক্ষুষ করে সমাজমাধ্যমে কটাক্ষ, জেলে তো স্বাধীনতা-সংগ্রামীরা প্রায়শই অনশন করতেন। লাহোর জেলে অনশন করে যতীন দাস প্রাণ বিসর্জন পর্যন্ত দিয়েছিলেন। তা হলে এ বার তাঁর নামে খাবার-বিহীন খাবারের থালিও বিক্রি করা হোক!
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের শিক্ষক উপল চক্রবর্তীর মতে, ‘‘সারা দুনিয়াতেই মিউজ়িয়াম, সঙ্গের সুভেনির শপ (স্মারক বিপণি), কাফে ইত্যাদি মিলিয়ে ইতিহাসের এক ধরনের পণ্যায়নের পরিসর তৈরি হয়। ইতিহাস তখন আমজনতার খোরাক হয়ে ওঠে। মেনুকার্ডটায় এরই উদ্ভট রূপ।’’
হিডকো কর্তার সঙ্গে কথা বলার পরে আলিপুর জেল মিউজ়িয়ামের ভোজশালাটিতে ঢুকলে অবশ্য এ দিন মেনুকার্ডটি দেখা যাবে না বলে জানানো হয়। তবে রেস্তরাঁকর্মীরা এ দিনও জানিয়েছেন, ভেটকি, মাটন সমৃদ্ধ আইএনএ প্ল্যাটার রয়েছে। এবং ন’রকমের পদ বিশিষ্ট নিরামিষ বিবিডি প্ল্যাটারও মজুত। সচেতন পর্যটকদের কারও কারও অভিমত, অত্যন্ত সুষ্ঠু ভাবে তৈরি এই সংগ্রহশালাটিতে পদে পদে ইতিহাসের ছোঁয়াচ রোমাঞ্চিত করে। সেখানে বিচিত্র এই মেনুতে সুর কাটছে। আবার মিউজ়িয়মের স্মারক-বিপণিতে বইয়ের তালিকায় শুধুই মুখ্যমন্ত্রীর লেখা গ্রন্থসমূহ। ইতিহাসচর্চার বিশেষ প্রমাণ সেখানে নেই। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা সাক্ষী, বিশ্বনাগরিক বাঙালি বহু দিনই সর্বভূক। তবে ইতিহাস গুলিয়ে ফেলা এমন মেনু সোনামুখে হজম করতে তার আপত্তিই আপাতত সমাজমাধ্যমে মালুম হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy